অভিযান: মাথায় মাইসুরুর রাজকীয় শিরোভূষণ, বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে ভারতীয় জনতা পার্টির সভাপতি অমিত শাহ। ছবি: পিটিআই
কয়েক দিন আগে দেখা গেল এক আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত সৌহার্দ-চিত্র। কর্নাটকের বর্ষীয়ান নেতা, জনতা দল (এস)-এর প্রধান দেবগৌড়া হাসিমুখে বললেন, নরেন্দ্র মোদী না থাকলে কবেই তাঁকে দিল্লি থেকে বিদায় নিতে হত। এই গদগদ ভাষণের আগের দিনই উদুপির নির্বাচনী সভায় নরেন্দ্র মোদীর মুখে শোনা গেল দেবগৌড়ার বিচক্ষণতার ভূয়সী প্রশংসা, এবং রাহুল গাঁধী যে দেবগৌড়াকে ‘যথেষ্ট সম্মান করেন না’, তার কড়া সমালোচনা! প্রশংসাবাক্য বর্ষণ নিশ্চয় মনের উদারতারই পরিচয়, তবে প্রেক্ষিত যখন নির্বাচন, পাত্র যখন প্রধানমন্ত্রী মোদী, আর বিষয় যখন অন্যতম প্রতিযোগী দলের প্রধান নেতা, তখন এই মন্তব্যের পিছনে জটিল-কুটিল হোমওয়ার্ক নেই, তা কি সহজে মেনে নেওয়া যায়? এ সবের পরে অবশ্য মোদী আবার সহসা দেবগৌড়ার উদ্দেশে তির্যক মন্তব্য ছুড়েছেন, তবে তার কতটা আন্তরিক আর কতটা কৌশল— তা নিয়ে অনেকের মনেই অনেক সংশয়।
সে যা-ই হোক, মোদীর এই কথাবার্তার মধ্যে বেশ একটা গুরুতর তাৎপর্য আছে। এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে দেবগৌড়ার প্রশংসা না করে আজ আর উপায় নেই, কারণ এই সূত্রে সে রাজ্যের একটি বিশেষ গোষ্ঠীর মনোরঞ্জন তাঁদের এখন করা দরকার! দেবগৌড়া সেই গোষ্ঠীটির পছন্দের প্রতিনিধি, জনতা দল (এস) সেই গোষ্ঠীটির পছন্দের পার্টি। সেই জাত-গোষ্ঠীর নাম ভোক্কালিগা। বিজেপি নেতৃত্বের হিসেব সোজা। লিঙ্গায়ত গোষ্ঠীর রাজনীতি বাঁকা দিকে মোড় নিয়েছে, এখন ভোক্কালিগাদের নিজেদের দিকে টানতেই হবে। অন্তত ভোক্কালিগা সমর্থন পেলে ভোটের ময়দানে কংগ্রেসকে এখনও বড় রকমের বিপদে ফেলার আশা থাকে।
মোদীর এই অপ্রত্যাশিত দেব-বন্দনার সঙ্গে মেলাতে হবে কয়েক মাস আগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার সেই অপ্রত্যাশিত ঘোষণাটিকে। হঠাৎই কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, হিন্দু ধর্মের মধ্যে একটি আলাদা ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য লিঙ্গায়তরা দীর্ঘ দিন ধরে যে দাবি করে আসছেন, তাঁর সরকার তা সমর্থন করছে, ওই স্বীকৃতি পাইয়ে দেওয়ার জন্য যা করণীয়, তা ক্রমে করা হবে। এই এক ঘোষণার জোরে কংগ্রেসের প্রতি লিঙ্গায়তদের মনোভাব অনেকটাই পাল্টে যেতে বসে, যদিও ঐতিহ্যগত ভাবে লিঙ্গায়তরা বিজেপি-রই কাছাকাছি ছিলেন, পূর্বতন মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পাও তাঁদেরই এক জন ছিলেন। সিদ্দারামাইয়ার সে দিনের চালে কর্নাটক রাজ্যের ভোট-চালচিত্র বদলে যায় অনেকটাই। দুর্নীতি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে রাজ্য বিজেপির মধ্যে এমনিতেই ইয়েদুরাপ্পার সমর্থন অনেকটা কমে আসছিল, তার উপর যোগ হল এই লিঙ্গায়ত-কোপ।
ভোট-হিসেবশাস্ত্রের অঙ্গনে অমিত শাহ মশাই রীতিমতো আইনস্টাইন-তুল্য, সুতরাং চটপট ভোক্কালিগা-চালটি তিনি ভেবে ফেললেন. জনসংখ্যার বিচারে ১৭ শতাংশ দখল করে থাকা লিঙ্গায়তরা যদি এ রাজ্যের প্রধান জাতগোষ্ঠী হন, ভোক্কালিগারা তবে দ্বিতীয় প্রধান জাতগোষ্ঠী, যাঁরা একটি সঙ্ঘবদ্ধ আইডেন্টিটি বা পরিচিতিতে বিশ্বাস করেন। দক্ষিণ কর্নাটকের ৮৯টি আসনের মধ্যে ৭০ থেকে ৭৫টি আসনের ভোট-ফলাফল ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন এঁরা। চারটি প্রশংসাবাক্য খরচ করে যদি শেষবেলাতেও একটা ভাল রকম দাঁও মারা যায়, ক্ষতি কী।
এই ‘শেষবেলা’ ব্যাপারটা বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। খেয়াল না করে উপায় নেই, যেখানে জানুয়ারি থেকে নির্বাচনী প্রচারের সমারোহ চলছে, নরেন্দ্র মোদীকে দেবগৌড়ার প্রশংসাটা করতে হল মে মাসের প্রথম সপ্তাহে এসে, অর্থাৎ ভোটের মাত্র দিন দশেক আগে। কিছু কি বলে না এই শেষবেলার ‘ট্যাকটিক’? গত মাস দুয়েক ধরে কর্নাটকে এত যে হিন্দুত্ববাদের বন্যা বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা, হিন্দুত্বের আগমার্কা প্রতিনিধি যোগী আদিত্যনাথকে কর্নাটকে টেনে এনে তাঁকে দিয়ে প্রচারের ধুম তোলা, এ সব করেও কি তা হলে ভাল সুবিধে হল না, ধরে নেব আমরা? হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তা-গাথার পাশাপাশি সেই চিরপুরাতন দাঁতভাঙা জাত-পাটিগণিতেই এসে তা হলে আবার ঠেকতে হল বিজেপিকে? তবে লাভ কী হল আদিত্যনাথের ‘নব কর্নাটক পরিবর্তন যাত্রে’ মিছিলের সমারোহে? লাভ কী হল, সিদ্দারামাইয়ার সরকারকে হিন্দুবিরোধী প্রতিপন্ন করার এত রকম প্রচেষ্টায়? সিদ্দারামাইয়া গোমাংস-সমর্থক বলে কন্নডিগা জাতীয়তার পক্ষে বিপজ্জনক, এমন দুর্বোধ্য দাবির হল্লায় তবে কী ফল পাওয়া গেল? কর্নাটক রাজ্যের কংগ্রেস সরকারও টিপু সুলতান উৎসব পালন করে, আবার পাকিস্তানও টিপু সুলতানের প্রশংসা করে, সুতরাং কংগ্রেস আর পাকিস্তানের মধ্যে তত তফাত নেই— এই সব অসামান্য তত্ত্ব রচনা করেই বা লাভ কী হল?
বস্তুত যোগী আদিত্যনাথকে দিয়ে দূর-দাক্ষিণাত্যের রাজ্যটিতে যে ভাবে প্রচার করানো হল, এমনকী তাঁর নিজের রাজ্য যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে জেরবার, তখনও তিনি যে ভাবে দক্ষিণী রাজ্যটি ছেড়ে আসছিলেন না (শেষে বোধ হয় সিদ্দারামাইয়ার ব্যাঙ্গাত্মক টুইটের ধাক্কায় তাঁকে ঠাঁইনাড়া হতে হল), সেই সব থেকেও বোঝা যায় কর্নাটকের পরিস্থিতিতে কতটাই উতলা হয়ে পড়েছেন বিজেপি নেতৃবৃন্দ। ধর্মীয় মেরুকরণের চালটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এখন যোগীর থেকে বড় অস্ত্র বিজেপির হাতে নেই। মেরুকরণ এখন ভোটযুদ্ধের পরিচিত অস্ত্র, গুজরাতের ভোটেও সেই অস্ত্রের ঝঙ্কার দেখা গিয়েছে, উত্তর-পূর্বের প্রদেশগুলিতেও, কয়েক মাস ধরে কর্নাটকেও প্রাণপণ হিন্দু-মুসলিম মেরুবিভাগের চেষ্টা চলছে। কিন্তু গত কয়েক মাসের কর্নাটক এও বুঝিয়ে দিয়েছে যে মেরুকরণ দিয়ে পুরো বিষয়টা বাগে আনা বিজেপির পক্ষে সহজ নয়। গত বিধানসভা ভোটেও কিন্তু মেরুকরণের প্রচেষ্টায় কর্নাটকের তৎকালীন শাসক দল বিজেপি গুজরাতের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে উড়িয়ে এনেছিল, তাঁকে দিয়ে ব্যাপক প্রচার চালিয়েছিল। ফল হয়েছিল শূন্য। সে বার বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে জেতানো যায়নি।
ঠিকই, পরের বছর ২০১৪ সালেই আবার লোকসভা ভোটে কর্নাটক প্রাণ খুলে মোদীকে ভোট দিয়েছিল, কিন্তু সেই ভরসায় তো আর আজকের বিধানসভা ভোটের সাফল্য আশা করা যায় না! এমনও তো হতে পারে যে এই রাজ্যে লোকসভা-বিধানসভার ভোটের মধ্যে একটা পার্থক্য তৈরি হয়, এবং বিধানসভা ভোটের মধ্যে আগুনঝরানো হিন্দুত্ববাদের ততখানি জায়গা তৈরি হয় না! হতেই পারে যে, বিধানসভা ভোটের পক্ষ-বিপক্ষের পরিসরে বরং জায়গা করে নেয় স্থানীয় পাওনা-গণ্ডার হিসেব, যে হিসেবের মধ্যে সারাক্ষণ একটা সূক্ষ্ম বিচার চলতে থাকে— জাত-গোষ্ঠীদের কার ভাগে কত কী পড়ল। আর সেই বিচারেই প্রবল প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে লিঙ্গায়ত বা ভোক্কালিগা গোষ্ঠীগুলির ক্ষোভ-বিক্ষোভ!
মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়াও এই সব বুঝেশুনেই শেষে লিঙ্গায়তদের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণাটি করেছিলেন। লিঙ্গায়তদের আলাদা ধর্মীয় গোষ্ঠীর স্বীকৃতি দিতে হবে, এই দাবির মধ্যে সঙ্কীর্ণ পরিচিতির রাজনীতি আছে, পশ্চাৎপদতার নিশান আছে, এ সব তিনি বিলক্ষণ জানেন বলেই তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, তিনি ব্যক্তিগত ভাবে জাত-বিভাজনে বিশ্বাস করেন না, ধর্মের মধ্যে নতুন করে গোষ্ঠী ভাগাভাগিতে তাঁর নিজস্ব মত নেই, কিন্তু কী-ই বা করবেন তিনি, একটি প্রাদেশিক গোষ্ঠীর এত দিনের দাবিকে প্রশাসনিক ভাবে উপেক্ষাও করতে পারছে না তাঁর সরকার, ইত্যাদি।
একটা কথা পরিষ্কার। আজকের ভারতের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আইডেন্টিটি-ভিত্তিক সংরক্ষণের দাবিটি তুরুপের তাস। যে গোষ্ঠী যখন সেই তাস খেলবে, তার জয়ের পথ অনেকটা মসৃণ হয়ে যাবে। এই বাস্তবতার মধ্যে আমরা গণতন্ত্র প্রক্রিয়াটির জয় দেখব না পরাজয়, সেই বিতর্ক চলুক। কিন্তু কর্নাটকে বিজেপির এ বারের সঙ্কট এই বিতর্কের ঊর্ধ্বে একটা কথা বুঝিয়ে দিয়ে গেল— হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তার গৈরিক পতাকার অপরিমেয় গৌরবও গণতন্ত্রের ওই দুরতিক্রম্য ফাঁদটিকে কেটে বার হতে পারছে না। হিন্দু ভারতের এক ও অখণ্ডতার বাণী স্থগিত রেখে তাদেরও ভিতরকার খণ্ড আইডেন্টিটির কথা ভাবতে হচ্ছে, কারণ সেই খণ্ডপরিচিতিগুলো নিশ্চয়ই হিন্দুত্বের বাণী শুনে আবেগে আত্মহারা হয়ে বিজেপির প্রতি অবধারিত ভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে না।
কর্নাটকের ভোটের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, তার ভোটের প্রচারপর্বের মধ্যে একটা জরুরি বার্তা থেকে গেল: এই ভারতকে এক সূত্রে বাঁধা সহজ নয়। এমনকী হিন্দুত্বের মহাসূত্রেও নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy