সত্যজিৎ রায়ের শেষ ছবি তিনটি দেখে তাঁর প্রতিবাদী মুখটি অনেকই মুগ্ধ করেছে। ফাইল চিত্র।
পুনর্জিৎ রায়চৌধুরীর ‘কাব্যময়তা নয়, প্রতিবাদ’ (৭-৫) প্রবন্ধটি যেমনই সুখপাঠ্য, তেমনই সময়োচিত। প্রবন্ধে উল্লিখিত সত্যজিৎ রায়ের শেষ ছবি তিনটি দেখে তাঁর প্রতিবাদী মুখটি আমাকেও মুগ্ধ করেছে। শিল্পীর মধ্যে যদি সামাজিক চেতনাই না থাকে, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে ঘটে-যাওয়া অন্যায়-অবিচারের সামনে যদি সে মুখ বুজে থাকে, তবে সেই শিল্পীসত্তার কী-ই বা মূল্য আছে! রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে শুরু করে সত্যজিতের মতো মানুষেরা আজ যদি কেবলই কাব্যময়তার মধ্যে পড়ে থাকতেন, তবে সমাজ হত বন্ধ্যা। হীরক রাজার প্রজাদের মতো, স্থবির। তবে এ কথাও অস্বীকার করার জো নেই যে, বেদনাহত, প্রতিবাদী অভিব্যক্তি অন্যের হৃদয়ও নিশ্চিতরূপে স্পর্শ করে। নইলে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বাংলাদেশ কিংবা রাশিয়ায় ওই ভাবে রাষ্ট্রবিপ্লব সংঘটিত হতে পারত না। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের নাইট উপাধি ত্যাগ হয়তো সমাজকে বদলাতে পারেনি, তবে তা আজও মানুষের মনকে নাড়া দিয়ে যায়। গণশত্রু ছবির নায়ক চিকিৎসক অশোক গুপ্তের মধ্য দিয়ে আমরা সত্যজিতের বিচলিত এবং বেদনাহত চরিত্রটিকে খুঁজে পাই। দুর্নীতি, কপটতা, ছলচাতুরি, ধর্মের নামে কুসংস্কার, উগ্র মৌলবাদ, ক্ষমতার প্রতি উৎকট লালসা এবং সেই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের একাংশের দ্বিচারিতা আজও দেখতে হচ্ছে। অযোগ্য মানুষের নেতৃত্ব, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে রাজনীতি, ধর্মের আফিম খাইয়ে এক জনের বিরুদ্ধে আর এক জনকে লড়িয়ে দেওয়া— এই সব দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি বেড়েছে বই কমেনি।
সমাজ সেই অর্থে বদলায়নি ঠিকই। তবে কিছু মানুষের ‘রেভলিউশনারি হার্ট’ তৈরি হয়েছে বইকি। দেশ জুড়ে সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন তারই একটি মোক্ষম প্রমাণ। মাঠের এই বিপ্লব আর শিল্পীর কলমে উঠে আসা বিপ্লব কখন, কী ভাবে, কোন দিকে মোড় নেবে, কেউ বলতে পারে না। ‘সত্যমেব জয়তে’— এটিই বিপ্লবের আসল রসদ। আমরা সবাই অশোক গুপ্তের মতো হতে পারি না। গণশত্রু-র মতো ছবি দর্পণস্বরূপ, যা আমাদের সজাগ করে দেয়। সব মানুষকে ভয় দেখিয়ে কিংবা প্রলোভনের দ্বারা বশ করা যায় না। তাঁরা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘটিয়ে বসেন। তার পর সাধারণ মানুষের হুঁশ ফেরে। গণশত্রু-তে তার প্রকাশ আমরা দেখেছি। সত্যের জয় সেখানে হয়েছে। বাস্তব সমাজজীবনেও এমনটি ঘটে। সত্যজিৎ রায়ের মতো প্রতিবাদী মন আজ আরও বেশি করে দরকার।
বাবুলাল দাস, ইছাপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
মধ্যমেধার যজ্ঞ
পুনর্জিৎ রায়চৌধুরী সত্যজিতের শেষ তিনটি ছায়াছবি পর্যালোচনা করতে গিয়ে কিছু অযৌক্তিক দাবি করেছেন। তাঁর মূল বক্তব্য এই রকম: প্রথমত, দর্শক ও সমালোচক, সত্যজিতের শেষ তিনটি ছবির যথাযথ মূল্যায়ন করে উঠতে পারেনি। এই ছবিগুলির প্রতি আমাদের উদাসীনতার কারণ এই যে, দৃশ্য-কল্পনা ও কাব্যময়তার যে উৎকৃষ্ট নিদর্শন সত্যজিৎ স্থাপিত করেছিলেন নিজের অন্যান্য ছবিতে, তার তুলনায় গণশত্রু, শাখা-প্রশাখা ও আগন্তুক মামুলি ও ফিকে। দ্বিতীয়ত, লেখকের মতে, এই তিনটি ছবির সামাজিক তাৎপর্য চূড়ান্ত। সত্যজিৎ নাকি তার সংযত বহিঃপ্রকাশ বর্জন করে, অধিক মাত্রায় প্রতিবাদী ও সরব হয়ে উঠেছিলেন তাঁর শেষ তিনটি ছবিতে— ধর্মান্ধ, দুর্নীতিগ্রস্ত ও বস্তুবাদী বুর্জোয়া সমাজের বিরুদ্ধে। লেখক এ-ও মনে করেন যে, সত্যজিতের ষাট ও সত্তরের দশকের ছবিগুলি যতই কাব্যময় ও বহুস্তরযুক্ত হোক না কেন, সেগুলি “স্পষ্টত সামাজিক নয়।”
এ থেকে আন্দাজ হয় যে, আরও অনেকের মতো, লেখকও হয়তো চলচ্চিত্র-নির্মাণ সম্বন্ধে সত্যজিতের নিজস্ব ভাবধারা নিয়ে যথেষ্ট অবহিত নন। বিষয় চলচ্চিত্র বইটিতে সত্যজিৎ স্পষ্ট লিখেছেন যে, পরিচালকের হাতে যে ক’টি উপাদান আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল হল সংলাপ। মনে রাখবেন, এই কথাটি বলছেন এমন এক জন নির্মাতা, যাঁর সংলাপ লেখার দক্ষতা অতীব উন্নত মানের। সত্যজিতের সংলাপের মার্জিত ব্যবহার, তাঁর সংলাপের রসবোধ, আনাচে-কানাচে নিমজ্জিত বিদ্রুপ— তাঁর কাহিনিকে যে কেবল সমৃদ্ধ করে তা নয়, সেই সংলাপের মাধ্যমে আমরা আবিষ্কার করি বিভিন্ন চরিত্রের মনস্তত্ত্ব ও সুনির্দিষ্ট সামাজিক অবস্থান। সত্যজিতের নিখুঁত শট-ডিভিশন, তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ ফ্রেমিং, তাঁর নিটোল গল্প বলার প্রয়াসের সঙ্গে সঙ্গে, তাঁর পরিমার্জিত সংলাপের ব্যবহারও তাঁর নন্দনশৈলীর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সেই অসামান্য সংলাপ-লিখিয়ের সংলাপের-ব্যবহার সংক্রান্ত স্বীকারোক্তি পড়লে বোঝা যায় যে, যতটা না হলেই নয় কেবল ততটাই সংলাপ সংযোজনে তিনি বিশ্বাসী। আগে দৃশ্য, শব্দ, আবহ, অভিনয়, ইশারা। তাতেও অভিব্যক্তি প্রকাশ না পেলে, তবেই সংলাপের প্রয়োজন।
যে নির্মাতা সংলাপ ব্যবহারে এমন কৃপণ, সেই যুধিষ্ঠিরের চাকা মাটি ছুঁল শেষ বয়সে। সংলাপের অযথা ও অতিরিক্ত ব্যবহারের বিরোধী মানুষটি সংলাপ-নির্ভর হয়ে উঠলেন। তিনি বেছে নিলেন সহজ আপসের পথ, স্থূল অভিব্যক্তি, যার বিষয়বস্তু ও নন্দন দুই-ই বেজায় ভোঁতা। জোর গলায় জাহির করলেন ব্যক্তিগত নৈতিক অবস্থান, যেমনটা ঋত্বিকও করেছেন তাঁর যুক্তি তক্কো আর গপ্পো ছবিতে। বহুমাত্রিক ধূসরতা সরিয়ে খুঁজলেন সাদা-কালো চরিত্র। যে কারণে তাঁর শেষ তিনটি ছবি নীতিগর্ভে নিমজ্জিত। মানসিক অবস্থানের জটিলতা বাদ দিয়ে, উঠে এল ভাল-খারাপের সরল দ্বৈতকরণ— গণশত্রু-তে বিশ্বাস বনাম যুক্তি, সমাজ বনাম ব্যক্তি। শাখা-প্রশাখা ছবিতে দু’নম্বরি বনাম এক নম্বরি, এ কাল বনাম সে কাল। আগন্তুক-এ আদিবাসীর সভ্যতা ও আধুনিকতার অসভ্যতা, অর্থাৎ সভ্যতার সঙ্কট। আধুনিক সমাজ গ্লানিময়, আর জনজাতিদের সব ভাল, শুধু অবাধ বহুগামিতা ছাড়া!
শেষ তিন ছবির চরিত্ররা আক্ষরিক অর্থে যেখান থেকেই আসুক না কেন, যেখানেই যাক না কেন— তাদের আসল অবস্থান চেয়ার সোফা আর বিছানা— যেখানে শুয়ে-বসে তারা নৈতিকতা কপচায়। কোনও অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলতা বা অনিশ্চয়তা নেই তাদের, কেবলই আছে বাহ্যিক সংঘর্ষ ও স্থূল নৈতিকতার বিচার। সূক্ষ্ম দাগে ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে যে কথাগুলি শৈল্পিক দক্ষতার সঙ্গে সত্যজিৎ বলেছিলেন পথের পাঁচালী থেকে ঘরে-বাইরে পর্যন্ত, তারই এক সহজ সারাংশ তিনি দিলেন শেষ তিনটি ছবিতে, অত্যন্ত চড়া দাগে। কাজেই যেটাকে বেশি মাত্রায় ‘সামাজিক’ ও ‘প্রতিবাদী’ বলে গৌরবান্বিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, সেটা আসলে ‘মিডিয়োক্রিটি’-র উৎকৃষ্ট উদাহরণ ছাড়া আর কিছু নয়। প্রতিবাদী হওয়ার জন্য, সত্যজিৎকে আগে কখনওই বসার ঘরে আসর বসাতে হয়নি, বা আধুনিক সত্তা অস্বীকার করার জন্য চরিত্রকে জোর গলায় বলতে হয়নি: “আমি নিজে জংলি নই সেটা আমার পরম আক্ষেপের ব্যাপার।” ঘরে লিঙ্গ-বৈষম্য স্থাপিত করতে তাঁর বৌ-পেটানো-মরদের প্রয়োজন হয়নি। মহানগর-এর গোড়ায় মিনমিন করে উচ্চারিত একটি সংলাপই যথেষ্ট: “আর্নিং মেম্বারকে এ ভাবে নেগলেক্ট করছ?” যা ছিল তাঁর ছবির ঐশ্বর্য, পরে তা-ই হয়ে উঠল দুর্লভ।
এর পরও প্রতিনিধিত্ব ওপ্রতিবাদ খুঁজতে দ্বারস্থ হব সত্যজিতের শেষ তিন ছবিতে? মধ্যমেধার এই মহাযজ্ঞ না দেখতে পাওয়া কি আমাদেরই মেধা নিয়ে প্রশ্ন তোলে না? সত্যজিৎ অবশ্যনানা সাক্ষাৎকারে দেশীয় দর্শকের মেধা নিয়ে বরাবরই সংশয় প্রকাশ করে গিয়েছেন।
শ্রীদীপ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরপ্রদেশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy