Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

লোকবিশ্বাস, ‘অম্বুবাচী’র পরে উর্বরা হন ধরিত্রী

অম্বুবাচী একটি ধর্মীয় আচার হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের আমাদের প্রাচীন কৃষি পদ্ধতি। আষাঢ় মাসের শুরুতে পৃথিবী যখন বর্ষার জলে সিক্ত হয়ে ওঠেন তখন তাঁকে ঋতুমতী বলে মনে করা হয়। এর পরই তিনি হয়ে ওঠেন শস্যশ্যামলা। লিখছেন পার্থসারথি রায়আষাঢ় মাসের প্রথম ছ’দিন চল্লিশ দণ্ডে মৃগশিরা নক্ষত্রের শেষ দুই পাদে সূর্যের ভোগ হয়। তার পরে যে তিন দিন বিশ দণ্ড পর্যন্ত সূর্য আর্দ্রা নক্ষত্রের প্রথম পাদে থাকেন, তা-ই অম্বুবাচী।

অসমের কামাখ্যা মন্দিরে অম্বুবাচী উদ্‌যাপন। ফাইল চিত্র

অসমের কামাখ্যা মন্দিরে অম্বুবাচী উদ্‌যাপন। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৯ ০১:২৫
Share: Save:

অনেক জাতিরই ধর্মীয় চেতনা মজ্জাগত। সেই ধর্মীয় চেতনার উপরে ভর করে গড়ে উঠেছে নানা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানও। তেমনই একটি আচার ‘অম্বুবাচী’। ‘অম্বুবাচী’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘অম্বু’ বা জল সূচনা। এ ছাড়াও বলা হয় ‘রজোযুকক্ষ্মাম্বুবাচী’। অর্থাৎ, পৃথিবীকে এই সময়ে ঋতুমতী হিসেবে কল্পনা করা হয়।

আষাঢ় মাসের প্রথম ছ’দিন চল্লিশ দণ্ডে মৃগশিরা নক্ষত্রের শেষ দুই পাদে সূর্যের ভোগ হয়। তার পরে যে তিন দিন বিশ দণ্ড পর্যন্ত সূর্য আর্দ্রা নক্ষত্রের প্রথম পাদে থাকেন, তা-ই অম্বুবাচী। সূর্যের দক্ষিণায়নের দিন থেকে তিন দিন অর্থাৎ, আষাঢ় মাসের ৭ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত দিনগুলিতে অম্বুবাচী পালন করা হয়। প্রবাদ আছে, ‘কীসের বার কীসের তিথি আষাঢ়ের ৭ তারিখ অম্বুবাচী’। জ্যোতিষশাস্ত্রেও বলা রয়েছে, সূর্য যে বারের যে সময়ে মিথুন রাশিতে গমন করে তার পরবর্তী সে বারের সে সময়ে অম্বুবাচী হয়। এই সময় থেকেই বর্ষার সূচনা।

অম্বুবাচী একটি ধর্মীয় আচার হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের আমাদের প্রাচীন কৃষি পদ্ধতিও। আষাঢ় মাসের শুরুতে পৃথিবী যখন বর্ষার জলে সিক্ত হয়ে ওঠে তখন তাকে ঋতুমতী বলে মনে করা হয়। আমরা জানি, মেয়েরা রজঃস্বলা হলেই সন্তান ধারণ করতে পারেন। বসুমতীকেও সেই রূপেই কল্পনা করা হয়। এই সময়ে তাঁকে তিন দিন বিশ্রাম দেওয়া হয়। চাষিরা ওই তিন দিন কোনও কৃষিকাজ করেন না। অম্বুবাচীর তিন দিন ধরিত্রীর ঋতুকাল ধরে নিয়ে চাষে বিরত থাকেন। তাঁরা মনে করেন, এই তিন দিন বর্ষার জলে সিক্ত হয়ে ধরিত্রী চাষের উপযোগী হয়ে উঠবে।

এ ক্ষেত্রে উর্বরতাকেন্দ্রিক ভাবনায় নারী এবং ধরিত্রী যেন সমার্থক হয়ে ওঠে। অম্বুবাচীর আগের দিনটিকে বলা হয় ‘অম্বুবাচী প্রবৃত্তি’। তিন দিনের পরের দিনটিকে বলা হয় ‘অম্বুবাচী নিবৃত্তি’। এর পরেই চাষিরা আবার চাষআবাদ শুরু করতে পারেন। দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের প্রায় প্রতিটি গ্রামে এই ধর্মীয় আচার আজও প্রচলিত। অম্বুবাচী উপলক্ষে দক্ষিণবঙ্গের অনেক গ্রামে মেলা বসে।

আমাদের সামাজিক জীবনেও এই ধর্মীয় আচারটির যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। যে তিন দিন অম্বুবাচী পালন করা হয় সেই দিনগুলিতে কোনও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান, যেমন, গৃহপ্রবেশ, বিবাহ, উপনয়ন ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয় না। শুধু তা-ই নয়, কিছু কাজ যেমন, বেদ পাঠ, ভূমি কর্ষণ, বীজ বপন, দেব-পিতৃ তর্পণও বন্ধ রাখা হয়। অম্বুবাচী উপলক্ষে গ্রামবাংলার বিধবা মহিলারা তিন দিন ধরে ব্রত রাখেন। অম্বুবাচীর আগের দিন তাঁরা তিন দিনের প্রয়োজনীয় খাবার রান্না করে রাখেন। এই সময় আগুনের আঁচে গরম করা কোনও খাবার তাঁরা খান না। তবে কোথাও কোথাও সূর্যের তাপে খাবার গরম করে নেওয়ার প্রথাও প্রচলিত আছে। আবার যাঁরা ব্রহ্মচর্য পালন করেন, তাঁরা এই সময়ে আমিষ খাবার খান না। বিভিন্ন ধরনের ফলমূল খেয়ে তাঁরা ব্রত উদ্‌যাপন করেন।

বাংলার পাশাপাশি অন্য প্রদেশেও ‘অম্বুবাচী ব্রত’ প্রচলিত রয়েছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাজ্য ওড়িশাতে এটি ‘রজ উৎসব’ নামে পালিত হয়। এই সময়ে কৃষকেরা ছুটি পালন করেন। মেয়েদের কৃষি ও গৃহকর্ম থেকে পুরোপুরি বিরত রাখা হয়। অম্বুবাচীর দিনগুলি তাঁদের কাছে বিশ্রামের দিন। এই সময়ে তাঁরা নতুন জামা-কাপড় পরেন। সিঁদুর-আলতায় সুসজ্জিত হন।

‘মিথুন সংক্রান্তি’ বা ‘রজ পর্ব’ নামে পরিচিত এই উৎসবও তিন দিন ধরে পালিত হয়। তিন দিনের প্রথম দিনটিকে বলা হয় ‘পহিলি রজো’। দ্বিতীয় দিন থেকে মিথুন মাস শুরু হয়। অর্থাৎ, বর্ষার প্রারম্ভ হয়। পুরাণ মতে, ভূদেবী এই সময় রজঃস্বলা হন। তৃতীয় দিনটি হল ‘ভূ দহ’ বা ‘বাসি রজো’। চতুর্থ দিনে বসুমতী স্নান। অর্থাৎ, ধরিত্রী মা বা ভূদেবীর স্নান। ভূদেবী হলেন জগন্নাথের স্ত্রী। পুরীর মন্দিরেও জগন্নাথের পাশে রূপোর ভূদেবীর মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়।

অম্বুবাচীকে কেন্দ্র করে প্রধান উৎসবটি হয় অসম রাজ্যের গুয়াহাটি শহরে। এখানে রয়েছে কামাখ্যা মন্দির। মন্দিরের গুহা আকৃতিবিশিষ্ট মাঝের কক্ষে কোনও মূর্তি নেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের বিশ্বাস, ফি বছরে এই সময়ে দেবী কামাখ্যা ঋতুমতী হন। তাই অম্বুবাচীর সময়ে তিন দিন মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে। এই সময় দেবী দর্শন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অম্বুবাচী নিবৃত্তির দিন দেবীর স্নান ও পূজা শেষ হওয়ার পরে দর্শনের অনুমতি মেলে। এই দিনই মন্দিরের পান্ডারা আগত ভক্তদের উদ্দেশে লাল বর্ম শোভিত বস্ত্র উপহার দেন। কথিত রয়েছে, এই লাল বস্ত্র ধারণ করলে ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ হয়। আবার এই দিন থেকেই মন্দিরের চারপাশে খোল-করতাল সহযোগে শুরু হয় কীর্তন। মেলার আকার নেয় কামাখ্যা মন্দির চত্বর।

লেখক বাঁকুড়ার শিক্ষক

অন্য বিষয়গুলি:

Ambubachi Agriculture Farming
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy