প্রতিবাদ: জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি-বৃদ্ধির প্রতিবাদে মানব-বন্ধনে শামিল এক ছাত্রী। রয়টার্স
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ফি-বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ছাত্রআন্দোলন দেখলাম এক দিকে। আর এক দিকে দেখলাম— পশ্চিমবঙ্গের পার্শ্ব শিক্ষকরা বেতনের দাবিতে অনশন করছেন। দুটো আন্দোলনই শিক্ষাসংক্রান্ত; এর বাড়া দুই ঘটনার কোনও যোগ আছে কি?
জেএনইউ আন্দোলনের যে মৌলিক যুক্তি, তাতে আমার সম্পূর্ণ সায় আছে; তবে বিষয়টা একটু ব্যাপক ভাবে দেখা দরকার। দশকের পর দশক এক পয়সা ফি বাড়বে না, তা কি সম্ভব? পরের প্রশ্ন: জেএনইউ-এ বছরে কয়েকশো গরিব ছাত্র আসে। তাদের কি সমান সুবিধা প্রাপ্য নয়? চূড়ান্ত প্রশ্ন: তারও বহু গুণ ছেলেমেয়ে প্রাথমিকেরও গণ্ডি পেরোয় না, নিরক্ষরতা অর্ধাহার বাল্যবিবাহ শিশুশ্রম মায় দাসপ্রথার শিকার হয়; তাদের কী হবে?
এখানেই পার্শ্ব শিক্ষকদের প্রসঙ্গ ওঠে। তবে প্রথমে জেএনইউ আন্দোলনের তাৎপর্য বোঝা দরকার। ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় আজ আমূল রূপান্তর ঘটছে। স্বাধীনতার পর অর্ধশতক অশেষ ব্যর্থতা ও স্খলন সত্ত্বেও প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা, প্রত্যেক স্তরে নীতিগত ভাবে প্রতিটি ভাবী নাগরিকের সুষ্ঠু শিক্ষার অধিকার স্বীকৃত ছিল (যদিও ২০০৯ পর্যন্ত আইনি মান্যতা ছিল না)। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার স্তরে, আগের স্কুলজীবন ও পরবর্তী কর্মক্ষেত্রের তীব্র অসাম্যের মাঝখানে ভারতের যুবসমাজ পেয়েছিল একটা সমতল পরিসর, যেখানে ধনী-দরিদ্র শহর-গ্রামের ব্যবধান অনেকটা মুছে সকলে এক বিদ্যা, এক পরিষেবা লাভ করেছে, বৌদ্ধিক বিচরণের অবাধ ক্ষেত্রের এক ঝলক হদিস পেয়েছে। এই মানসিক বিস্তারের প্রচুর অপব্যবহার ঘটেছে হয়তো; কিন্তু প্রাপ্তিও কম হয়নি। আমাদের ছাত্ররা পরবর্তী জীবনে দুনিয়াভর সফল হয়েছে। যারা দেশে থেকে গিয়েছে বা ফিরে এসেছে, তাদের অনেকে এবং অন্তত কিছু প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে।
আবার বলছি, এই ব্যবস্থায় অশেষ ত্রুটি ও অনাচার ছিল; কিন্তু সবচেয়ে চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়াল তার জেল্লার অভাব, নব্য বিশ্বায়নের নিরিখে চটজলদি চোখে-পড়া খামতিগুলো। সংস্কারের বদলে, আপন সন্তানদের দুধেভাতে রাখার তাগিদে সচ্ছল শিক্ষাভোগী শ্রেণি (অবশ্যই শাসক শ্রেণিও বটে) ঠিক করল, ব্যবস্থাটা এলেবেলে করে দিলেই মঙ্গল। তার বদলে যে নতুন ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে তা অত্যন্ত মহার্ঘ, অধিকাংশ ভারতসন্তানের নাগালের বাইরে। তার চেয়েও বড় সমস্যা কিন্তু সারস্বত। হাতে-গোনা এমন প্রতিষ্ঠানে সম্পন্ন ঘরের কিছু মেধাবী ছাত্র-শিক্ষক সাফল্য লাভ করবে: আগামী দিনে সেটাই হয়তো হবে ভারতীয় বিদ্যাচর্চার শিখর। কিন্তু বাকি বিপুল সংখ্যক ছাত্রদের এই পরিমণ্ডলের বাইরে রেখে দেশের মেধাসম্পদের চূড়ান্ত অপচয় হচ্ছে। সম্পন্ন শ্রেণির বাকিদের, ও অন্যদের ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে এক সীমিত প্রশিক্ষণ। ভাবনা চিন্তা গবেষণা আদৌ তার অঙ্গ নয়, প্রথাভাঙা চিন্তা তো নয়ই। জেএনইউ আন্দোলনকারীরা এই আত্মঘাতী পরিকল্পনা সম্বন্ধে আমাদের সচেতন করেছে; তাদের অভিনন্দন প্রাপ্য।
প্রায়ই শুনি, ভারতের জনরাশিতে লুকিয়ে আছে একটা আস্ত কানাডা বা অস্ট্রেলিয়া, অর্থাৎ সমসংখ্যক শিক্ষিত উচ্চবিত্ত মানুষ। এরা ফ্ল্যাট গাড়ি ফ্রিজ টিভির অভীষ্ট ক্রেতা। নতুন ব্র্যান্ডের শিক্ষারও উপভোক্তা কেন নয়? অন্যান্য ভোগ্যবস্তুর মতো, তার নিরেস সুলভ সংস্করণ সরবরাহ হয় সমাজের কয়েক ধাপ নীচ পর্যন্ত— বলা চলে সেই গুপ্ত অস্ট্রেলিয়ার উপনিবেশগুলিতে। ভারত জুড়ে এমন পন্থা না-ও খাটতে পারে।
অতএব পার্শ্ব শিক্ষকদের প্রসঙ্গ আসে সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষত স্কুলব্যবস্থার, ইঙ্গিত হিসেবে। স্বাধীন ভারতে উচ্চশিক্ষার চেয়ে স্কুল স্তরে অসাম্যের অনুপ্রবেশ অনেক ব্যাপক। হঠাৎ স্কুলব্যবস্থার ইতিহাস দেখলে কিন্তু মনে হবে যেন উচ্চশিক্ষার বিপরীত ধারা: আগে ছিল নিঃসম্বল, ক্রমে নানা সূত্রে টাকা এসেছে, পরিকল্পনা হয়েছে। শিক্ষাদানের সঙ্গে যোগ হয়েছে পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কিছু পদক্ষেপ: খুদেদের জন্য অঙ্গনওয়াড়ি, তার পর মিড-ডে মিল। প্রাথমিকে ভর্তি এত দিনে প্রায় ১০০%, স্কুলছুটের হার যদিও ভয়াবহ। মেয়েদের আর পিছিয়ে-পড়া গোষ্ঠীর উপস্থিতি অসমান ভাবে হলেও বেড়েছে; বরং ছেলেদের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে কাজে লাগাবার নতুন প্রবণতা হয়েছে, যা শিক্ষাব্যবস্থা ও অর্থব্যবস্থা সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের তীব্র হতাশার প্রতিফলন।
অনেক কিছুই হয়েছে; কিন্তু সবই যেন ক্ষমাঘেন্না করে, অর্থবরাদ্দে রাশ টেনে, পরিচালনা ও শিক্ষক নিয়োগে চুটিয়ে রাজনীতি করে, ‘এই ঢের, গরিবের আর কী চাই’ মানসিকতা নিয়ে। দু’একটি রাজ্য ব্যতিক্রম, যেমন কেরল বা (কিছু ত্রুটি সত্ত্বেও) তামিলনাড়ু। সম্প্রতি ভাল কাজ হয়েছে দিল্লি রাজ্যে, এবং খানিক আধাখেঁচড়া হুজুগে ঢঙে পশ্চিমবঙ্গে।
সর্বভারতীয় চিত্র কিন্তু বেশি পাল্টায়নি। সবচেয়ে নিরাশ করে শিক্ষক নিয়োগ ও বেতনব্যবস্থা (অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের কথা বাদ দিলাম)। স্কুলশিক্ষক (ও সমান তালে কলেজ শিক্ষক) নিয়োগ হচ্ছেন আধা-সিকি-চোদ্দো-আনা নানা ফর্মুলায়। নিয়োগপদ্ধতিতে ইচ্ছা করে ফাঁক রেখে দেওয়া হয়, যাতে কম বেতন ও সুবিধার বিনিময়ে কার্যত পূর্ণ সময়ের কাজ আদায় করা যায়। স্কুলও হরেক কিসিমের, এ রাজ্যে সরকারের চার দফতরের মধ্যে বণ্টন করা। এ সব নিয়ে যেটুকু প্রতিবাদ হয় তা শিক্ষকদের বঞ্চনার বিরুদ্ধে। এই ব্যবস্থায় ছাত্রেরা যে উপযুক্ত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সে অভিযোগ কখনও কেউ তুলেছে শুনিনি। অথচ মিড-ডে মিলের দুধে জল মেশানোর চেয়ে এ কি কম অপরাধ?
এখানেই জেএনইউ আর পার্শ্ব শিক্ষকদের আন্দোলন এক সুতোয় গাঁথা। সমাজ ও প্রশাসনের বিধান: বঞ্চিত শ্রেণির মানুষ বঞ্চিত থেকে যাবে, তাদের পরিষেবা দেবে তাদের মধ্য থেকেই উঠে আসা কেউ কেউ। তাদের নিয়োগের উদ্দেশ্য হবে সত্যিকারের জনসেবা নয়, মুখ বন্ধ করার জন্য যা হোক একটা চাকরি, যা হোক কিছু পরিষেবার মহড়া— গ্রিন পুলিশ, অঙ্গনওয়াড়ি বা আশা কর্মী, স্বাস্থ্যসাথী, পার্শ্ব শিক্ষক। কিঞ্চিৎ সহানুভূতির বোনাস জুটতে পারে, তার পরেও বেড়া টপকালে লাঠ্যৌষধি। এ রাজ্যে হাল আমলে যত শিক্ষকগোষ্ঠী পুলিশের মার খেয়েছে, আর কেউ খেয়েছে কি?
শিক্ষক-ছাত্রের অশান্তি মিটবে না, অতএব প্রাণবন্ত শিক্ষাব্যবস্থা অধরা থেকে যাবে, যত দিন না সারা দেশে শিক্ষক নিয়োগ ও বেতনক্রম, পরিকাঠামো ও অর্থবরাদ্দ— এক কথায় সব দিক দিয়ে কেন্দ্র বা রাজ্যের অধীন, সরকারি-বেসরকারি, মন্দির-মিশন-মাদ্রাসা সব বিদ্যায়তনের ছাত্র-শিক্ষককে, এক জমিতে এক শর্তে ও সম্মানে দাঁড় করানো হচ্ছে। কাজটা সহজ নয়। দেশ জুড়ে কত রকম জট ও অসঙ্গতি পাকিয়ে আছে, কেউ জানে না। কেন্দ্রকে একতরফা দুষে লাভ নেই। কোনও রাজ্য সরকার শিক্ষার যৌথ ক্ষেত্রে নিজের দখল ছাড়বে না, ছাড়বে না ছড়ি ঘোরাবার সুযোগ; স্পষ্ট রাজনৈতিক ফায়দা না থাকলে বাড়াবে না অর্থবরাদ্দ।
ভুললে চলবে না, কেন্দ্রের আজ জেএনইউ ধ্বংসে যে প্রবল উৎসাহ, তেমন উৎসাহ দেখিয়েছিল প্রেসিডেন্সির ক্ষেত্রে আশির দশকে তৎকালীন রাজ্য সরকার, আবার ২০১৪-য় যাদবপুরের প্রতি তাদের উত্তরসূরি। নেহাত এই রাজ্যে সরকারের ‘কিলার ইন্সটিংক্ট’ কম, ধ্বংসটা সর্বাত্মক হয়নি; কিন্তু উভয় প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষত আজও শুকোয়নি। এই লেখকের দুর্ভাগ্য, উভয় ক্ষেত্রই কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। স্কুলশিক্ষক নিয়োগে আগের সরকারের কীর্তি লজ্জাকর (পার্শ্ব শিক্ষক সমস্যা তাদেরই সৃষ্টি); বঞ্চনার ট্র্যাডিশন আজও সমানে চলছে, বর্তমান আন্দোলন তার সাক্ষী।
পার্শ্ব শিক্ষকদের এক প্রাক্তন সতীর্থ বলছিল, ‘লড়াই তো মাঝেমধ্যে সকলেই করে, কিন্তু আমরা যেন লড়াই না করে একটা কিচ্ছু পেলাম না।’ কথাটা মনে ধরল। নিজে এতটাই অনুকূল পরিবেশে কাজের সুযোগ পেয়েছি যে তুলনা করলে তাদের সংগ্রামের অপমান হবে; অপমান হবে আমার সহস্রবঞ্চিত শিক্ষক পূর্বপুরুষদের। তবু কর্মজীবন ধরে আগাগোড়া মনে হয়েছে, যথাযোগ্য ভাবে পড়তে গেলে, পড়াতে গেলে, পরিপার্শ্বের সঙ্গে, সিস্টেমের সঙ্গে যেন জুঝতে হচ্ছে, বিধ্বস্ত হতে হচ্ছে। শেষ বিচারে আমরা সকলেই হীরক রাজার প্রজা।
লেখক: এমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy