Advertisement
০৪ অক্টোবর ২০২৪
RG Kar Medical College and Hospital Incident

সম্পাদক সমীপেষু: অন্যায়ের ধারাপাত

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য সর্বত্রই বিপুল দুর্নীতির অভিযোগ। অনেকে নির্লজ্জ ভাবে প্রশ্ন করছেন, অন্যত্র ঘটে-যাওয়া ঘটনাগুলিতে বিবেক জাগ্রত হয়নি কেন?

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২৪ ০৪:১৫
Share: Save:

সোমা মুখোপাধ্যায়ের প্রতিবেদন ‘অন্তহীন কঙ্কালের স্তূপ’ (৭-৯) পড়ে আতঙ্কে ভুগছি। একটি অমানবিক ধর্ষণ, খুন ও তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে ‘সিস্টেম’-এর চরম ব্যর্থতা দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। অসহায় ডাক্তার কন্যার আর্তনাদ, বাবা-মায়ের হাহাকার, কোনও কিছুই সিস্টেমকে বিচলিত করতে পারেনি। সেই অনুষঙ্গে সোমা মুখোপাধ্যায় যে পচে-যাওয়া স্বাস্থ্যব্যবস্থার কথা বলেছেন, তা ভয়ঙ্কর। তার সঙ্গে বৈদ্যুতিন মাধ্যমের কথা যোগ হলে সামনে নিকষ অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দৃশ্যমান হয় না। আমার অভিজ্ঞতা একটু ভিন্ন ছিল। ২০২২ সালে বাবা স্নায়ু রোগে আক্রান্ত হয়ে দু’মাস বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস-এ ভর্তি ছিলেন। সেখানে থাকাকালীন মারা যান। সেই সময়ে উডবার্ন ওয়র্ডের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দুঃখের মধ্যেও মুখে একটি মুচকি হাসি খেলে যেত। কিন্তু তার পর সেই হাসিটি ক্রমে বিলীন হয়ে মনে শ্রদ্ধার ভাব ফুটে উঠত। যে ভাবে জুনিয়র ডাক্তাররা সারা দিন রোগীদের চিকিৎসা করতেন, সিনিয়র ডাক্তাররা পরামর্শ দিতেন, কখনও বা আমার সামনেই তাঁদের শেখাতেন, দেখে মাথা নত হয়ে যেত। অবহেলা, দুর্ব্যবহার, আয়াদের অত্যাচার যে সেখানে ছিল না, তা নয়। কিন্তু বিপুল কাজের চাপের নিরিখে তা সামান্য। কিছু প্রশাসক ডাক্তার এবং পিজিটি-র কাজ শ্রদ্ধার সেই ভিত্তিটাকে নাড়িয়ে দিল। কোন অতল অন্ধকারে আমরা প্রবেশ করছি!

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য সর্বত্রই বিপুল দুর্নীতির অভিযোগ। অনেকে নির্লজ্জ ভাবে প্রশ্ন করছেন, অন্যত্র ঘটে-যাওয়া ঘটনাগুলিতে বিবেক জাগ্রত হয়নি কেন? বিভিন্ন দুর্নীতির ঘটনায় সম্মিলিত ক্ষোভ এক অসহনীয় বিন্দুতে পৌঁছে এই আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে, তা বোঝার শক্তিও তাঁদের নেই। এই সময় আদর্শের কথা, নীতির কথা আরও বেশি করে বলা দরকার। কিন্তু বলতে গিয়ে গলার স্বর কেঁপে যাচ্ছে। এত দিন যা জেনে এসেছি, ভেবে এসেছি, ভাবিয়ে এসেছি, সব কি তা হলে ভুল? আত্মত্যাগী স্বাধীনতা সংগ্রামীরা, সমাজ সংস্কারকরা এমন একটি দেশ কি চেয়েছিলেন? একমাত্র আশা নবীন প্রজন্ম। সমাজে অবিরাম মিথ্যার, অন্যায়ের ধারাপাতের মধ্যে, ‘ফেক’ খবরের বিশ্বের মাঝেও তাদের হৃদয়ের কোণে এখনও কোমল জায়গাটি জেগে আছে। প্রৌঢ় বয়সে তাদের প্রণাম জানাই।

সৌমেন রায়, মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

প্রশ্রয়ের হাত

অতিমারির আবহে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল, এমএস পড়ুয়ার কয়েক জনকে ফেল করানোর পরিপ্রেক্ষিতে নির্দেশ আসে যে, কোনও মতেই ফেল করানো চলবে না। অথচ পরীক্ষকের মত, পরীক্ষার্থীরা যা লিখে এসেছেন, তার ভিত্তিতে তাঁদের পাশ করানো কার্যত অসম্ভব (“এমডি এমএস-এর মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরির পরীক্ষার পাশ ফেলেও ‘নির্মল’ ছোঁয়া”, ২৪-৯-২০২১)। এই ঘটনায় তৃণমূল চিকিৎসক-বিধায়ক নির্মল মাজির নাম উঠে এসেছিল। মনে পড়ে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “যারা কুকর্ম করে, তাদের কিছু মানুষ চিহ্নিত করে, মানুষ তাদের ঘৃণা করে, মানুষ তাদের ভালবাসে না। আমিও তাদের ভালবাসি না” (‘যারা কুকর্ম করে, তাদের ভালবাসি না: মমতা’, ১৯-৫-২০২২)। অথচ নির্মল মাজির মতো অনেকের মাথায় কী করে ক্ষমতাসীনের হাত রয়েই যায়, বোঝা দায়। রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থা জুড়ে এমন অনেক চরিত্র রয়েছে। আর জি কর কাণ্ড একেবারে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে গেল। চোখ-কান বুজে চলাই যেখানে দস্তুর হয়ে উঠেছিল, সেখানে বহু মানুষ রাত জেগে রাস্তায় প্রতিবাদ আন্দোলন করছেন। এখন দেখতে হবে, এই সমাজটা ফিনিক্স-এর মতোই জেগে উঠতে পারে কি না।

সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া

দুর্নীতির আগুন

মেডিক্যাল কলেজগুলিতে দুর্নীতি, অনিয়ম, এবং স্বাস্থ্য দফতরের লাগামছাড়া বেআইনি কার্যকলাপের সূত্র ধরে ‘অন্তহীন কঙ্কালের স্তূপ’ পড়ে স্তম্ভিত হতে হয়! নিট পরীক্ষার সময় থেকেই দুর্নীতি শুরু। লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন জেনে নিয়ে পাশ করে কিছু ছাত্রছাত্রী, তার পর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর শুরু হয় আর এক প্রস্ত টাকার খেলা। সেখানেও পরীক্ষার আগেই মোটা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন পৌঁছে যাচ্ছে পরীক্ষার্থীদের একটা বড় অংশের কাছে। উত্তর ফোটোকপি করে খাতায় লিখে দিলেই হয়ে গেল ডাক্তারি পাশ! প্রতিবাদ করার সাহস কারও নেই। শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষকের চাকরিতেও একই ছবি। যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জাতির ভবিষ্যৎ, তা আজ রাজ্যে ভূলুণ্ঠিত। সমাজের সর্ব ক্ষেত্রে যে দুর্নীতি অন্যায় চলছে তার থেকে ডাক্তার, শিক্ষকরাই বা কেমন করে গা বাঁচিয়ে চলবেন? নগর পুড়লে দেবালয় কি রক্ষা পেতে পারে?

রতন চক্রবর্তী, উত্তর হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা

ঘুষ সংস্কৃতি

সোমা মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত খাঁটি কথা লিখেছেন— শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ-দুর্নীতি নিয়ে এত শোরগোল। স্বাস্থ্যের দুর্নীতি বাইরে এলে এমন চার-পাঁচটা নিয়োগ-দুর্নীতি চাপা পড়ে যাবে। এর হাতেনাতে প্রমাণ— এক জন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের কোটি কোটি টাকার প্রাসাদোপম বাগানবাড়ি, রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায়। নেতাদের এমবিবিএস পরীক্ষার সময় পরীক্ষা কেন্দ্রের সিসি ক্যামেরা বন্ধ রাখার নির্দেশ থাকত। সম্প্রতি রাজ্য শাসক দলের ‘অপসারিত’ এক মুখপাত্রও সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, কী ভাবে আর জি কর মেডিক্যালে প্রশ্নপত্র বিক্রি, নম্বর বাড়ানো ইত্যাদি হয়।

প্রতিবেদক লিখেছেন, স্বাস্থ্য দফতরে চিকিৎসক, অধ্যাপক, অধ্যক্ষ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত মানুষজনদেরও শাসক দলের ছাত্রনেতাদের নিয়মিত ‘ঘুষ’ দিতে হয়, না হলে প্রত্যন্ত জায়গায় বদলি করে দেবে। সেখানে হয়তো সেই বিশেষজ্ঞের নিজের চিকিৎসা-সংক্রান্ত বিভাগই নেই। অথবা ভুয়ো অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেওয়া হবে। ‘ছাত্র’-এর কাছে পদানত হয়ে থাকতে হয় প্রথিতযশা সরকারি চিকিৎসকদেরও। অনেকের স্মরণে আছে, ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার কয়েক দিন পরে ২৬ মে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রবীণ নিউরোসার্জন ডা. শ্যামাপদ গড়াই মহাশয়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তৎক্ষণাৎ দেখা না করার ‘ধৃষ্টতা’র ফল মিলতে দেরি হয়নি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনি সাসপেন্ড হয়ে যান। এমনকি তাঁর রেজিস্ট্রেশনও বাতিল করতে তৎপর হয় রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল। আমার প্রস্তাব, রাজ্যবাসী ‘রাত দখল’-এর মতো প্রতি বছর আর একটি অরাজনৈতিক ‘শহিদ দিবস’ পালন করে চিকিৎসা পরিষেবায় শৃঙ্খলা ও সততা আনুক।

নিকুঞ্জ বিহারী ঘড়াই, কলকাতা-৯৯

মেরুদণ্ডী

তিন কিস্তিতে সোমা মুখোপাধ্যায়ের তথ্যমূলক রিপোর্টগুলি (৮-৯, ৯-৯, ১০-৯) পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যব্যবস্থা তথা ডাক্তারি শিক্ষার ক্ষেত্রটির পচাগলা রূপ সামনে এনেছে। সন্দীপ ঘোষ প্রমুখ যাঁরা এই পাহাড়প্রমাণ অব্যবস্থা ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের যথোপযুক্ত শাস্তির দাবি যেমন প্রাসঙ্গিক, তেমনই প্রাসঙ্গিক আর একটি দাবি। ওই দুর্নীতি চক্রের হাত ধরে বহু পড়ুয়া প্রশ্ন ফাঁস, অবাধে টোকাটুকি, কলেজে না গিয়ে বা পাশ নম্বর পেয়েছেন, অনার্স পেয়েছেন, ডাক্তার হয়েছেন। এমন বহু ডাক্তার এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বেরিয়েছেন, যাঁরা হয়তো মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পর্যন্ত ভাল করে চেনেন না। তাই দাবি ওঠা উচিত ছিল, এই প্রশ্ন ফাঁস ও অবাধ টোকাটুকিতে যাঁরা লাভবান হয়েছেন, তাঁদের অবিলম্বে চিহ্নিত করে রেজিস্ট্রেশন ও ডিগ্রি বাতিল করা হোক। তবেই সে দিন যাঁরা বিনীত গোয়েলকে মেরুদণ্ড উপহার দিয়েছিলেন, তাঁদের জয় সম্পূর্ণ হবে।

ইন্দ্রনীল মণ্ডল, পঞ্চকুলা, হরিয়ানা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE