বছর দু’এক আগে শ্রীনগরে হুরিয়ত নেতা সৈয়দ আলি শাহ গিলানি ওঁর বাসভবনে আমাকে বলেছিলেন, বিজেপির সমর্থন নিয়ে মেহবুবা মুফতি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ায় সবচেয়ে বেশি বিপদ হল তাঁরই। কাশ্মীরিদের বিচ্ছিন্নতা এতে আরও বাড়বে। আমি বলেছিলাম, পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম ক্ষমতায় আসায় কমিউনিস্টদের বিপ্লবীয়ানা শুধু শেষ হয়েছিল তা নয়, পশ্চিমবঙ্গে তাদের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতাই শেষ হয়ে গিয়েছিল। গিলানি তখন গৃহবন্দি ছিলেন। আজও একই অবস্থা।
এর মধ্যে কাঠুয়ার ধর্ষণ মেহবুবার রাজনৈতিক সঙ্কটকে আরও তীব্র করে দিয়েছে। শ্রীনগর শুধু নয়, এ বার ছায়া ঘনিয়েছে জম্মুতেও।
জম্মুর রাস্তায় মানুষ প্রতিবাদে মুখর হলে মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে তাঁর কুর্সি বাঁচানো বড় কঠিন। শেখ আবদুল্লার মতো মানুষও তাঁর মুখ্যমন্ত্রীর পদ বাঁচাতে পারেননি। ১৯৫৩ সালে প্রজা পরিষদের বিদ্রোহে ক্রুদ্ধ জম্মু তাঁকেও সরে যেতে বাধ্য করেছিল। ১৯৮৪ সালে যখন তাঁর পুত্র ফারুক আবদুল্লাকে জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে মানুষ সরিয়ে দিল তখন সে দিন প্রথম আগুন লেগেছিল এই জম্মুতেই। বিদ্রোহের আগুন। ২০০৮ সালে গুলাম নবি আজাদ বিদায় নিলেন। অমরনাথ জমি বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন তিনি। সেই আন্দোলনের গোড়াও ছিল জম্মুতে। পিরপঞ্জাল পর্বতশ্রেণি শ্রীনগর আর জম্মুর মধ্যে বিভাজনের রেখা টেনে দেয়। আর সাধারণ ভাবে আমাদের মনে হয়, হরতাল-ধর্মঘট-সন্ত্রাস— সবই শ্রীনগর উপত্যকায়। আসলে কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়েও জম্মু এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। জম্মু আর কাশ্মীর দুই পৃথক এলাকা, তার মানে কি পৃথক ধর্মীয় মেরুকরণ, পৃথক জাতিসত্তা? তা-ও তো আমরা জম্মু-কাশ্মীর যখন একসঙ্গে উচ্চারণ করি, তখন লাদাখের কথা ভুলেই যাই।
জম্মুর কথায় ফিরে আসি। ১৮৪৬ থেকে ১৯৪৭, জম্মুর ডোগরা রাজাদের শাসনকাল এই দীর্ঘ সময়ে। শেখ আবদুল্লা যখন কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করেন, তখন জম্মুর মানুষের ধারণা হয়, আসলে এই আন্দোলন ডোগরা হিন্দু রাজাদের সরানোর জন্য। জম্মুতে শতকরা ৬৪ ভাগ হিন্দু। চেনাব উপত্যকা এবং পিরপঞ্জাল পার্বত্যভূমি অবশ্য মুসলিমপ্রধান। শতকরা ২৯ ভাগ মুসলিম, শতকরা ২৩ ভাগ ব্রাহ্মণ, ২০ ভাগ তফসিলি জাতি, ১২ ভাগ রাজপুত, ৭ ভাগ শিখ এবং অন্যান্যরা ৯ শতাংশ। মুফতি মহম্মদ সইদ যখন কংগ্রেস ও জাতীয় কনফারেন্সের প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে সরকার গঠনের জন্য বিজেপির সঙ্গে জোট বাঁধলেন, তখন অনেকে প্রমাদ গুনেছিলেন। ২০১৫ সালে পিডিপি-বিজেপি জোটের সরকার গঠনের পর এক সাক্ষাৎকারে সইদ সাহেব বলেছিলেন, ‘‘আপনার মনে হচ্ছে তো উত্তর আর দক্ষিণ মেরু কী ভাবে মেলাব? কিন্তু এটাই কাশ্মীর রাজনীতির পক্ষে খুব ভাল। প্রয়োজনীয়।’’ বিজেপি কাশ্মীরি ও কাশ্মীরিয়তকে সম্মান জানানোর এক রাজনৈতিক সুযোগ পেয়েছিল। ২০১৪ সালে জম্মুতে বিজেপি দারুণ ফল দেখায়। এমনকি, চেনাব উপত্যকাতেও বিজেপি ভাল ফল করে। কংগ্রেস ও জাতীয় কনফারেন্সের সঙ্গে বোঝাপড়া হলে জম্মুর ভোটারদের যথেষ্ট ক্ষমতায়ন হবে না বলে মুফতি ভেবেছিলেন। বরং তাতে জম্মুর মানুষ আরও বিচ্ছিন্ন হত। ২০১৫ সালে কাশ্মীরে পিডিপি এবং বিজেপির বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে সইদ মুফতি সাহেবের এ যুক্তি শুনতে খুবই ভাল লেগেছিল। কিন্তু পাল্টা যুক্তি হল, রাজ্যে ধর্মনিরপেক্ষ অন্য দলগুলিকে পিডিপি সে দিন অক্সিজেন দিতে চায়নি।
কিন্তু এর পরিণতি কী হল? কাশ্মীর উপত্যকায় জঙ্গি কার্যকলাপ বাড়তে লাগল আর জম্মুতে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতারও গগনভেদী রব শোনা যেতে লাগল। এ বার কাঠুয়ায় যে নাবালিকার উপর গণধর্ষণ হল, এখন দেখা যাচ্ছে, এ তো শুধু গণধর্ষণের ঘটনা নয়, এই গণধর্ষণকে ধর্মীয় মেরুকরণ, জনজাতির সত্তা বা পরিচিতি এবং জম্মু বনাম কাশ্মীর রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে। মেয়েটি গুজ্জর জনজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত। কাশ্মীরে এই গুজ্জররা মূলত মুসলমান। গুজ্জর-বকরওয়াল যাযাবর জনজাতি।
অরণ্য অধিকার আইন ২০০৬ সালে সংসদে গৃহীত হয়। অদ্ভুত ব্যাপার, জম্মু-কাশ্মীরে আজও এটি বাস্তবায়িত হয়নি। এই নোমাডিক জনজাতি দুগ্ধ প্রদানকারী পশুদের পালন করেন। গ্রীষ্মে তাঁরা কাশ্মীরে চলে যান আর শীতে জম্মুতে ফিরে আসেন। মূলত অরণ্যেই থাকেন তাঁরা। কিন্তু অরণ্য আইন কার্যকর না হওয়ায় এই জনজাতিদের কোনও অধিকার এই অরণ্যের জমিতে নেই। গোটা রাজ্যের জনসংখ্যায় এই গুজ্জর তফসিলি মুসলমানরা আছেন শতকরা ১১ ভাগ। অরণ্যের অধিকার আইন বাস্তবায়িত করার দাবিতে এই জনজাতি আন্দোলন চলছে অনেক দিন থেকেই। এখন এই গণধর্ষণের পর তাঁরা, মানে এই সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, এই ঘটনা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, মুসলিম-জনজাতি-দলিত বিরোধী। আবার জম্মুর হিন্দু সংগঠন, বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার বলতে শুরু করেছে, শ্রীনগর থেকে বহু মুসলিম জম্মুতে এসে বসবাস করতে শুরু করেছেন। এর মধ্যেও আছে গভীর ষড়যন্ত্র। জম্মুর জনসংখ্যার ধর্মীয় চরিত্র বদলানোর চেষ্টা হচ্ছে। তার মানে কাঠুয়ার ঘটনা জম্মু-কাশ্মীরে ধর্মীয় মেরুকরণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কংগ্রেস ও জাতীয় কনফারেন্সের মতো দলগুলিও ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করতে গিয়ে জম্মুতে জম্মুর মতো, কাশ্মীরে কাশ্মীরের মতো আবরণ অনুসরণ করছে। কিন্তু সে তো আরও ভয়ঙ্কর।
আসলে জম্মু ও কাশ্মীরের এই বিবাদ ঘোচানো আজ খুব জরুরি। কার্গিল ও লেহ্-তে আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীর, দু’পক্ষকে নিয়ে এখনই যুগ্ম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা প্রয়োজন। এমনকি, অরণ্যবাসী জনজাতি তফসিলি মানুষের জন্য এ রকম পরিষদ প্রয়োজন। তা না হলে শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর হবে।
যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশ ভারত। নানা রাজ্যে নানা আঞ্চলিক সত্তা। এই বিভিন্নতার সমন্বয় অখণ্ড ভারত গঠনের জন্য জরুরি। কিন্তু কাশ্মীরের সমস্যাটি নিছক আর পাঁচটা রাজ্যের মতো যুক্তরাষ্ট্রীয় সমস্যা নয়। দেশভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান নামক পৃথক রাষ্ট্রগঠনের সঙ্গে কাশ্মীরের স্বাধিকারের প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে। অন্য সব রাজ্যে পাঁচ বছর, কাশ্মীরে বিধানসভার মেয়াদ ছ’বছর। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের সংঘাত যখন চরমে। সীমান্ত যখন উত্তাল তখন বোধ হয় এই উপত্যকায় ক্ষুদ্র রাজনীতির ফসল তোলার জন্য মেরুকরণের কৌশল থেকে বিরত থাকার প্রয়োজনীয়তা বোধ হয় অখণ্ড রাষ্ট্রের স্থায়িত্বের জন্যই বেশি প্রয়োজন। আর যা-ই হোক, জম্মু-কাশ্মীরের বিভাজন আম ভারতবাসীর পক্ষেও আনন্দ সংবাদ নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy