বাঙালির নববর্ষ সমাগত। এই বৈশাখে নূতন বৎসরে সামূহিক ভাবে বাঙালি নিজেদের জন্য কী করিতে পারে? যদি সত্য কিছু করিবার ইচ্ছা থাকে তাহা হইলে ‘বাঙালি’ এই আত্মপরিচয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করা প্রথম কর্তব্য। ‘বাঙালি’ বলিতে কোনও ধর্মীয় গোষ্ঠীকে বুঝায় না। কোনও নির্দিষ্ট ভাষার গণ্ডিতে বা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সীমায় এই বাঙালিকে আটকাইয়া রাখিবার প্রয়োজনও নাই, জো-ও নাই। ইহা এক সংস্কৃতিগত সচেতনতা। বাঙালি সামূহিকতার বোধটি সেই সংস্কৃতি বোধ হইতে গড়িয়া উঠিয়াছে। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, জৈন, বৌদ্ধ যে কেহই বাঙালি হইতে পারেন। বাঙালি হওয়ার জন্য প্রাত্যহিক ভিত্তিতে বাংলাভাষী হইবারও দরকার পড়ে না। সংস্কৃতির একটি উপাদান ভাষা, কিন্তু একমাত্র উপাদান নহে। বাংলা ও বাঙালি যাঁহার উৎস ও নির্ভর, তিনিই বাঙালি। পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, ইংল্যান্ড, আমেরিকা – নানা স্থানে নানা রকম বাঙালির অধিষ্ঠান। এমনকী পশ্চিমবঙ্গেও নানা রকম বাঙালির নিবাস। তাই বলা যায়, প্রত্যক্ষ ভাবে বাংলা ভাষাভাষী না হইলেও বাংলা ভাষার সহিত একটি পরোক্ষ সংযোগ এই নানা রঙের নানা মতের বাঙালি সংস্কৃতির একটি জরুরি উত্তরাধিকার। তাই বাংলা ভাষার পরিচর্যাও বাঙালির অন্যতম গুরুতর কর্তব্য।
বাংলা ভাষার এ এক মহা সংকট কাল, এমন কথা অনেকেই ইদানীং বলিয়া থাকেন। বিশ্বায়ন পরবর্তী পর্বে বিশ্বের বহু ভাষার অস্তিত্বের সংকট প্রবল হইয়াছে। বাংলা ভাষার পালেও ‘মন্দার’ বিরুদ্ধ হাওয়া লাগিয়াছে। কিন্তু কেবল ভাষা লইয়া হাহাকার করিলে, ডাক ছাড়িয়া কাঁদিলে ভাষা বাঁচে না। যাঁহারা ভাষা হইতে দূরে যাইতেছেন তাঁহাদের ফিরাইবার ব্যবস্থা চাই। চাই ভাষাশিক্ষা ও ব্যবহারের আয়ুধ বা টুল, চাই বাংলা ভাষায় উপভোগ্য সাংস্কৃতিক পণ্য। ইতিহাসের সাক্ষ্য-প্রমাণ বলিতেছে ঊনবিংশ শতকে বাংলা ভাষার গাঙে জোয়ার আসিয়াছিল। প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলা ভাষায় নানারকম পদ্য রচিত হইলেও বাংলা গদ্যের সর্বাত্মক বিকাশ তখন হয়নি। গদ্যের ব্যবহার ক্ষেত্র ছিল ক্ষীণ। ঊনবিংশ শতকে বাংলা ভাষাকে সর্বক্ষেত্রে ব্যবহার করিবার জন্য এই ভাষাকে বাঙালি চিন্তাবিদেরা গড়িয়া পিটিয়া লইয়াছিলেন। বাংলা ভাষায় গদ্য আসিল। পদ্যের ভাবের ভাষা গদ্যে জ্ঞানের ভাষা, ব্যবহারিকতার ভাষা হইয়া উঠিল। ভিনদেশি ঔপনিবেশিক শাসনে বাঙালি বুঝিল বাঁচিয়া থাকিতে হইলে ভাষিক আত্মপরিচয়ের নবনির্মাণ আবশ্যিক। অভিধান নির্মিত হইল, পরিভাষা গড়িয়া তোলা হইল, অপর ভাষার জ্ঞানকে অনুবাদে স্থানীয় সাধারণ মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করা হইল – আর উন্নত মানের সাহিত্য রচনায় অনেকে ব্রতী হইলেন। এক ধাক্কায় চণ্ডীমণ্ডপের সীমা ছাড়াইয়া বাঙালির ভাষা-কৃষ্টি বিশ্বচারী হইল। অপরাপর প্রতিবেশী ভারতীয় ভাষাগুলির তুলনায় বাংলা অধিকতর অগ্রসর হইল।
ঊনবিংশ শতকে বাঙালি যাহা পারিয়াছিল একবিংশ শতকে বাঙালি তাহা পারিবে না কেন ! ভাষার পরিপুষ্টি সাধনের জন্য নিত্য নূতন পরিকল্পনা চাই। বাংলাদেশের বাঙালি তাঁহাদের রাষ্ট্র ভাষার জন্য অনেক কিছু করিতেছেন , কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি! এই বঙ্গে শেষ কবে উত্তম অভিধান প্রণীত হইয়াছে! পশ্চিমবঙ্গে সরকারি বাংলা আকাদেমি রহিয়াছে। তাঁহারা ভাষার উন্নয়ন কল্পে মনে রাখিবার মতো কী প্রসব করিয়াছেন? গতানুগতিক গ্রন্থাদি ছাপিবার বাহিরে তাঁহাদের কাজ কী? অন্তর্জালের সুবিধা লইয়া বাংলা গ্রন্থের পাঠক্ষেত্র বিস্তৃত করা যাইতে পারে, কিন্তু তেমন কাজ কই! কাজ করিব না, হাহাকার করিব এ কেমন কথা! নববর্ষে বাঙালির শপথ হউক ভাষার পরিচর্যা – ও বাংলার মতো এ বাংলাতেও ভাষা ভালোবাসিয়া বাঙালি কিছু করুন।
যৎকিঞ্চিৎ
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘প্রভু তোমা লাগি আঁখি জাগে, দেখা নাই পাই, পথ চাই, সে-ও মনে ভাল লাগে।’ মানেটা এত দিনে বোঝা গেল। ১৯ এপ্রিল রামলীলা ময়দানে সনিয়া গাঁধী কৃষকসভা ডেকেছেন। সেই সভায় নাকি রাহুল গাঁধী দেখা দেবেন। অতএব দলীয় মনসবদারদের উদ্দেশে হাই কমান্ড জারি হয়েছে: সভা যেন সাফল্যমণ্ডিত হয়। সত্যিই কি সে সভায় তেনার আবির্ভাব হবে? মনসবদাররা জানেন না। তবু তাঁরা মনের সুখে লোক জোগাড় করছেন। সুখের রহস্য? কবিগুরু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy