Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
India-China

কোন এক্তিয়ারে

অনুমান করা চলে, তাঁহার এই রণহুঙ্কার স্বতঃপ্রবৃত্ত নহে— তাহার পিছনে রাজনৈতিক মদত আছে।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

বিপিন রাওয়ত জানাইয়াছেন, আলাপ-আলোচনায় লাদাখ সমস্যার সমাধান না মিলিলে ভারত সামরিক ঔষধ প্রয়োগ করিতে প্রস্তুত। কথাটি বলিবার এক্তিয়ার চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ রাওয়তের আছে কি? প্রশ্নটির উত্তর তিনিও বিলক্ষণ জানেন। যুদ্ধ ঘোষণা করা, বা সেই হুমকি দেওয়া সেনাকর্তার কাজ নহে। তাঁহাদের পরামর্শ দেওয়ার থাকিতেই পারে। ১৯৪৯ সালে জেনারেল কারিয়াপ্পা নেহরুকে জানাইয়াছিলেন, চিনের সহিত যুদ্ধ করিবার সামর্থ্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর নাই। নেহরু সেই পরামর্শ মানিয়া লইয়াছিলেন। আবার, ১৯৭১ সালে স্যাম মানেকশ’ ইন্দিরা গাঁধীকে জানাইয়াছিলেন, পূর্ব সীমান্তে পাকিস্তানের সহিত যুদ্ধে যাওয়া বিপজ্জনক, কারণ পশ্চিম সীমান্ত সামলাইতেই সেনাবাহিনীর অধিকতর শক্তি ব্যয় হয়। ইন্দিরা সেই পরামর্শ মানেন নাই। এমন উদাহরণের তালিকা বাড়াইয়া যাওয়া চলে, কিন্তু মূল কথা দুইটি স্পষ্ট— এক, সেনাকর্তার যাহা বলিবার, তাহা প্রধানমন্ত্রী বা প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বলিতে হইবে; দুই, সিদ্ধান্তের অধিকার রাজনৈতিক নেতার, সামরিক প্রধানের নহে। সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীন রাখিবার দূরদর্শী সিদ্ধান্তটিই যে ভারতকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে স্বাধীন হওয়া অন্য বহু দেশের করুণ পরিণতি হইতে বাঁচাইয়াছে, এই কথাটি গত সাত দশকে প্রশ্নাতীত ভাবে প্রমাণিত। ভারতীয় গণতন্ত্রের সেই ধারা হইতে বাহিরে যাইবার অধিকার রাওয়তের নাই।

অনুমান করা চলে, তাঁহার এই রণহুঙ্কার স্বতঃপ্রবৃত্ত নহে— তাহার পিছনে রাজনৈতিক মদত আছে। ইতিপূর্বেই কেন্দ্রীয় সরকারের দুই প্রধান মুখ চিনের সহিত যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত হাওয়ায় ভাসাইয়া রাখিয়াছেন, রাওয়ত েসই কাজটিই আবার করিলেন। গত কয়েক বৎসরে সামরিক বাহিনীর কর্তারা ক্রমান্বয়েই অনধিকার চর্চা করিয়া গিয়াছেন, এবং প্রতি বারই সেই বে-এক্তিয়ার আচরণ রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রশ্রয় পাইয়াছে। এই প্রবণতাকে আকস্মিক বলা চলে না। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসিবার পর নরেন্দ্র মোদী ক্রমেই সামরিক বাহিনীকে জনসমক্ষে একটি উচ্চতর আসনে বসাইবার প্রয়াস করিয়াছেন, এবং পক্ষান্তরে জনমানসে সেনাবাহিনীর জন্য যে সম্মান আছে, নিজে তাহার ভাগিদার হইতে চাহিয়াছন। ফলে, সামরিক বাহিনীর সহিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে ফারাকটি সচেতন ভাবে রাখা হইয়াছিল, এই আমলে তাহা ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়াছে। ইতিহাস বলিবে, সেনাকে প্রয়োজনের অধিক সম্মানের আসনে বসাইবার এই ধাঁচটি একনায়কন্ত্রের চেনা ও বহুব্যবহৃত পথ। তবে, ইতিহাস একই সঙ্গে জানাইবে, সেনাবাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করিবার ফল গণতন্ত্রের পক্ষে সুখকর হয় না। কেবল গণতন্ত্র নহে, শেষ অবধি তাহা একনায়কেরও বিপক্ষেই যায়। আশা থাকিল, বিলম্ব হইবার পূর্বেই নরেন্দ্র মোদীরাও এই ইতিহাস পাঠ করিয়া লইবেন।

কেহ সন্দেহ প্রকাশ করিতে পারেন, রাওয়তের হুঙ্কারটি নিতান্তই ফাঁকা আওয়াজ। একে চিনের সহিত টক্কর দেওয়ার মতো সামরিক শক্তি ভারতের নাই, তাহার উপর অনুপ্রবেশের কথা মানিতে নারাজ প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই যে দুই মাস সময় নষ্ট করিয়াছেন, তাহাতে চিন নিজেদের দুর্বলতাগুলি ঢাকিবার সময় পাইয়া গিয়াছে। এই আশঙ্কা ঠিক না ভুল, সেই তর্ক অন্যত্র। এই বিষয়ে মুখ খুলিবার অধিকার রাওয়তের নাই, এই ক্ষেত্রে ইহাই একমাত্র কথা। প্রশ্ন থাকিয়া যায়, তাঁহার এই অনধিকারচর্চার পিছনে গূঢ়তর কারণ আছে কি? বিজেপি নেতাদের রণহুঙ্কারগুলি সাধারণ মানুষের নিকট আর তত বিশ্বাসযোগ্য ঠেকিতেছে না বলিয়াই কি সামরিক উর্দির আড়াল হইতে সেই বার্তা প্রচারের ব্যবস্থা হইল? ভারতের দুর্ভাগ্য, রাজনীতির ঘোলা জলে সেনাবাহিনীর সম্মান ও বিশ্বাসযোগ্যতাও ভাসিয়া গেল।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy