ভীমা কোরেগাঁওয়ে হিংসায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার মানবাধিকার কর্মী গৌতম নওলাখা। ছবি: পিটিআই।
রাষ্ট্র বলছে আতঙ্কবাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ। কিন্তু আদৌ কি তাই? কোনটা আতঙ্কবাদ? কে আতঙ্কবাদী? বিপুল সংখ্যক নাগরিককে যে আতঙ্কে রাখে, আতঙ্কবাদী তো সে-ই। ভীমা-কোরেগাঁও কাণ্ডে মাওবাদী যোগের অভিযোগ তুলে দেশ জুড়ে যে ভাবে আচমকা সক্রিয় হল রাষ্ট্রের বাহিনী, যে মাত্রায় সক্রিয় হল, যে ভঙ্গিতে সক্রিয় হল, বহু মনে আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে সেই বিরল সক্রিয়তাই। এ কথা কি রাষ্ট্র বুঝতে পারছে?
ভীমা-কোরেগাঁওতে যে ঘটনা ঘটেছিল এবং তার প্রেক্ষিতে যে ভাবে হিংসা ছড়িয়েছিল মহারাষ্ট্রে— দু’টি পর্বই অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এই হিংসার শিকড় যদি কোনও বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের গভীরে থেকে থাকে, তা হলে সেই শিকড় বেয়ে গভীরে যাওয়ার দরকার রয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার দরকারও রয়েছে। মাওবাদী ষড়যন্ত্র হোক, বা অন্য কোনও মতবাদী, ষড়যন্ত্রকারীর ছাড় পাওয়া নিশ্চয়ই উচিত নয়। কিন্তুই পদক্ষেপটা কি আদৌ ষড়যন্ত্রকারীর বিরুদ্ধে হচ্ছে? নাকি ষড়যন্ত্র ভাঙার নাম করে অন্য কোনও ষড়যন্ত্রের সংগঠিত রূপায়ণ ঘটানো হচ্ছে? এই প্রশ্নটা খুব বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে।
হায়দরাবাদ, ফরিদাবাদ, মুম্বই, ঠাণে, রাঁচী, গোয়া— দেশের নানা অংশে একই সঙ্গে হানা দিয়েছে পুণে পুলিশ। ভারাভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নওলাখা, অরুণ ফেরেরা, ভার্নন গঞ্জালভেসদের গ্রেফতার করা হয়েছে। ভীমা-কোরেগাঁও কাণ্ডকে ঘিরে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ হিংসার নেপথ্যে মাওবাদী ছক ছিল এবং তাতে এঁরা জড়িত বলে দাবি করা হয়েছে।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের পরিসরে অত্যন্ত সম্মাননীয় ব্যক্তিত্ব। প্রত্যেকেই পেশাদারিত্বের বাইরে বেরিয়ে এক বৃহত্তর সামাজিকতার মধ্যে বাঁচেন। প্রত্যেকেই শুধু নিজের জন্য না বেঁচে অনেক বড় এক পরিবারকে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন।
রাষ্ট্র বলতে পারে, ধৃতদের সম্পর্কে যে ধারণা জনমানসে রয়েছে, তা আপাতদৃষ্টির ধারণা। রাষ্ট্র বলতে পারে, ধৃতরা বৃহত্তর সামজিকতার মধ্যে বাঁচার ভঙ্গি করেন আর তার আড়ালে উগ্রপন্থা ছড়াতে থাকেন। কিন্তু রাষ্ট্র বললেই কোনও কথা বেদবাক্য হয়ে ওঠে না। রাষ্ট্র সর্বদা ধ্রুবসত্যে পরিবৃতও থাকে না।
অতএব এই রকম পরিস্থিতিতে সত্য-মিথ্যা সম্পর্কে একটা ধারণায় পৌঁছতে অন্য আরও অনেক কণ্ঠস্বরের জন্য কান পাততে হচ্ছে। আর সেই ‘অন্য’ কণ্ঠস্বরগুলো রাষ্ট্রের এই আচম্বিত সক্রিয়তার তীব্র নিন্দায় সরব হচ্ছে। সাহিত্যিক, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, দলিত আন্দোলনের নেতা, আইনজীবী— বিদ্বৎ সমাজের সব অংশ থেকেই তীব্র প্রতিবাদ শোনা গিয়েছে। পরিস্থিতির তুলনা শুরু হয়েছে ইন্দিরা জমানার জরুরি অবস্থার সঙ্গে।
আরও পড়ুন: ভীমা কোরেগাঁও কাণ্ডে ‘মাও যোগ’! দেশ জুড়ে বিদ্বজ্জনদের ধরপাকড়, নিন্দার ঝড়
যে ভঙ্গিতে পুণে পুলিশ অভিযান চালিয়েছে, যে ভাবে আচমকা দেশ জুড়ে ধরপাকড় হয়েছে, যে ভাবে বিদ্বজ্জন হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিত্বদের গ্রেফতার করা হয়েছে এবং যে ভাবে দেশের বর্তমান শাসক গোষ্ঠীর তীব্র সমালোচক হিসেবে পরিচিতরাই গ্রেফতার হয়েছেন, তাতে জরুরি অবস্থার সঙ্গে পরিস্থিতির তুলনা না টানার কোনও কারণ কি দেখা যাচ্ছে? ইন্দিরা গাঁধীর ১৯৭৫-এর সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর ২০১৮-কে মেলাতে কি খুব কষ্ট হচ্ছে?
ভীমা-কোরেগাঁও কাণ্ড এবং তত্পরবর্তী পরিস্থিতির পিছনে সত্যিই মাওবাদীদের হাত ছিল কি না, তা প্রমাণসাপেক্ষ। মাওবাদী ষড়যন্ত্র যদি থেকেও থাকে, তা হলে সে ষড়যন্ত্রের শরিক আচমকা গ্রেফতার হওয়া এই বিশিষ্ট নাগরিকরা ছিলেন কি না, তাও প্রমাণসাপেক্ষ। প্রশ্ন উঠতে পারে, অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগে কি গ্রেফতার করা হয় না? হ্যাঁ, গ্রেফতার করা হয়, সন্দেহের ভিত্তিতেও গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু যাঁদের গ্রেফতার করা হচ্ছে তাঁরা কারা, কী তাঁদের সামাজিক পরিচয়, দেশ ও দশের জন্য তাঁদের অবদান কী— সেই সবও তো বিচার করতে হবে। বজ্রমুষ্টি নিয়ে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ার ভঙ্গিতে যে ভাবে এক ঝাঁক বিশিষ্ট নাগরিককে ধরে নিয়ে গেল পুলিশ, তাতে পুলিশ-প্রশাসন বা রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি জনসাধারণের শ্রদ্ধা কি বিন্দুমাত্র বাড়ল? না কি রাষ্ট্রের একটা দানবীয় মুখচ্ছবি আচমকা দেখা দিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করল? শাসকের উচিত নিজের কাছেই এই প্রশ্নের উত্তর চাওয়া। উত্তর সন্ধানে অবহেলা হলে অচিরেই শাসকের প্রতি সাধারণের আস্থার ভিতটা টাল খেতে পারে। সে রকম কোনও পরিস্থিতি রাষ্ট্রের পক্ষে বোধহয় সুখকর হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy