—ফাইল চিত্র।
সম্প্রতি কেশবানন্দ ভারতীর জীবনাবসান ঘটিয়াছে। তিনি ছিলেন কেরলের একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সন্ন্যাসী, দীর্ঘ দিন তাহার কর্ণধারও। কিন্তু ইতিহাস তাঁহাকে মনে রাখিবে স্বাধীন ভারতের শাসনতন্ত্রে এক সুদূরপ্রসারী সংস্কারের অনুঘটক হিসাবে। কেরল সরকারের একটি আইনকে তিনি আদালতে সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে চ্যালেঞ্জ জানাইয়াছিলেন। ১৯৭৩ সালে সেই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের তেরো জন বিচারপতির বেঞ্চ যে রায় দেয়, তাহাতে তাঁহার অভিযোগটি নাকচ হয়, কিন্তু সেই রায়ে সর্বোচ্চ আদালত এমন একটি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে, যাহাকে যুগান্তকারী বলিলে অত্যুক্তি হয় না। সুপ্রিম কোর্ট বলিয়াছিল, যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদ তথা আইনসভা সংবিধান সংশোধন করিতে পারে, কিন্তু সংবিধানের ‘মূল চরিত্র’ সংশোধনের অধিকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরও নাই, তাহা অলঙ্ঘ্য। মূল চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কোন কোন বিষয় পড়ে, তাহার কোনও তালিকা বিচারপতিরা বলিয়া দেন নাই, স্পষ্টতই তাঁহারা বাস্তব পরিস্থিতির সাপেক্ষে তাহা নির্ধারণের ভার ভবিষ্যতের বিচারপতিদের হাতেই ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু সংসদে যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকিলেই শাসকরা সংবিধান লইয়া যাহা খুশি করিতে পারেন— এই আশঙ্কা সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের ফলে প্রতিহত হয়। সেখানেই প্রায় অর্ধ শতাব্দী পূর্বের কেশবানন্দ ভারতী মামলার ঐতিহাসিক গুরুত্ব।
সেই গুরুত্ব কতখানি, এই অর্ধ শতাব্দীতে তাহা বারংবার প্রমাণিত হইয়াছে। নির্দিষ্ট মামলার সূত্রে তো বটেই, বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতেও। যেমন, দুই দশক আগে অটলবিহারী বাজপেয়ীর এনডিএ সরকার সংবিধান পর্যালোচনার কথা তুলিলে যে বিতর্কের সূত্রপাত হয় সেখানে একটি বড় প্রশ্ন ছিল: সরকারের এই প্রস্তাব সংবিধানের মূল কাঠামো বদলাইয়া দিবার ছল নহে তো? নরেন্দ্র মোদীর জমানায় সেই প্রশ্নের ছায়া ইতিমধ্যেই ঘনঘোর, এবং ক্রমশই তাহা ঘোরতর হইতেছে। এই শাসকরা গণতন্ত্রকে মুখ্যত সংখ্যাগুরুর শাসন হিসাবেই দেখেন, সে-কথা তাঁহারা নিজেরাও জোরগলায় প্রচার করিয়া থাকেন। সংখ্যার জোর থাকিলে স্বাভাবিক ন্যায় ও নীতির অনুজ্ঞা কত অনায়াসে লঙ্ঘন করা যায়, তাহা শুধুমাত্র ৩৭০ ধারা বিলোপের অভিজ্ঞতাই দেখাইয়া দিয়াছে। এই স্বেচ্ছাচারী সংখ্যাগুরুবাদ সংবিধানের মূল চরিত্রকে বিনাশ করিতে তৎপর হইবে না, এমন নিশ্চয়তা নাই।
সেই দুর্লক্ষণ ইতিমধ্যেই প্রকট। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ধর্মনিরপেক্ষতার উল্লেখ কেন থাকিবে, শাসক গোষ্ঠীর অন্দরমহল হইতে সেই প্রশ্ন তোলা হইয়াছে। এই প্রশ্নে হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের যে লক্ষ্য নিহিত, তাহা ভারতীয় সংবিধান তথা প্রজাতন্ত্রের পক্ষে, আক্ষরিক অর্থে, মর্মান্তিক। এমন যুক্তিও সঙ্ঘ পরিবারের নানা মহল হইতে ভাসিয়া আসিতেছে যে, সংবিধানের প্রস্তাবনায় প্রজাতন্ত্রের বিশেষণ হিসাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দ দুইটি আদিতে ছিল না, সত্তরের দশকে তাহা সংযোজিত হয়, সুতরাং তাহারা ‘মূল কাঠামো’র অন্তর্গত নহে— তবে তাহাদের বিতাড়নেই বা আপত্তি কিসের? বিশেষণ দুইটির ভূমিকা ও গুরুত্ব সমান নহে— সমাজতান্ত্রিকতা লইয়া প্রশ্ন থাকিতেই পারে, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা যে ভারতীয় শাসনতন্ত্রের মৌলিক ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, সেই বিষয়ে প্রশ্ন তুলিলে এই প্রজাতন্ত্রের স্বধর্মকেই অস্বীকার করা হয়। বর্তমান শাসকরা ঠিক তাহাই করিতে ব্যগ্র। নির্বাচনী সংখ্যাগরিষ্ঠতা সেই অভিসন্ধি পূরণের সহায় হইলে গণতন্ত্রের বহিরঙ্গ বজায় থাকিবে, অন্তরাত্মা বিনষ্ট হইবে। শাসকের আধিপত্যবাদে ভোটতন্ত্র গণতন্ত্রের ঘাতক হইয়া উঠিতে পারে বলিয়াই তাহার রক্ষাকবচ হিসাবে বিচারবিভাগের ভূমিকা অপরিহার্য। সংবিধানের মূল কাঠামোর ধারণাটিও সেই কারণেই মূল্যবান। ১৯৭৩ সাল অপেক্ষা আজ মূল্য কম নহে, বহুগুণ বেশি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy