লকডাউনে ব্রাসেলসের রাস্তাঘাট। নিজস্ব চিত্র।
আমার জীবনে বেড়ে ওঠার অনেকটা সময়ের সাক্ষী প্রিয় শহর কলকাতা। কর্মসূত্রে আমার বর গত কয়েক বছর হল কলকাতা ছেড়ে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস্ এর বাসিন্দা। বিয়ের পর ময়দান, গড়িয়াহাট, যাদবপুর এলাকা ছেড়ে আমার ও প্রায় বছর দুই হল এখানে বসবাস। চেনা মুখ, চেনা শহর, মাতৃভাষা ছেড়ে আমাদের পরবাসের একফালি ফ্ল্যাটের জীবনে একটাই খোলা জানালা— ইউরোপের মধ্যযুগীয় গ্রাম ও অচেনা সব রূপকথার শহর ঘুরে বেড়ানো।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি আমরা বুদাপেস্ট ঘুরে এসে আগামী মাসগুলোয় কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবো তা ঠিক করলাম। তখনও ইউরোপে করোনাভাইরাস মহামারির আঁচ লাগেনি। আমরা আন্দাজই করতে পারিনি, একটা ভাইরাস এসে সারা বছরের সমস্ত ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান মাটি করবে। ফ্ল্যাটের উল্টোদিকের রেস্তোরাঁয় রোজকার ব্যস্ততা, রুটিনমাফিক জীবন, সপ্তাহের শেষে বারগুলোতে আনন্দ উদযাপন। এ সবের মধ্যেই মার্চের শুরুতে শুনলাম ইতালিতে পাঁচশো জনের বেশি মানুষ আক্রান্ত। মনের মধ্যে তখন থেকেই একটু ভয় ঢুকতে শুরু করলেও, ভেবেছিলাম ইউরোপের দেশগুলো এত উন্নত, নিশ্চয় সব সামলে নিতে পারবে। কিন্তু মহামারি যে কী ভীষণভাবে আগ্রাসী হতে পারে তা আমি তখন ভাবতেও পারিনি।
স্কুল ছুটির জন্য বেলজিয়ামের ফ্ল্যান্ডার্স আর ওয়ালোনিয়া অঞ্চলের বাসিন্দারা ইতালি ঘুরে আসার পর মার্চের প্রথম পনেরো দিনেই আক্রান্তের সংখ্যা এক থেকে প্রায় দেড় হাজার হয়। ১৬ মার্চ এখানে স্কুল, ক্যাফে, রেস্তোরাঁ, বার বন্ধ করার কথা ঘোষণা করা হয়। তখন সমস্ত সুপার মার্কেটে জিনিস কেনার এত হিড়িক পড়েছিল বিল্ডিং-এর নীচের দোকান থেকে রোজকার দরকারি জিনিস, সামান্য আলু, পেঁয়াজ কিনতে পারিনি। ১৮ মার্চ থেকে পুরোপুরিভাবে লকডাউন হওয়ায় ওয়ার্ক ফ্রম হোম হয় বরের। শনিবার শুধু আমাদের বিল্ডিং-এর নীচের সুপার মার্কেটে গিয়ে সাত দিনের বাজার করে নিয়ে আসা, বেরনো বলতে শুধু এটুকুই। ঘরে ফিরে স্যানিটাইজ করতে হবে বলে মোবাইল ফোনও নিয়ে যায় না।
আক্রান্তের সংখ্যা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। রোজ কোন দেশে কত নতুন আক্রান্ত, কত জন সুস্থ হচ্ছে এ সব দেখা অভ্যেসে পরিণত হয়েছিল। বিভিন্ন মিডিয়ায় ইতালির খবর জেনে দু’দিন ভালো করে খেতে পারিনি। এত বড় মৃত্যু মিছিল, মানুষের অসহায়তার কথা ভাবলেই চোখ ভিজে যাচ্ছিল নিজের অজান্তেই। নিজের দেশে ভাইরাস ছড়াচ্ছে শুনে শুরুতে ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলাম। আমাদের সব প্রিয়জন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে। কিছুদিন সময় লাগল বাবাদের এটা বোঝাতে যে রোজ বাজার করাটা একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ কাজ নয়। এই ভাইরাসের একটাই ওষুধ বাড়িতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে থাকা।
দেশের আর এখানের দু’দিকের হাজার চিন্তা সব সময় মনের ভিতর ঘুরতে থাকে। তবে সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে মনের ভিতর ভয় বা আতঙ্ক এখন অনেকটা কমেছে। এখানে লকডাউনের শুরু থেকে রোজ রাত ৮ টায় ব্যালকনিতে বেরিয়ে হাততালি দিয়ে বা মাউথ অর্গান বাজিয়ে গান গেয়ে সমস্ত চিকিৎসক, নার্স, হাসপাতাল স্টাফদের ধন্যবাদ জানাচ্ছে মানুষজন। গত সপ্তাহে এখানে রেস্তোরাঁ সব খুলে গেছে, তবে শুধু হোম ডেলিভারি হচ্ছে। এখানকার সুপার মার্কেট বাড়িতে পানীয় জল থেকে শুরু করে দুধ-ডিম-সবজি সমস্ত কিছু ডেলভারি করায়, আবাসনের বাইরে পা পর্যন্ত রাখতে হচ্ছে না। শেষ তিন সপ্তাহ আমরা আক্ষরিক অর্থেই ঘর বন্দি । বাড়িতে অবসর সময় কাটাতে কিছু হবি আর ক্রাফ্ট মেটিরিয়াল এর দোকান চালু হয়েছে।
লকডাউন দশায় আমার পুরনো কিছু শখ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সকালে উঠে গাছে জল দেওয়া, বসন্তের নতুন পাতার যত্ন নেওয়া, নিজের ইচ্ছেমত টবগুলোকে রাঙিয়ে তোলা, সব মিলিয়ে সময় মন্দ কাটছে না। ব্যালকনিতে সতেজ সবুজ প্রাণের ছোঁয়াচ ফ্যাকাশে দিনগুলিতে নতুন করে আশা জোগাচ্ছে মনে।
গত কয়েকদিন ধরে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা দেড়শোর কাছাকাছি ঘোরাফেরা করছে। আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা অনেক কমেছে ঠিকই কিন্তু মৃত্যুর হার অন্যান্য দেশের তুলনায় এখানে একটু বেশি। তার কারণ এখানে যারা কোভিড-১৯ সন্দেহে মারা যাচ্ছে সেই সংখ্যাও হিসেবের আওতায় আনা হচ্ছে। জানিনা এর শেষ কোথায়।
সময় যেন কোনো এক দুঃস্বপ্নে থমকে গিয়েছে। আতঙ্কে শিউরে উঠি এই মহামারির ভয়াবহতা দেখে। মানুষের ছোঁয়া কত বিষাক্ত আজ। পুজোয় প্রিয়জনদের কাছে ফেরার কথা ছিল, দেশের মাটির গন্ধ নেওয়ার কথা ছিল বুক ভরে। আশা করে আছি নিশ্চয়ই তার মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। সব কিছু আবার ছন্দে ফিরবে। প্রিয় পৃথিবী ঠিক সব আঘাত সামলে সেরে উঠবে।
প্রমিতা প্রধান, ব্রাসেলস্, বেলজিয়াম
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy