উদ্বাস্তু। ছিন্নমূল। শব্দ দুটো চোখ বন্ধ করে শুনলেই মনের মধ্যে কী কী ছবি ভেসে উঠতে পারে? দেশভাগ? দণ্ডকারণ্য বা মরিচঝাঁপি? সাম্প্রতিক কালে অসমের এনআরসি? এ বার সম্ভবত এই তালিকায় যুক্ত হল আর একটি উজ্জ্বল শব্দ: গণিত।
গণিতে নোবেল পুরস্কার হয় না। সর্বোচ্চ সম্মান হিসেবে সমগ্র পৃথিবীতে ফিল্ডস মেডেলকেই গণিতের নোবেল বলা হয়। ২০১৮ সালে এই পুরস্কার পেলেন কোচার বিরকার (ছবিতে), যিনি জাতিতে কুর্দ। কুর্দদের কোনও দেশ নেই। ইরান ইরাক তুরস্ক সিরিয়া জুড়ে কুর্দরা বরাবর নির্মম অত্যাচার ও জাতিনিধনের শিকার হয়ে এসেছে। কোচার বিরকার ইরান থেকে ২০০০ সালে ব্রিটেনে পালিয়ে আসেন। প্রার্থনা করেন রাজনৈতিক আশ্রয়ের। তার পর নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে পিএইচ ডি। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা। সংখ্যাতত্ত্বে দিগন্ত-উন্মোচনকারী গবেষণার জন্য ফিল্ডস মেডেল প্রাপ্তি। পুরস্কারের খবর পাওয়ার পর কোচার ফেসবুকে লিখেছেন ‘‘পুরস্কার আমি কুর্দ জনগণের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। আশা করব এই সংবাদ তাঁদের যন্ত্রণার কিঞ্চিৎ উপশমে সাহায্য করবে।’’
কোচার বিরকারের জন্ম ১৯৭৮ সালে ইরানের কুর্দ শহরের এক কৃষক পরিবারে। ছয় ভাইবোনের মধ্যে কোচার ছিলেন তৃতীয়। তাঁর জন্মের পরের বছরেই ইরানে আয়াতোল্লা খোমেইনির নেতৃত্বে ইসলামি অভ্যুত্থান ঘটে। ১৯৮০ সাল থেকে দীর্ঘ আট বছর ধরে চলে ইরাক-ইরান যুদ্ধ। ক্ষমতার পটবদল, জাতিবিদ্বেষ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দাঁড়িয়ে দেশহীন কুর্দরাও তীব্র করে তোলেন তাঁদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের দাবি। এ কথা সত্যি যে ইরাক বা তুরস্কে কুর্দদের যেমন নির্মম ভাবে অবদমিত করে রাখা হয়েছে, ইরানে সেটা ঘটেনি। কিন্তু জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে ইরান বরাবরই কঠোর। তাই রাষ্ট্রের দাবি তোলা সংগঠন কুর্দিশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের নির্বিচারে হত্যা করেছে খোমেইনি প্রশাসন। তার ওপর কোচারের শহর গত চল্লিশ বছর ধরেই অশান্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল। এর মধ্যে এক বাচ্চা ছেলে জীবনের ভালবাসা হিসেবে গ্রহণ করছে অঙ্ককে, এর থেকে বড় পরাবাস্তব আর কী?
কোচার উচ্চশিক্ষার জন্য তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। তাঁদের পরিবারেও তিনিই প্রথম কলেজের ডিগ্রিধারী। নিরক্ষর মা এবং বিদ্যালয়ের গণ্ডি ডিঙোতে না-পারা বাবার তত্ত্বাবধানে কোচার ও তাঁর ভাইবোনদের লেখাপড়ার শুরুটা হয় গ্রামের পাঠশালায়। গ্রামের লাইব্রেরি থেকে অঙ্কের বই ধার করে এনে জটিল সমস্যাগুলির সমাধান করতেন। এ ভাবেই স্কুলের নিচু ক্লাসে পড়ার সময়েই কলেজের অঙ্কের বইগুলো শেষ করে ফেলেন তিনি। তা হলে কলেজে গিয়ে কী করলেন? উত্তরটা সহজ। জটিল গাণিতিক সমস্যাগুলির নিজস্ব উপায়ে প্রমাণ আবিষ্কার করে একের পর এক গণিতের জার্নালে পাঠাতে থাকলেন। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া এবং তেহরানে থাকার খরচ মেটানোর জন্য নাকি খামারের অনেকগুলো ভেড়াকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন তাঁর বাবা। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়েই সংখ্যাতত্ত্বের প্রতি নিজের প্রেম আবিষ্কার করেন কোচার। ২০০০ সালে সারা পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলির গণিত ছাত্রদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হন তিনি।
তিনি বোঝেন, ইরানে থাকা দিন দিন অসম্ভব হয়ে উঠছে। একে তো উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়া সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। তার ওপর কুর্দ হিসেবে সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করার পর ব্রিটেনের হোম-অফিস কোচারকে নটিংহ্যামে পাঠায়। সেখানে তিনি শুরু করেন জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। অ্যালজেব্রাইক জিয়োমেট্রি নিয়ে গবেষণা। ২০১৬ সালে প্রকাশিত দু’টি পেপার তাঁর যুগান্তকারী কাজ, ফিল্ডস মেডেল-এর পিছনেও এই দু’টি পেপারই প্রধান।
নির্জনতাপ্রিয় গণিতবিদ ছোটবেলায় পড়াশোনার ফাঁকে চাষবাসের কাজে বাবাকে সাহায্য করতেন। কাজ থেকে ছুটি মিললে সারা ক্ষণ অঙ্ক নিয়ে ভাবতেন। এখনও তাঁর সিংহভাগ সময় শুধু ভাবনাতেই অতিবাহিত হয়। অনেকেই তাই বিশ্বাস করতেন না যে তিনি আদৌ কোনও কাজের কাজ করেন। কিছু বছর আগে তাইল্যান্ডে কোচার তাঁর শ্বশুরবাড়িতে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। কয়েক দিন পর শ্বশুর মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘হ্যাঁ রে, তোর বর কি সত্যিই কাজকর্ম করে? ওকে তো সারা ক্ষণ দেখি বাগানে বসে আমগাছটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে!” কোচার জানিয়েছেন, এই পুরস্কার সম্ভবত শ্বশুরমশাইকে আশ্বস্ত করবে, যাক, মেয়েটা অপাত্রে পড়েনি!
কেমব্রিজে কোচারের অফিসে রয়েছে হিটলারের নাৎসি জমানায় পালিয়ে বেড়ানো আর এক উদ্বাস্তু গণিতজ্ঞ আলেকজ়ান্ডার গ্রথেন্ডিয়েক-এর ছবি। তিনিও ফিল্ডস মেডেল পান। কোচার নিজের ছিন্নমূল সত্তাকে ভুলতে পারেননি, ভুলতে চাননি।
ভুলতে যে চাননি, তার প্রমাণ তাঁর নাম। এই গণিতবিদের আসল নাম কোচার বিরকার নয়, ফেরায়াদুন দেরাখশানি। ব্রিটেনের হোম অফিসে আবেদন করার সময়ে, নিজের নাম পাল্টে কোচার বিরকার রাখেন। কুর্দিশ নামটির বাংলা অনুবাদ করলে অর্থ দাঁড়ায়— উদ্বাস্তু গণিতবিদ!
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy