নিঝুম রাস্তাঘাট। —নিজস্ব চিত্র।
আমরা, মানে আমি প্রিয়াঙ্কা এবং আমার স্বামী কৌশিক, ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকার টেনেসি রাজ্যে অবস্থিত একটি ছোট শহর মেমফিসের বাসিন্দা। শহরটির গা ঘেঁষে বয়ে চলেছে মিসিসিপি নদী। সাধারণত, আমেরিকা বলতে যে-সব শহরের কথা মাথায় আসে, মেমফিস অবশ্যই তার মধ্যে নয়। আমিও চাকরির সন্ধান পাবার আগে পর্যন্ত শহরটির নাম শুনিনি। তবে আজ প্রায় পাঁচ বছর এখানে থাকতে থাকতে শহরটির ওপর মায়া পড়ে গিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মেমফিস নিউইয়র্ক বা শিকাগোর মতো বিখ্যাত না হলেও তার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন বিখ্যাত গায়ক এলভিস প্রিসলির হোমটাউন হল মেমফিস। শুধু তাই নয়, ব্লুজ সংগীত ঘরানার জন্মদাত্রীও বটে।
মোট কথা, এটি মিউজিকের তীর্থস্থান এবং ফেডেক্স-এর হাব। তা ছাড়াও আর একটি পরিচয় আছে শহরটির। এখানে বিখ্যাত হাসপাতাল সেন্ট জুড চিল়ড্রেন্স রিসার্চ হাসপাতাল অবস্থিত যেখানে নিখরচায় ক্যান্সার আক্রান্ত ছোট ছোট বাচ্চাদের চিকিৎসা হয়। আমি এবং আমার স্বামী সেই হাসপাতালেই ক্যান্সার নিয়ে গবেষণারত।
কয়েক মাস আগে পর্যন্ত আমাদের জীবনযাত্রা বলতে সপ্তাহে পাঁচ দিন নয়-দশ ঘণ্টার অফিস এবং সপ্তাহান্তে দুই দিন বন্ধুদের সাথে জমিয়ে আড্ডা, রেস্তরাঁ ঘোরা, কিছু প্রয়োজনীয় রান্না-বান্নার বাজার সেরে ফেলা। কিন্তু করোনাভাইরাসের আবির্ভাবের সঙ্গে জীবনযাপনের পুরো সংজ্ঞাটাই বদলে গেছে। প্রথম যখন উহানে এই কোভিড-১৯ রোগটির ব্যাপারে নেটের মাধ্যমে পড়ছি, তখনও আমি নিশ্চিন্ত যে এর করাল গ্রাস আমার সাদামাটা জীবনের ধারে-কাছেও থাবা বসাতে পারবে না। কিন্তু, যখন ইউরোপে এর প্রকোপ পড়ল তখন প্রথম চিন্তার ভাঁজ মাথায় এল। আমেরিকাও কি পড়বে এর কবলে? তবুও যেন মন উড়িয়ে দিল এই দুর্ভাবনাকে। প্রথম বিশ্বের একটি দেশ কি পারবে না এই ভাইরাসের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে? আমার মতো হয়তো আরও অসংখ্য লোকের তখনও এই আত্মবিশ্বাস, অথবা অন্ধবিশ্বাস ছিল!
আরও পড়ুন: করোনা এক দিন চলে যাবে, কিন্তু এ সঙ্কটের সময়ে আমাদের আচরণ বড় হয়ে থাকবে
আমার সেই বিশ্বাসে চিড় ধরল যখন আমেরিকাতে কোভিড-১৯ ধরা পড়ল। তবুও মনের কোণায় তখনও যেন সান্ত্বনা, এই দেশে এত উন্নত চিকিৎসা, ঠিক একটা ব্যবস্থা হবে।
এর পর এখানে হু-হু করে বাড়তে থাকল রোগীর সংখ্যা। এবং মৃত্যুর সংখ্যাও! এ বার আর দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা নয়, রীতিমতো ভয় ঢুকে পড়ল মনে। বাজার করতে ভয়, খাবার কিনতে ভয়, গাড়িতে গ্যাস ভরাতে ভয়, ডাক্তারের কাছে যেতে ভয়। ততদিনে মুখ ঢাকা পড়েছে মাস্কে, আর ওষুধের দোকানে হ্যান্ড সানিটাইজারের আকাল শুরু হয়েছে। ডিসেম্বরে যখন ভারতে গিয়েছিলাম, তখন প্রিয় কিছু ব্র্যান্ডের সাবান কিনে এনেছিলাম, কারণ আমেরিকাতে ওগুলোর দাম বড্ড বেশি। কথায় বলে না, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে, মধ্যবিত্ত মনও খানিকটা তেমনই! আজ সেই সস্তায় কেনা ভারতীয় সাবানগুলোই প্রাণ বাঁচানোর রসদ। এই কথাটা কেউ যদি আমায় ডিসেম্বরে ভবিষ্যৎবাণী করতো তাকে হয়তো আমি পাগল ভাবতাম !
এর পর আসে আমেরিকার লকডাউন পর্ব, এখানকার ভাষায় ‘দা নিউ নরমাল’। স্কুল, কলেজ, অফিস— সব বন্ধ। আমরা যেহেতু হাসপাতালে গবেষণারত, আমাদের জরুরি পরিষেবায় অন্তর্ভুক্ত করা হল। তার মানে আমরা সপ্তাহে কয়েক বার রিসার্চ ল্যাবে গিয়ে কিছু অত্যন্ত জরুরি ‘এক্সপেরিমেন্ট’-র কাজ করে আসব, যেগুলো প্রায় ৯-১০ মাস আগে শুরু হয়েছে এবং বন্ধ করা যাবে না। নতুন ‘এক্সপেরিমেন্ট’ শুরু করা এখন নিয়মবিরুদ্ধ।
আরও পড়ুন: সুড়ঙ্গ শেষের আলোর দেখা এখনও পাচ্ছি না
যে হেতু আমরা হাসপাতালে কাজ করি, তাই আমাদের ক্যাম্পাসে ঢোকার সময় অনেক স্ক্রিনিংয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় যাতে অসুস্থ বাচ্চাদের ক্ষতি না হয়। তবে আমরা দু’জনেই রিসার্চের সঙ্গে যুক্ত এবং সরাসরি রোগীদের সান্নিধ্যে আসা আমাদের বন্ধ। ক্যাম্পাসে তাই বিভিন্ন ব্যারিকেড এবং ব্যাজ করা হয়েছে। নিৰ্দিষ্ট রঙের ব্যাজ বহনকারী নির্দিষ্ট জায়গাতেই থাকবে এবং রোগীর সংস্পর্শে আসবে না । তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সবাইকে বাড়িতে থেকে কাজ করতেই উৎসাহ দিচ্ছে। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় না হলে ক্যাম্পাসে আসা বারণ। তবে রোগটির ভয়াবহতা সম্পর্কে আর একটু সচেতন হলাম যখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের ‘ভলান্টিয়ার’ হিসেবে নাম লেখাতে বলল। নতুন করে আশঙ্কা জাগল মনে। তা হলে কি হাসপাতালে যে সংখ্যক ডাক্তার-নার্স আছে, তাঁরা পর্যাপ্ত নয়? নাকি অত্যধিক রোগীর সংখ্যার আশঙ্কায় কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই সাবধান হচ্ছে ? এর উত্তর সময়ই দিতে পারবে।
কর্মজীবন যখন বদলে গেছে , ব্যক্তিগত জীবনই বা ঠিক থাকে কী ভাবে? সকালে উঠে ল্যাব যাওয়ার তাড়া নেই, তাই একটু দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা। তারপর ল্যাপটপ খুলে কাজে বসা হাতে কফির মগ বা চায়ের পেয়ালা নিয়ে। দুপরেও একটু দেরিতে লাঞ্চ , কখনও নেটফ্লিক্স চালিয়ে খাওয়া-দাওয়া। কয়েকদিন ছুটির মেজাজেই ছিলাম বাড়িতে। কিন্তু যখন সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে যায়, আর আশার আলোর দেখা মেলে না, তখন ছুটি দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সুগার-কোলেস্টেরল হোক বা ছুটি, যে কোনও কিছুর আধিক্যই জীবনকে ভারসাম্যহীন করে দেয়।
সেই ছোটবেলার স্বপ্ন ‘রোজ রোববার চাই’ যে এমন ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দেবে তা হয়তো আমার মতো অনেকেরই কল্পনাতীত। ছোট থেকে জেনে এসেছি আমেরিকা সব-পেয়েছির দেশ, যেখানে সবার স্বপ্ন সত্যি হয়। সেই দেশে যখন অতিমারির জন্য খাদ্যের অভাবের আশঙ্কা তৈরি হয়, কর্মসংস্থান-বাসস্থানের অভাবে লোকে রাস্তায় দাঁড়ায়, সেটা কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগে। তবে বাস্তব সর্বকালে কঠিন, নিষ্ঠুর। টিভি চালালে চারদিকে মৃত্যুর খবর, অর্থনীতির পতন, বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি। বন্ধুদের ফোন করি কখনও, কলকাতায় আত্মীয়স্বজনদের ফোন করি, কখনও ভিডিয়ো চ্যাট।
আরও পড়ুন: মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ!, প্রতিজ্ঞায় বুক বেঁধেছে বস্টন
ততদিনে আমেরিকায় আমার পরিচিতের মধ্যেই কারওর চাকরি গিয়েছে, কারওর মাইনে এক ধাক্কায় অনেকটাই কমেছে, আবার কারওর ‘ওয়ার্ক ভিসা’ শেষের পথে। বিষাদের ছায়া তাদের অনেকের জীবনেই নেমে এসেছে। কোথাও এক টুকরো আলো নেই। আমার চেনা জগৎ হঠাৎ পাল্টে গিয়েছে। আমার মনেও ভয় ঢোকে, চাকরিটা থাকবে তো? আগের মতো ইচ্ছেমতো খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়। কী করে সবটুকু সবজি খোসা-সমেত কাজে লাগানো যায় সেই ভাবে রান্না শুরু করি। তিন পদের জায়গায় এক বা দু’পদের সঙ্গে ভাত খাওয়ার অভ্যাস এখন হয়ে গিয়েছে। হ্যাঁ, এখনও আমরা মাছে-ভাতে বাঙালিই আছি! তবে এখন আগের থেকে অনেক বেশি সঞ্চয়ী, সংযমী আর সতর্ক আমি। শুতে যাবার আগে রোজ যখন ঠাকুর নমস্কার করি, তখন যোগ হয়েছে নতুন প্রার্থনা ‘পৃথিবীটাকে সুস্থ করো ঠাকুর, আমার আগের সেই সাদামাটা জীবন ফিরিয়ে দাও’। এটাই আমাদের ‘নিউ নরমাল’।
তবে এই হতাশার মধ্যেও যখন ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে দেখি কী ভাবে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে, কী ভাবে দূষণ কমছে, পশু-পাখি শহরের রাস্তায় ঘুরছে, তখন বুঝি পৃথিবীটা হয়তো একটু সুস্থ হয়েও উঠছে। হয়তো আমাদের এতকাল অত্যাচারের পর এইটুকু নিশ্বাস, এই এক পলক থমকানোর অধিকার ধরিত্রীর আছে। ভ্যাকসিন আসতে হয়তো ঢের দেরি আছে, ততদিনে আশা করছি ঈশ্বর আমাদের আগের ভুল-ত্রুটি মার্জনা করে দিয়ে আরও ধৈর্য্য, আরও সহ্যশক্তি দেবেন, যাতে আমরা এই বিপদ কাটিয়ে উঠে নতুন ভাবে আবার জীবন শুরু করতে পারি।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ-অর্থ, এই সব কিছুর উপরে মানব-ধর্ম। এই একটি রোগ আশা করি তা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। প্রকৃতির থেকে সব কিছু ছিনিয়ে নিয়ে নয়, সামঞ্জস্য রেখেই যাতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমাদের সভ্যতা বাঁচতে পারে, এই শিক্ষাই কাম্য। আশা করি সবাই সাবধানে থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।
প্রিয়াঙ্কা হালদার দে এবং কৌশিক কুমার দে, মেমফিস, টেনেসি, আমেরিকা
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy