ইহজাগতিক: আনিসুজ্জামান। ছবি: নাসির আলি মামুন
জীবনের দৈনন্দিনে আর মেধাচর্চায় ‘ইহজাগতিকতা’ই ছিল আনিসুজ্জামানের ধর্ম। সেই ইহজাগতিকতা কাকে বলে তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন— ‘‘যে-জগৎ ইন্দ্রিয়গোচর ও যুক্তিগ্রাহ্য এবং যে-জীবন জন্ম ও মৃত্যুর সীমায় আবদ্ধ, সেই জগৎ ও জীবন সম্পর্কে উৎকণ্ঠাকেই বলা যায় ইহজাগতিকতা’’ (‘ইহজাগতিকতা’ ১৯৮০)। ‘উৎকণ্ঠা’ শব্দটির নানা অর্থ— প্রিয়ার জন্য উন্মনস্কতা, ঔৎসুক্য ও উদ্বেগ সবই এই শব্দটিতে বোঝায়। আনিসুজ্জামানের প্রিয়া যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ভাষা-সংস্কৃতি বলতে তিনি ইন্দ্রিয়গোচর-যুক্তিগ্রাহ্য নানা উপাদানের সমবায়কেই বুঝতেন। বাংলাদেশে যে বাঙালি ছাড়া ‘‘অন্তত তেরোটি উপজাতি কিংবা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’’ বসবাস করেন, সেই সত্য স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকেরা সমজাতীয়তার সুখ ও পরিতৃপ্তিতে ভুলে গেলেও, তিনি ভোলেননি। ‘সাংস্কৃতিক বহুত্ব’-তে লিখেছেন, ‘‘পাহাড়ি জনগণের সংস্কৃতি... বাঙালিদের থেকে আলাদা।’’ অনেক সময় ভাষা-সংস্কৃতির ঐক্যের কল্পনা জাতীয়-উদ্দীপনার মিশেলে এমন ভাববাদী কল্পনা আর আবেগের জন্ম দেয় যে, সাংস্কৃতিক বহুত্বকে খর্ব করতে ইচ্ছে করে। সে ইচ্ছে আনিসুজ্জামানের কোনও দিন হয়নি— ভাষা-সংস্কৃতির সূত্রে বাঙালির আত্মপরিচয় যখনই তিনি অনুসন্ধান করেছেন, তখনই ইন্দ্রিয়গোচরতা ও যুক্তিগ্রাহ্যতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন, ফলে তাঁর আদর্শ বাঙালিয়ানা অন্যকে গ্রাস করে না। বাঙালির ভাষাকেন্দ্রিক আবেগ অপরের অস্তিত্বকে যেন খর্ব না করে, আবার অন্যরাও যেন ধর্ম ও অন্যান্য গৌণ উপাদানের সূত্রে বাঙালির ভাষা-নির্ভর আত্মপরিচয়ের রূপটিকে খণ্ডিত না করে, এই তাঁর লক্ষ্য। এই বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির জন্যই আজীবন উৎসুক ও উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি।
এই উদ্বেগের প্রধান কারণ ইংরেজদের হাত-ফেরতা দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতা। ১৯৪৭-এ কাটা-ছেঁড়া স্বাধীনতা পেল ভারত-পাকিস্তান, তখন তিনি দশ বছরের। এই দুই দেশে ঔপনিবেশিক শাসন-অবসানের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে ১৯৯৭ সালে নানা অনুষ্ঠান হয়েছিল। বাংলাদেশে তেমন কিছু হয়নি বলে তিনি আক্ষেপ করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল দেশভাগের ফলে ‘আগে বাঙালি পরে হিন্দু-মুসলমান’ বাঙালির এই সঙ্গত আত্মপরিচয় বিনষ্ট হয়েছিল বটে, কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির ফলেই পূর্ব-বাংলায় মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটে। এই মধ্যবিত্তরাই ‘‘অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্দীপিত’’, ‘‘বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির তীব্র অনুরাগী’’। তাঁদের হাতেই ‘‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা’’ (‘ফিরে দেখা: ১৯৪৭’)। তিনি নিজের চোখেই দেখেছিলেন ১৯৭১-এর ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম’ যে বাংলাদেশের জন্য তাঁরা লড়াই করেছিলেন, সেই বাংলাদেশের রূপ পরে বদলে গেল। শুধু কি তাঁর দেশের রূপ বদলেছে? সাম্প্রতিক কালে ভারতের চরিত্র-বদলও কি তাঁকে ভাবায়নি? ‘সাংস্কৃতিক বহুত্ব’-তে স্পষ্ট লিখলেন, ‘‘নিজের দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা খুইয়ে আমি যেমন দুঃখিত, তেমনি ভারতে হিন্দুত্বের জাগরণে আমি ভীত।’’ তাঁর মন ধর্মের এই আগ্রাসনে বিচলিত, তাই সেই উৎকণ্ঠার প্রতিষেধক হিসেবে তিনি বাঙালির ভাষিক আত্মপরিচয়-সন্ধানে ব্রতী— এই আত্মপরিচয় ধর্মের বহুত্বকে স্বীকার করে। প্রাগাধুনিক থেকে শুরু করে আধুনিক পর্বে বাঙালি জাতিসত্তা নির্মাণের উপাদানগুলিকে তিনি যাচাই করেন। তাঁর সাহিত্য-বিচার বাঙালি জাতিসত্তার নির্মাণের ইতিহাস অনুসন্ধান।
তাঁর প্রথম বই ‘মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য’ প্রকাশ করেছিল পাকিস্তান লেখক সঙ্ঘের পূর্বাঞ্চল শাখা। ১৯৬৪ সালে বইটি যখন ঢাকায় প্রকাশিত হয়েছিল, তখন ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানেরা তাঁদের ভাষিক আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দীনেশচন্দ্র সেন, সুকুমার সেন সাহিত্যের ইতিহাস লিখতে গিয়ে বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদানের বিষয়টি নিয়ে প্রথমে খানিক নীরব। পরে অবশ্য তাঁরা ফাঁক পূরণে সচেষ্ট। এমনিতে দীনেশচন্দ্র ও সুকুমার সেন কেউই সঙ্কীর্ণচিত্ত মানুষ ছিলেন না। জসীমউদ্দীনের কবি-খ্যাতি প্রতিষ্ঠায় দীনেশচন্দ্রের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ‘বিচিত্রা’ পত্রের বৈশাখ ১৩৩৭ সংখ্যায় সে বইয়ের দীর্ঘ আলোচনা করেন দীনেশচন্দ্র। ‘বিচিত্রা’তেই প্রকাশিত হয়েছিল দীনেশচন্দ্রের প্রবন্ধ ‘বঙ্গভাষার উপর মুসলমানের প্রভাব’ (মাঘ, ১৩৩৫)। সুকুমার সেন আলাদা করে ‘ইসলামি বাংলা সাহিত্য’ লিখেছিলেন— এ যেন তাঁর সাহিত্যের ইতিহাসের বইয়ের খণ্ডগুলির পরিপূরক।
তবে দীনেশচন্দ্র বা সুকুমার সেন, কেউই ‘আধুনিক’ মুসলিম মানসের সঙ্কট দেশ-কালের প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করেননি। আনিসুজ্জামান সে কাজটিই করেছিলেন। তাঁর বইতে বাঙালি মুসলমানের সাহিত্য ও চিন্তাধারায় পৌঁছনোর আগে ১৭৫৭ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত কালপর্বে বাঙালি-মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের বিশ্লেষণ করেছিলেন। ভাষিক আত্মপরিচয়ের চরিত্রটি বুঝতে গেলে এই অবস্থানটি জানা চাই। ১৯৭১ সালে এ-বইয়ের পুনর্মুদ্রণ হয় ভারতে— ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ লেখক নীহাররঞ্জন রায় ‘ভূমিকা’য় জানিয়েছিলেন পূর্ব বাংলায় তাঁর জন্মভূমিতে ‘‘এক নবজন্মের সূচনা হচ্ছে।’’ ১৯৭৫ সালে নাফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আনিসুজ্জামান ‘টুওয়ার্ডস আ রিডেফিনিশন অব আইডেন্টিটি: ইস্ট বেঙ্গল, ১৯৪৭-৭১’ নামের প্রবন্ধ পড়েন, সে বছরেই সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহের অনুরোধে পড়েন, ‘দি ওয়ার্ল্ড অব দ্য বেঙ্গলি মুসলিম রাইটার্স ইন নাইন্টিনথ সেঞ্চুরি (১৮৭০-১৯২০)’। মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক বিপ্লব দাশগুপ্ত সে সভায় ছিলেন। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, আনিসুজ্জামানের লেখায় সাম্প্রদায়িকতার রেশ থাকতে পারে। পরে বিপ্লব স্বীকার করেন, বাঙালি মুসলমানের চিন্তাজগতের খোঁজ নেওয়া মানেই ভেদাভেদের রাজনীতি নয়।
বাঙালির আত্মপরিচয়ের স্বরূপ বুঝতে গেলে যেমন মুসলমান মানসকে গুরুত্ব দিতে হবে, তেমনই জানা চাই বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যবর্তী নানা টানাপড়েন। চিনতে হবে ক্ষমতার প্রান্তে থাকা স্বরগুলিকে। ১৪০১ শারদীয় সংখ্যা ‘এক্ষণ’-এ প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রবন্ধ, ‘বাঙালি নারী/ সাহিত্য ও সমাজে’। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আনুগত্য আদায়ে মুসলমানি নীতিশাস্ত্র-রচয়িতারা যে বেশ খড়্গহস্ত, তা জানাতে ভোলেন না। ‘‘স্বামী ক্রুদ্ধ হলেও স্ত্রী উত্তর দেবে না, বরঞ্চ করজোড়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবে’’ জাতীয় নির্দেশ অমান্য করে কী ভাবে উনিশ শতকেই ‘‘নারীকে মানুষ বলে দেখা ও ভাবার সূচনা হয়’’, তা ধাপে ধাপে লিখেছিলেন।
এ লেখায় হিন্দু-মুসলমান দুই বাঙালির কথাই এসেছিল। জানা চাই খেটে-খাওয়া বাঙালিদের কথাও। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকা-কুঠির কাগজপত্র ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে দেখেছিলেন তিনি। ঢাকা কুঠির অধীনে ঢাকা, ময়মনসিংহ আর ত্রিপুরায় কোম্পানির আটটি আড়ং ছিল। কোম্পানির ফরমাশ মতো তাঁতিরা এখানে কাপড় বুনে জমা দিতেন। গোমস্তা দাদন দিয়ে কাপড় তৈরি করাতেন। গোমস্তার পছন্দ না হলে, কাপড় বুনেও দাম পাওয়া যেত না। বঙ্গদেশের ‘‘সংখ্যাগুরু মুসলমানেরা মূলত এদেশীয় অমুসলমানদের উত্তরপুরুষ’’, ফলে বঙ্গদেশে মুসলিম সমাজে এক বর্ণবিন্যাস গড়ে উঠেছিল। ওপরের স্তরে থাকতেন বহিরাগত মুসলমানরা। ইংরেজ আমলে বঙ্গদেশে কৃষক ও অন্যান্য শ্রমজীবী মুসলমানদের অত্যাচার সইতে হয়। নবাবি আমলে জমিদার ও ইজারাদার হিসেবে বাঙালি হিন্দুর প্রাধান্য— ইংরেজ আমলে এঁরাই নতুন জমিদার, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর বঙ্গের ধনবান হিন্দুরা নিজেদের পুনর্গঠিত করলেন। সূত্রগুলি স্মরণে রেখে দরিদ্র বাঙালি মুসলমানের সঙ্কট বুঝতে চাইছিলেন তিনি। কথাটা রবীন্দ্রনাথও ‘গোরা’ ও ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে এনেছিলেন।
বাঙালির আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের সূত্রে যে বয়ান গড়ে তুলেছিলেন তিনি, তা যুক্তিনিষ্ঠ ভাবে সব কথাই বলে, চেপে যায় না কিছু। ভেতো বাঙালির যা প্রধান খাদ্য, তা যে অস্ট্রিকভাষীর দান। বাঙালির স্বভাষা গড়ে ওঠার আগে নানা নৃ-জাতি প্রবল। তাদের সাংস্কৃতিক উপাদান বাঙালির মধ্যে। এই নানাত্ব নিয়েই ভাষার ঐক্যে বাঙালি, বাঙালি। তাই পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন বা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মও অনিবার্য ছিল। সেই বাংলাদেশের একাত্তরের রূপ আর রইল না বলে কষ্ট পেয়েও বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতির উদার রূপটি বজায় রাখার লড়াই জারি রেখেছিলেন আনিসুজ্জামান।
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy