ইদানীং মোদী সরকারের ‘সুনজর’-এ পড়েছেন রবীন্দ্রনাথ। খেলনা তৈরি থেকে লেখাপড়া— তাঁর দেখানো পথেই নাকি হাঁটতে চাইছেন কেন্দ্রের শাসক, দাবি তেমনই। রবীন্দ্রানুসরণের পিছনে রাজনৈতিক অঙ্ক আছে কি না, তার চেয়েও জরুরি প্রশ্ন, সরকার কি সত্যিই গুরুদেবের আদর্শ মেনে নীতি তৈরি করছে?
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, উচ্চশিক্ষা শুধু আমাদের জ্ঞান দান করে না, নিজেদের অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। আমাদের নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির বৃহত্তর দর্শন সেটাই।” ওই একই বক্তৃতায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় লেখাপড়া করার সুযোগের কথাও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুমান করা যায়, মায়ের ভাষায় পড়াশোনার সুযোগ পেলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে পারবে। এ কথা ঠিক যে, মাতৃভাষায় লেখাপড়ার পক্ষে স্পষ্ট মত ছিল রবীন্দ্রনাথের। শিক্ষার বাহন মাতৃভাষা এবং মাতৃদুগ্ধকে তুলনীয় মনে করতেন তিনি। ‘শিক্ষার স্বাঙ্গীকরণ’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, পরভাষায় ভারাক্রান্ত হলে সাধনা চির কালের মতো পঙ্গু হওয়ার ভয় থাকে। বহু ভারতীয় মন বিদেশি ভাষার চাপে খর্ব হয়েছে। মাতৃভাষার স্বাভাবিক জল-হাওয়ায় মানুষ হলে ফল হয়তো অন্য রকম হত। শিক্ষানীতিও জানাচ্ছে, নিজের ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যে লালিত হওয়া শিক্ষাগত, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পরিপন্থী নয়, সহায়ক। খসড়াও বলেছিল, ইংরেজির একাধিপত্যের ফলেই বহু মেধা বিকশিত হতে পারছে না। এ কি রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন সাকার করার চেষ্টা?
সহজ উত্তর— না। রবীন্দ্রনাথ এবং মোদী সরকারের শিক্ষাভাবনার প্রভেদ আছে, এবং তা একেবারে মূলে। শিক্ষানীতির গভীরে প্রবেশ করলেই তা স্পষ্ট হবে। ‘বহুভাষিকতা ও ভাষার শক্তি’ শীর্ষক অংশে নীতি বলছে, “যেখানে সম্ভব, অন্তত গ্রেড ৫ পর্যন্ত— গ্রেড ৮ এবং তার পরে হলে আরও ভাল— ঘরের ভাষা/মাতৃভাষা/স্থানীয় ভাষা/আঞ্চলিক ভাষা হবে শিক্ষাদানের মাধ্যম।” এই প্রধান বাক্যটিতেই দুটো বিষয় আছে, যা সরাসরি রবীন্দ্রচিন্তার বিরোধী। প্রথমত, মাতৃভাষার সঙ্গে আরও তিন প্রকার ভাষাকে এমন ভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যেন সেগুলো বিকল্প। মাতৃভাষার সঙ্গে এক বন্ধনীতে অন্য কোনও শ্রেণিকে বসানো রবীন্দ্রনাথের পক্ষে অসম্ভব ছিল। মাতৃভাষা বলতে তিনি কেবল মাতৃভাষাই বুঝতেন। লিখেছিলেন, “...শিশুকাল থেকে আমার মনের পরিণতি ঘটেছে কোনো-ভেজাল-না-দেওয়া মাতৃভাষায়; সেই খাদ্যে খাদ্যবস্তুর সঙ্গে যথেষ্ট খাদ্যপ্রাণ ছিল, যে খাদ্যপ্রাণে সৃষ্টিকর্তা তাঁর জাদুমন্ত্র দিয়েছেন।” সরকারি ভাবনায় ‘খাদ্যপ্রাণ’-এর সেই জাদু জীবিত থাকার কোনও আশা নেই। ঘরের ভাষা, মাতৃভাষা, স্থানীয় ভাষাকে একীকৃত করে ফেললে ঘুরপথে অন্য ভাষার প্রবেশের আশঙ্কা এড়ানো যায় না। তথ্যগত ভ্রান্তি না থাকলেও তাতে রবীন্দ্রভাবনার আত্মার সঙ্গে ছলনা করা হয়— মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে কিছুর তুলনা হয় না।
দ্বিতীয়ত, বাক্যের গোড়ায় ‘যেখানে সম্ভব’ কথাটা গোলমেলে। রবীন্দ্রবিরোধীও। শিক্ষাক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ভাষার (লিটল ল্যাঙ্গোয়েজ), মাতৃভাষার লিখিত ভূমিকা প্রতিষ্ঠা করাই সবচেয়ে কঠিন ও সময়সাপেক্ষ কাজ। এখানে আপত্তি আসে সবচেয়ে বেশি। যুক্তি শোনা যায়, দেশি ভাষায় ভাল পাঠ্যপুস্তক নেই, ভাল উচ্চশিক্ষা হবে কী করে? মাতৃভাষাপন্থীরাও এই যুক্তির প্যাঁচে পড়েন। কিন্তু যুক্তিটাই আসলে উল্টো। শিক্ষা দেওয়ার কথা ভাবা না হলে শিক্ষাগ্রন্থ কী ভাবে তৈরি হবে? রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “বাংলায় উচ্চ অঙ্গের শিক্ষাগ্রন্থ বাহির হইতেছে না, এটা যদি আক্ষেপের বিষয় হয় তবে তার প্রতিকারের একমাত্র উপায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় উচ্চঅঙ্গের শিক্ষা প্রচলন করা।” সরকার রবীন্দ্রনাথের আদর্শে অনুপ্রাণিত হওয়ার দাবি করলেও সেই গড়পড়তা ‘যেখানে সম্ভব’-এর যুক্তিতেই আটকে গিয়েছে। পবিত্র সরকার লিখেছিলেন: ‘ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিয়ে বিচিত্র এক ন্যায়ের শরণ’। মাতৃভাষায় পড়াশোনা তখনই সম্ভব হবে, যখন তাকে সম্ভব করার চেষ্টা হবে, আর সে কাজ সরকার ছাড়া কে পারে! শিক্ষানীতিতে উন্নত দ্বিভাষিক পাঠ্যপুস্তক প্রস্তুত করার কথাও বলা আছে। কিন্তু সরকারি বয়ান দেখে ভয় হয়, তা শুধু ইংরেজিতেই আটকে না যায়।
সব দেখেশুনে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের নামটুকু ছাড়া নীতি-নির্ধারকদের তেমন মাথাব্যথা নেই। সন্দেহ জোরদার হয়, যখন সেই নীতিরই জরুরি অংশ হিসেবে ত্রি-ভাষা নীতি চালুর উল্লেখ দেখি, জন্মলগ্ন থেকেই যা পিছনের দরজা দিয়ে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বলে অভিযোগ ওঠে। সেই চাপিয়ে দেওয়ার ফলেই বহু ঘরের ভাষা অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছে এবং যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শে এমন চাতুর্যের ভাবনাও অকল্পনীয়।
যাঁরা আধিপত্যবাদের রাজনীতি অভ্যেস করেন, তাঁরা রবীন্দ্রনাথের আদর্শের কথা বললে মেনে নেওয়ার আগে মিলিয়ে দেখতে হয়। মিল নয়, পার্থক্য খোঁজাই সহজ। দুইয়ের যোগ, নিশ্চিত ভাবেই, অসেতুসম্ভব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy