অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ
ফেক নিউজের বাংলা গুজব। গুজব নানা ভাবে ছড়ানো যায়। যুদ্ধের ময়দানে দ্রোণাচার্যকে বিভ্রান্ত করতে যুধিষ্ঠির চেঁচিয়ে বললেন, ‘অশ্বথামা হত’, তার পর মৃদু গলায় বললেন, ‘ইতি গজ’। এর ফলে দ্রোণাচার্য ভেঙে পড়লেন যুদ্ধের ময়দানে। এটাই সম্ভবত সব থেকে প্রাচীন ফেক নিউজ।
১৮৩৫ সালে ‘নিউইয়র্ক সান’ পত্রিকা একটা সিরিজ ছেপেছিল। সেখানে ছবিতে দেখানো হল, চাঁদে এক দল বাদুড়ের মতো মানুষ, নীল রঙের ছাগল ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার পাশেই নীলকান্তমণি (sapphire) দিয়ে তৈরি প্রাসাদ। বলা হল, ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন হারসেল (John Herschel) দক্ষিণ আফ্রিকার একটি অবজারভেটরি থেকে একটি জোরালো টেলিস্কোপ দিয়ে চাঁদের এই ছবিগুলি তুলেছেন। এরা সব চাঁদের প্রাণী। কয়েক দিনের মধ্যেই নিউইয়র্ক সান-এর বিক্রি ৮ হাজার থেকে বেড়ে হয়ে গিয়েছিল ১৯ হাজার।
কম্মটি করেছিলেন সান-এর সম্পাদক রিচার্ড অ্যাডামস লক। ঘটনা হল, সত্যিই ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন হারসেল দক্ষিণ আফ্রিকার একটি অবজারভেটরিতে গবেষণা করছিলেন টেলিস্কোপ নিয়ে। কিন্তু ছবি বা ওই রিপোর্ট কোনওটাই তিনি পাঠাননি। সবটাই সান-এর অফিসে বসে বানানো হয়েছিল কাগজের বিক্রি বাড়াতে। সানের সম্পাদক জানতেন, দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে চিঠি ছাড়া যোগাযোগ করা সম্ভব নয়, ফলে সত্য প্রকাশ হতে হতে মাস পেরিয়ে যাবে। তত দিনে তাঁর ব্যবসা অনেকটা এগিয়ে যাবে। লোকেও ভুলে যাবে। ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে যে গল্পটা জড়িত, রানি বললেন, রুটি না থকলে ওরা কেক খাক, সেটাও সম্ভবত ছিল ফেক নিউজ।
২২-২৩ বছর আগে কলকাতায় আমরা ‘দেখেছিলাম’ গণেশকে দুধ খেতে। হাজার হাজার মানুষ জড়িয়ে পড়েছিল ওই ফেক নিউজে। তারও আগে, কংগ্রেস নেতা প্রফুল্ল সেনের স্টিফেন হাউজ কিনে নেওয়ার প্রচারও ছিল একটি রাজনৈতিক ফেক নিউজ। নন্দীগ্রামে শিশুদের পা ধরে ছিঁড়ে ফেলার প্রচারও ছিল ফেক নিউজ।
এত ক্ষণ যা বলা হল, তা সামান্যই। দৃষ্টান্তের শেষ নেই। এ সব হল ফেক নিউজের অতীতের কথা। অতীতের এই ঘটনাগুলো ছিল অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। কিন্তু বর্তমানের ফেক নিউজ, বিশেষ করে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক ফেক নিউজের আড়ালে একটি রাজনৈতিক-সাংগঠনিক শক্তিকে কাজ করতেদেখা যাচ্ছে। ইন্টারনেট এবং হোয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুক ইত্যাদি ব্যবহার করে আজকের ফেক নিউজ অনেক বেশি ক্ষতিকারক লক্ষ্যে কাজ করছে। ফেসবুককে ব্যবহার করে মার্কিন নির্বাচন এবং তাতে রাশিয়ার ভূমিকা নিয়ে এখনও কথা চলছে। আমাদের দেশে ২০১৪-র লোকসভা ভোটে প্রথম দেখা গেল সোশ্যাল মিডিয়ার দাপট। শুধু তাই নয়, সোশ্যাল মিডিয়াকে চালিত করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিশেষ সেল তৈরি করল এই সময়েই।
একটি বিদেশি সংবাদ মাধ্যম ভারতের ফেক নিউজ নিয়ে খুব বড় মাপের সমীক্ষা এবং গবেষণা চালায়। তাতে যা উঠে এল, সেটা আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সঙ্গে বেশ মিলে যায়। সেই গবেষণায় বলা হয়েছে, ভারতে ফেক নিউজের বেশির ভাগটাই শাসকদলের পক্ষে। সেখানে গবেষণায় উঠে এসেছে কী ভাবে গরু, গোমাংস ইত্যাদি বিষয়ে ফেক নিউজ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে আর উন্মত্ত জনতা পিটিয়ে মানুষ খুন করছে। এবং নিহতেরা সবাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। এমন ৩৩টি মৃত্যুর উল্লেখ রয়েছে ওই গবেষণায়।এবং এই সব ফেক নিউজ ছড়ানো হচ্ছে সুপরিকল্পিত ভাবে।
২০১৭ সালে রাজস্থানের কোটায় সোশ্যাল মিডিয়া ভলান্টিয়ারদের এক সভায় বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ (দৈনিক ভাস্কর এবং দ্য ওয়্যার-এর রিপোর্ট) বলেন, “সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেই আমরা রাজ্যে, কেন্দ্রে সরকার গড়ব, আপনারা শুধু মেসেজ ছড়িয়ে দিন প্রতিদিন যা ভাইরাল হবে।” কী ধরনের মেসেজ? অমিত শাহ বলছেন, “আমাদের ৩২ লাখের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে। এক জন সোশ্যাল মিডিয়ার কর্মী সেখানে লিখে দিয়েছিল— অখিলেশ মুলায়মকে চড় মেড়েছে। বাস্তবে এমন কিছু ঘটেইনি। কিন্তু খবরটা ভাইরাল হয়ে গেল। এই ধরনের কাজ করা উচিত নয়। কিন্তু আবার এটাও ঠিক, ওই মেসেজ একটা ‘মহল’ তৈরি করতে পেরেছিল। যেটা আমরা করতে চাই। কিন্তু এমন কাজ কখনও করবে না।” উপস্থিত কর্মীরা সবাই হেসে উঠলেন। অমিত শাহ আবার বললেন, “আমি কী বলছি আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন।”
এই সংগঠিত ফেক-বাহিনীর পাশে আছে এক বিরাট অসংগঠিত ফেক-বাহিনী। দুটো উদাহরণ দেওয়া যাক। বছর খানেক আগে ফেসবুকে একজন একটা চটির ছবি ছেপে বললেন, চটিটি পাকিস্তান থেকে কেনা। চটির বৈশিষ্ট্য কী? সেই চটিতে বিষ্ণুর ছবি আছে। ছবিতে দেখাও যাচ্ছে সেটা। শুরু হয়ে গেল কমেন্ট। পাকিস্তানকে এখনই কী কী শিক্ষা দেওয়া উচিত, মুসলিমরা কেন কমেন্ট না করে চুপ আছে, এবং তাদের প্রতিও আমাদের আচরণ কী হওয়া উচিত ইত্যাদি ইত্যাদি। হঠাৎ দেখা গেল একজন লিখলেন, ‘এই চটিটা যে পাকিস্তান থেকে কেনা তার কোনও প্রমাণ আছে? কোনও ক্যাশমেমো বা সেই দোকানে এমন চটি সাজিয়ে রাখার ছবি? অমনি সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল, ‘তুই কে প্রমাণ চাওয়ার, তোর অ্যাকাউন্টটাই ফেক, তুই আসলে মুসলমান, হিন্দু নাম দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলেছিস’ ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ কোনও প্রমাণের দরকার নেই, কোনও প্রমাণ চাওয়াও যাবে না। যা বলব সেটাই মেনে নেওয়া। এক বিশেষ ধরনের খবর প্রমাণহীন ভাবে মেনে নেওয়ার লোক-সংখ্যাও কিন্তু বাড়ছে, অন্তত সোস্যাল মিডিয়ায়।
আর একটা ‘খবর’ হয়তো অনেকেরই চোখে পড়েছে। সেটা প্রত্যেক বছর ছড়ানো হয় ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র সময়। লেখা হয়, ওই একই দিনে ভগৎ সিং-এর ফাঁসি হয়েছিল, অথচ ভারতীয় কিশোর-যুবকরা ভগৎ সিংকে ভুলে গিয়ে ভ্যালেন্টাইস ডে পালন করছে। ঘটনা হল দুটি তারিখ মোটেই এক নয়, এক মাসেরও বেশি তফাৎ দুই তারিখে। অথচ দেখা যায়, কেউ প্রশ্ন করছেন না। কমেন্টে কেউ লিখছেন ছিঃ, কেউ লিখছেন ভ্যালেন্টাইওয়ালাদের পেটাও তবেই দেশ বাঁচবে।
পশ্চিমবঙ্গে যে কয়েকটি ছোট-খাট সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়ে গেছে গত কয়েক বছরে, সেখানে দেখা গিয়েছে এই ধরনের ফেক নিউজ। একটি ভাইরাল ভিডিয়োতে দেখা গেল, এক মহিলার উপর এক দল লোক প্রকাশ্যে শ্লীলতাহানি করছে, যা আসলে ভোজপুরি সিনেমার ক্লিপিং, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে বলা হয়েছিল হিন্দু মহিলার উপর অত্যাচারের ছবি। উত্তরপ্রদেশের একটি সংঘর্ষের বাড়ি ঘর জ্বালানোর ছবিও এই রাজ্যের বলে চালানো হয়েছিল সেই সময়ে।
এই পৃথিবীতে হিটলারের নাম যত লোক জানেন, তার থেকে বেশিই হয়তো গাঁধীর নাম জানেন। তবু আজও ঘৃণা প্রচার করা অনেক সহজ। ভারতে ২০ কোটি মানুষ স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেন। যা ইংল্যান্ডের জনসংখ্যার প্রায় সাড়ে তিন গুণ। ফলে অভিসন্ধিমূলক গুজব ছড়ানোর বাজার তৈরি হয়েই আছে। যে যার মতো করে সেটা ব্যবহার করছে। এই বিপজ্জনক খেলা সহজে শেষ হবে না। আরও অনেক মূল্য দিতে হবে।
গ্রাফিক ও অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy