প্রথম ঘটনাটি কিছু দিন আগের। কৃষ্ণনগর শহরে আইন অমান্য কর্মসূচি ছিল একটি রাজনৈতিক দলের। তার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন দুই পুলিশকর্মী। হঠাৎ চোখে পড়ে একটি ছোট্ট কুকুরের বাচ্চা পায়ে আঘাত নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসছে তাদের দিকেই। বাচ্চাটিকে ধরে পায়ে ফেট্টি বেঁধে নিজেদের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য রাখা ওষুধ বাচ্চাটির পায়ে লাগিয়ে দেন ওই দুই পুলিশকর্মী।
আর দ্বিতীয় ঘটনাটি অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া শিয়ালদহ নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের। মাস দেড়েকের ষোলোটি কুকুরছানাকে পিটিয়ে মেরে, হসপিটালের বর্জ্য ফেলার প্যাকেটে ভরে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেওয়া হল। একটি বড় কুকুরকেও মেরে চোখ উপড়ে নেওয়া হল একই সঙ্গে। আহত আরও একটি বাচ্চা কুকুর।
দু’টি ঘটনারই দু’দিকে ছিল দুই ধরনের মানুষ আর মধ্যিখানে ছোট্ট কুকুরছানা। মানুষগুলোর মানসিকতা বড্ড বেশি আলাদা হলেও বাচ্চাগুলো কিন্তু ছিল একই রকম নরম আর আদুরে। কৃষ্ণনগরের ছোট্ট বাচ্চাটা ভালবাসার স্পর্শ বুঝিয়ে দিয়েছিল ল্যাজ নাড়িয়ে পুলিশকর্মীর নাকটা ছোট্ট জিভ দিয়ে চেটে। উল্টোদিকে, কলকাতার কুকুর শিশুগুলোকে নাকি খাবারের লোভ দেখিয়ে ডেকে এনে পিটিয়ে মারা হয়েছে, এমনটাই শোনা যাচ্ছ। বাচ্চাগুলো ভালবেসে খিদের টানে খেতে এসেছিল ঘাতকের কাছে। শিশুগুলো জানতেই পারল না কি তাদের অপরাধ! কেন তাদের মরতে হলো এমন করে!
ছোট্ট কুকুর বাচ্চাগুলোর অপরাধ ঠিক কী ছিল, বুঝতে পারছেন না সাধারণ মানুষও। বাচ্চাগুলোকে পিটিয়ে মারল যে অপরাধীরা, তাদের কঠিন শাস্তির দাবিতে জোরালো আন্দোলন চলছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে। থানার সামনে। শহরের পথে। ভাইরাল হয়েছে পিটিয়ে মারার ভিডিয়ো। খবর হয়েছে কাগজের প্রথম পাতায়। শেষ পর্যন্ত পিটিয়ে মারার অভিযোগে গ্রেফতারও হয়েছেন দুই নার্সিং পড়ুয়া। কিন্তু এত ঘটনার কিছুই জানতে পারল না নিথর হয়ে যাওয়া ষোলোটি প্রাণ। তারা তো কখনও প্রথম পাতার খবর হতে চায়নি। বরং তারা চেয়েছিল একটু খাবার, একটু আদর। তারা এটাও জানতে পারল না, এত মানুষের ভালবাসা আছে তাদের সঙ্গে। এত মানুষ চোখের জল ফেলছেন তাদেরই জন্য।
শীতের এই সময়টায় গ্রাম গঞ্জের বিচালির গাদায়, বা মফস্সলের চায়ের দোকানে সকালের মিঠে রোদ তো থাকে তাদেরই দখলে। সেই ছোট্ট তারা, যারা মায়ের পিছনে পিছনে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে ছোটে। আসে পাঁচ-সাত জন মিলে। বড্ড তুলতুলে। বড্ড বেশি আদরেরও। ছুঁড়ে দেওয়া বিস্কুট নিয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই করে। ছোট গলায় ছোট্ট অভিমানের সুর। সবটাই তো ওদের নিজস্ব, বড্ড বেশি শিশুসুলভ।
তাই চায়ের আড্ডায় যখন এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কুকুরের বাচ্চা মারা নিয়ে তর্ক তুঙ্গে, ঠিক তখনই পায়ের কাছে এসে ছোট্ট ল্যাজ নেড়ে বিস্কুটের আবদার করে কুচকুচে কালো বাচ্চাটা। ইস্, ও যদি বুঝত কী নিয়ে আলোচনা চলছে, তখন কেমন লাগত তার? হয়তো বুঝলেও ল্যাজ নাড়াত। এরা তো মানুষের কাছে চায় একটু ভালবাসা, একটু নিরাপত্তা, বড় জোর একটা বিস্কুট। এর বেশি কিছু না।
জন্মের পর থেকেই তো বাঁচার লড়াই এই সব পথকুকুর শিশুদের। এদের জন্মটাই যে কনকনে শীতে। রুগ্ণ মা কোনওমতে সন্তানদের কোলের মধ্যে নিয়ে কোনও এক নিরাপদ কোণ খুঁজে শরীরটাকে গুটিয়ে রাত কাটায় একটা রোদ মাখা সকালের অপেক্ষায়। গ্রামে শিয়ালের আক্রমণে আর শহরে বেপরোয়া বাইকের বা গাড়ির চাকার নীচে চাপা পড়ে প্রায়ই মারা যায় অনেক কুকুর বাচ্চা। এটাই তো ভাগ্য এই সব অবলা প্রাণীদের। মায়ের কোল খালি হয়ে যায়। গভীর রাতে সন্তানহারা মায়ের সেই কান্না যাঁরা শুনেছেন, তাঁরাই অনুভব করতে পারবেন কুকুর মায়ের কষ্ট। অনেকে আবার সেই কান্নাকে অলক্ষুণে ভেবে শীতের রাতে ঠান্ডা জল ঢেলে দেন সন্তানহারা মায়ের গায়ে। এমনটাও ঘটে। অপুষ্টি আর কৃমি তো আছেই, তার উপর এই সময়ে পারভো নামে এক ভাইরাসঘটিত রোগ হয় বাচ্চা কুকুরের। তাতেও মারা যায় অনেক পথকুকুর শিশু। এ ছাড়া বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, জেলা প্রশাসন বা পুরসভা থেকেও মাঝে মাঝে কুকুরদের নির্বীজকরণ প্রকল্প নেওয়া হয়। তাতেও কিছুটা জন্ম নিয়ন্ত্রণ হয় এদের। গত বছর কৃষ্ণনগর পুরসভা আর জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে হয়ে গেল কুকুরদের নির্বীজকরণ কর্মসূচি। পোস্টঅফিস মোড়ের সবার আদরের বুড়িও সে দিন ছিল সেই দলে। আজ সে সন্তানধারণে অক্ষম। এ বছর শীতে দেখা গেল, রোদে পিঠ দিয়ে ল্যাজ নেড়ে অন্যের বাচ্চা সামলাচ্ছে সে।
এত কিছুর শেষে যে ক’টি বাচ্চা বেঁচে থাকে, তাদের ভাগ্যে থাকে কিছু আদর আর কিছুটা বঞ্চনা। গ্রাম আর মফস্সল শহরগুলোতে যা-ও বা মাঠ-ঘাট, ফাঁকা জায়গা আছে এদের থাকার জন্য, বড় বড় শহরের বেশির ভাগ ঝাঁ-চকচকে আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাট বাড়ির ত্রিসীমানায় তো এদের প্রবেশ নাস্তি। বাড়িগুলো পাছে নোংরা হয়, রোগ ছড়ায়, তাই এদের ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই। এখানে যাঁরা বাস করেন, তাঁদের অনেকের কাছেই এরা নোংরা জীব। কুকুর মানেই জলাতঙ্ক। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। কিন্তু সেই প্রতিবাদ তো চাপা পড়ে যায় বিরোধীদের ভিড়ে। তা হলে কোথায় যাবে এরা? থাকবে কোথায়? ক’জন ভাবেন সেই কথা? না ভাবুন, ক্ষতি নেই। অপছন্দ ব্যক্তিগত ব্যপার। অনেকে বলতেই পারেন হসপিটাল চত্বরে কুকুর থাকবে কেন? ঠিক কথা। অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা এদের দায়িত্ব নিতেন সানন্দে। তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া যেত অনায়াসে। তা বলে হত্যা? সেটা মানা যায় না। মেনেও নেননি কেউ। প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। হয়তো এই ষোলোটি নিষ্পাপ প্রাণের বিনিময়ে কিছুটা সহানুভূতি আর নিরাপত্তা মিলবে বাকিদের। নাকি সবটাই কয়েক দিনের জন্য? দু’দিন পরে অন্য কোনও বড় ঘটনা ভুলিয়ে দেবে সব কিছু। সবাই মুখ ফিরিয়ে নেবেন ক’দিন পরেই? না কি লড়াই চলবে? এখন সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy