—ফাইল চিত্র।
সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি-হত্যায় পাঁচ জনের মৃত্যুদণ্ড হইল, আরও তিন জনের দীর্ঘ কারাদণ্ড। কিন্তু কাহারও পরিচয় জানাইল না সৌদি আরব। শুধু ঘোষিত হইল, যাঁহার বিরুদ্ধে লিখিতেন খাশোগি, সেই সৌদি রাজপুত্র মহম্মদ বিন সলমনের ঘনিষ্ঠেরা নির্দোষ। দুই উচ্চপদস্থ সৌদি আধিকারিকও বেকসুর খালাস পাইলেন, যদিও খাশোগি-হত্যার প্রেক্ষিতে তাহাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠিয়াছে, ইহা কেমন বিচার? কে অপরাধী, তাহার বিরুদ্ধে কী সাক্ষ্যপ্রমাণ মিলিল, কিছুই প্রকাশিত হইল না। সত্যান্বেষী সাংবাদিকের কি এমন বিচারই প্রাপ্য? কেবল সৌদি আরব নহে— ভারতেও নিহত, আক্রান্ত সাংবাদিক বিচার হইতে বঞ্চিত হয়। গৌরী লঙ্কেশ হত্যার দুই বৎসর পরেও বিচার শুরু হয় নাই। শুজাত বুখারি হত্যার তদন্ত দেড় বৎসরেও শেষ হয় নাই, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল হইবার পরে মামলার গতি স্তব্ধ রহিয়াছে। ইতিমধ্যে গুলিবিদ্ধ হইয়া মৃত্যু হইয়াছে এক সন্দেহভাজনের। তাই বলিয়া কোনও অপরাধীর শাস্তি কি হয় নাই? হইয়াছে বইকি। দুইটি ধর্ষণের মামলায় কারাবদ্ধ গুরমিত রাম রহিমের বিরুদ্ধে সাংবাদিক রামচন্দ্র ছত্রপতিকে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হইয়াছে। তবে অপরাধের সতেরো বৎসর পর।
আক্রান্ত হইলে বিচার মিলিবে না, এ কথা প্রতিষ্ঠা করিতে পারিলে সকল বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ হইবে বলিয়াই বলদর্পীদের আশা। সেই আশা অংশত বাস্তব হইতেছে। সাংবাদিকেরা এখন স্বনিয়ন্ত্রণে অভ্যস্ত। তাঁহারা জানেন, বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের সুপরিচিত সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ লইয়া কিছু শোরগোল হইলেও, জেলা-মফস্সলের ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকদের মৃত্যু আড়ালে থাকিয়া যায়। নিহত সাংবাদিকেরা অনেকেই বালি, জমি প্রভৃতির অবৈধ কারবার ফাঁস করিয়াছিলেন। একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে প্রকাশ, গত পাঁচ বৎসরে ভারতে চল্লিশ জন সাংবাদিক নিহত হইয়াছেন। সাংবাদিকদের উপর গুরুতর হামলার ঘটনা ঘটিয়াছে ১৯৮টি। গবেষকরা দেখিয়াছেন, বহু ক্ষেত্রে সাংবাদিকের আত্মীয়-সহকর্মীদের বয়ান অগ্রাহ্য করিয়া পুলিশ হত্যার কারণ পারিবারিক বিবাদ বলিয়া নির্ধারণ করিয়াছে। অনেক ক্ষেত্রে এফআইআর-ও দায়ের করে নাই পুলিশ। বহু ক্ষেত্রে সাংবাদিকরাই ভয়ে বা হতাশায় পুলিশে অভিযোগ করেন না। চার্জশিট দাখিল, বিচার শুরু হইবার সংখ্যা নগণ্য। প্রেস কাউন্সিল বা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও সাংবাদিক-হত্যার বিচারের সম্পূর্ণতার প্রতি অমনোযোগী।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রেপোর্তে সঁ ফ্রঁতিয়ের’ জানাইয়াছে যে এ বৎসর সিরিয়া, আফগানিস্তানের মতো দেশগুলিতে যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা কমিয়াছে, কিন্তু ‘শান্তিপূর্ণ’ দেশগুলিতে বাড়িয়াছে। যাহার অর্থ, সাংবাদিকই লক্ষ্য হইয়া উঠিতেছেন। হত্যা এ বৎসর কমিয়াছে, কিন্তু কারারুদ্ধ সাংবাদিকের সংখ্যা বাড়িয়াছে— ৩৮৯ জন কারারুদ্ধ সাংবাদিকের এক-তৃতীয়াংশই চিনে। সংবাদ স্বাধীনতার সূচকে চিনের স্থান ১৮০ দেশের তালিকায় ১৭৭। ভারতের স্থান গত পাঁচ বৎসরে ক্রমাগত পিছাইয়া এখন ১৪০। সাংবাদিকের প্রতি ব্যবহার যে রাষ্ট্রের স্থানটিও নির্দিষ্ট করে, তাহার কারণ সাংবাদিকের বিপন্নতা কেবল ব্যক্তির বিপন্নতা নহে। তাহা জাতির বিপদকেও সূচিত করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy