সেলিনা বেগম।
আমি ড্রাইভার। তা-ও আবার অ্যাম্বুল্যান্স চালাই।আমার চাওয়া-পাওয়া, সমাজকে দেখা, সবটাই আর পাঁচটা মেয়ের চেয়ে আলাদা। আমি এই আলাদা হয়ে থাকাটা চাইনি। কেনই বা চাইব? কিন্তু এই যে শিক্ষিত বা শিক্ষার আলো না পড়া মানুষের দল, পুরুষের দল আমায় আলাদা করে রেখেছে।আলাদা ওরা করবেই। একটা মেয়ে একটা ছেলের মতো গাড়ি নয়, অ্যাম্বুল্যান্স চালায়। ছেলেদের মতো শার্ট প্যান্ট পরে। মাঝ রাতে গাড়ি বার করে যেখানে খুশি চলে যায়— এ সব শহর, গ্রাম, মফস্সল, কোথাওই মেনে নেয়নি। এ দিক দিয়ে দেখলে আমি আমার জীবন দিয়ে দেখেছি সব এক!
এই যে আড়চোখে দেখা, কেন? বাবা, দাদা, কাকা, কারও কাছে কি হাত পাতছি? পয়সা চাইছি? নাহ! তবুও মানুষের অসুবিধা! আমি কি জন্ম থেকেই ভেবেছিলাম অ্যাম্বুল্যান্স চালাব? এই সমাজে শুনেছি শিক্ষার দাম আছে। দক্ষিণ হেমতাবাদের বাসিন্দা আমি। আশি ছুঁই ছুঁই দিনমজুর নাজিরুদ্দিন আহমেদের আট ছেলেমেয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট মেয়ে। এত বড় পরিবার। ঠিকমতো খাওয়া জুটত না।ভাইয়েরা শুনেছি কাজে যাবে। টাকা রোজগার করবে। তাই ওদের খাওয়ার দিকে আমাদের পরিবারের নজর দেওয়া হত। এ সবের মধ্যে না খেয়ে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করলাম। পড়াশোনা করলেই নাকি মেয়েরা নিজের পায়ে দাঁড়ায়? বড় হয়? কি বলে সমাজ? হল না তো! কেউ বলেনি খেতে না পাওয়া পরিবার থেকে এ ভাবে লড়াই করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া মেয়ে, ওকে একটা চাকরি দেওয়া হোক! সেমিনার, মিছিল, প্রকল্প,কেউ না!
সব বড় বড় কথা। বিএসএফ-এর পরীক্ষায় আমি সবকিছুতেই উতরে গিয়েছিলাম। শুধু মেডিক্যালে আনফিট হয়ে গেলাম বলে চাকরিটা হল না। শুধু ঠোক্কর খেয়ে গিয়েছি। থামিনি। ভেতর থেকে মনে হত, দেখি না আর কী কী সামনে আছে? আজও সমাজে মেয়েদের মেরে ফেলা হয়। মেয়েরা পরের বাড়ি যাবে। তাদের বিয়েতে টাকা লাগবে। ঘরে ঘরে মানুষ ছেলে চায়। হাসি পেয়েছিল আমার! দেখলাম আমার দাদারা সবাই বলল, ওরা কেউ মা-বাবাকে খাওয়ায়াতে পারবে না।+
আরও পড়ুন-নারী-পুরুষ এবং বিভাজনের বোধ রোজ ভাঙছে-গড়ছে বলিউড
ভাবলাম পারব। এটাও আর এক বাধা। প্রাইভেট টিউশন শুরু করলাম। আমার বড়দি কোহিনূর বেগম হেমতাবাদ বাজারে দর্জির কাজ নিল। মেয়েরাই পারে! পারছে ও!তবে সেই ছোটবেলার মতো হাল। কোনওমতে শাক-ভাত! এ বার সুযোগ হল। স্বনির্ভর দলের মাধ্যমে। অ্যাম্বুল্যান্স চালক হওয়ার ট্রেনিং।আমি আর কোনও দিকে তাকাইনি।
দেখুন কী বলছেন সেলিনা...
রাস্তা। এ বার রাস্তা আর হাতে স্টিয়ারিং আমার, আমাদের পেট ভরানোর দায়িত্ব নিল। চব্বিশ ঘণ্টা ফোন খোলা। মা ভয় দেখাত ছোটবেলায়, অন্ধকাররাত, বাইরে যেতে নেই! আজ মাঝ রাতেই বেরোতে হয় আমায়। আমি সাধারণ মেয়ে। সংসার চাই। লোকে কী বলে? “ড্রাইভার খারাপ জাত।তার ওপর মেয়েমানুষ,অ্যাম্বুল্যান্স চালায়। ওকে কে বিয়ে করবে?”
আরও পড়ুন-ভারতের সব নিপীড়িত গোষ্ঠীকে সাহস জোগাচ্ছে শাহিনবাগ-পার্কসার্কাসের মেয়েমুখেরা
কেউ আবার আমায় কি বিয়ে করবে? আরে, আমি কাউকে বিয়ে করব না। ওরা কি জানে, আমার অ্যাম্বুল্যান্স চড়ে মায়ের পেট থেকে যখন নবজাতকের জন্ম হয়, সেটা দেখার আনন্দ কী? হার্ট অ্যাটাক হওয়া মানুষ তো আমার গাড়ি চড়েই দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে জীবন পায়।
জেনে রাখবেন আপনারাও, হেমতাবাদের সেলিনা প্রাণ বাঁচানোর নেশায় আজ ভোরের পথে কালোরাত্রির সঙ্গে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy