Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলা ভাষার জন্য কড়া নাড়া

ভাষা নিয়ে যুক্তিসিদ্ধ আলোচনার দিকে এগোতে চাইলে বোঝা দরকার— বাংলা ভাষার পরিত্রাতাদের ‘আমরা’-নামক পতাকার নীচে জমায়েত করে ভাষী-সমবায় কোথাও পৌঁছতে পারবে না। ভাষামাত্রেরই একাধিক ঠিকানা।

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

প্রবাল দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

বাম জমানায় জেনেছিলাম ‘আমরা-ওরা’ করতে নেই, বনামবিদ্ধতা বিপদ ডেকে আনে। অথচ সে সব শিক্ষা জলাঞ্জলি দিয়ে সে দিনও কে যেন রব তুলেছে, ‘ওদের’ অত্যাচার থেকে ‘আমাদের’ বাংলা ভাষাকে ‘আমরা’ রক্ষা না করলে জাহাজডুবি অবধারিত। সে কণ্ঠ একটু স্তিমিত হয়েছে, কিন্তু উদ্বেগ মিলিয়ে যায়নি। ভারতে গণতন্ত্র বিপন্ন, বাঙালির অধিকার বিপন্ন, কে বাঁচাবে, সেই ভয় ঘুরছে-ফিরছে। শোনা যায়, বিবেকানন্দের স্বপ্নে স্বয়ং কালী দেখা দিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘আমি তোকে বাঁচাই না, তুই আমায় বাঁচাস।’’ অলৌকিক দর্শন নিয়ে বিতর্কের অংশটুকু যদি বাদ দিই, তা হলে বর্তমান সূত্রে সেই স্বপ্নের জের টেনে প্রশ্ন করা যায়, মানুষ ভাষাকে বাঁচায়, না কি ভাষাই বাঁচিয়ে রাখে মানুষকে?

ভাষা নিয়ে যুক্তিসিদ্ধ আলোচনার দিকে এগোতে চাইলে বোঝা দরকার— বাংলা ভাষার পরিত্রাতাদের ‘আমরা’-নামক পতাকার নীচে জমায়েত করে ভাষী-সমবায় কোথাও পৌঁছতে পারবে না। ভাষামাত্রেরই একাধিক ঠিকানা। দু’চার জনের মধ্যে নিরিবিলি কথাবার্তায় যা পাই, তা ভাষার নিভৃত প্রয়োগ। ওই নিভৃতির মাতৃরূপী কোলে বসেই নির্বাক কচি শিশু সবাক হয়ে ওঠে। অন্দরমহলের সেই কারবার চলে দু’রকম ওজনের দুই সদরের সঙ্গে, বারোয়ারি সদর আর শাসকীয় সদর। এ দুটো ভাষার দ্বিতীয় আর তৃতীয় ঠিকানা। এক দিকে ওই প্রাতিষ্ঠানিক ওজন, অন্য দিকে ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে হালকা আলাপচারী, এ দুয়ের মধ্যে ভাষার চতুর্থ ঠিকানা— শিক্ষাব্যবস্থায়, সংস্কৃতিতে, গণমাধ্যমে, সারস্বত মাধ্যমে।

এবং এই চারটে জায়গাতেই বাংলা ভাষার সঙ্গে চার পাশের আলো-হাওয়ার মিথস্ক্রিয়া চলতে থাকে। সেই আলো-হাওয়ায় সংস্কৃত, হিন্দি, ইংরেজির মতো ভাষাও রয়েছে। পদে পদে ওদের সঙ্গে কারবার করতে হয়। সেই কারবারটাকে অদৃশ্য করে দিয়ে বাংলার স্বাতন্ত্র্য গায়ের জোরে আদায় করলে, বা ভিন্ভাষার শব্দের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চললে বাংলার স্বকীয় শক্তি প্রমাণিত হবে ভাবছেন? ‘সুপ্রিম কোর্ট’ না বলে কাল থেকে ‘শীর্ষ আদালত’ বলতে হবে, এই রকম সব ফতোয়া জারি করবেন? সেই কুচকাওয়াজে বঙ্গভাষা বিশুদ্ধি-বাহিনীর মনোবল তুঙ্গে পৌঁছবে। তাকেই বলবেন বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষা?

যে কোনও ক্ষেত্রে যখনই তর্ক বেধেছে, ‘কোন আদর্শ অনুযায়ী চলা উচিত’, তখনই কেউ কেউ গলা চড়িয়ে বলেন, ‘‘বিলেত-আমেরিকায় সব কাজকর্ম চলে অমুক পদ্ধতিতে, আমাদেরও সেই রকমই করা উচিত।’’ ভাষার আদর্শের বেলায় সেটা কেন করা হয়নি? কারণ, ইংরেজ-ফরাসি থেকে চিনা-জাপানি, সবাই যে এক-একখানা ভাষার ছত্রচ্ছায়ায় জাতিরাষ্ট্র তৈরি করেছে। সেই ঘেরাটোপের মধ্যে আদর্শগুলো দাঁড় করিয়েছে। ওই আদলটা তো আমাদের পোষায় না। ভারত সে অর্থে একটা দেশ নয়, দেশাধিক। পৃথিবীতে আর কোথাও ঠিক এই ‘ট্রান্স-নেশন’ ব্যাপারটা রচিত হয়নি। তাই চুপিচুপি উজ্জ্বল ছাত্রের খাতা দেখে টুকে বসিয়ে দিলে আমাদের চলবে না।

ইঙ্গমার্কিন আদল এখানে কাজে না লাগলেও অন্য বিদেশিদের গবেষণার কিছু প্রাসঙ্গিকতা আছে। সেই বিদেশি পণ্ডিতদের কাজকর্মের খেই ধরতে কেউই যে এগিয়ে যাচ্ছেন না, তা নয়। ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে বরেণ্য টোভে স্কুটনাব-কাঙ্গাস, জিম কামিন্‌স ও তাঁদের অনুগামীরা। তাঁরা কয়েক দশক ধরে দেশে-দেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখিয়েছেন যে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিশুকে ইস্কুলের প্রথম ক’বছর সবটা পড়িয়ে নিয়ে, তবে বৃহত্তর সংযোগের ভাষা রপ্ত করবার আয়োজন করা দরকার। এই ব্যবস্থা যদি মধ্যশিক্ষার শেষ দিন অবধি চালু থাকে, তবে তা উভয় ভাষাতেই শিশুকে প্রার্থিত যোগ্যতায় পৌঁছতে পারে। রবীন্দ্রনাথের ‘সমাপ্তি’ গল্পের মৃন্ময়ীকে মনে পড়ে? তার শৈশব থেকে শেষ কৈশোর হঠাৎ বিযুক্ত হয়ে গিয়েছিল। শিক্ষাতে তেমন বিযুক্তি এলে শিশু বিপন্ন হয়। গবেষণাসিদ্ধ পদ্ধতি মেনে ভাষার শিক্ষা এগোলে তেমন হবে না। পড়ুয়াদের আস্ত একটা সাবালক সত্তা গড়ে উঠবে। ওই গবেষণা অনুযায়ী অভিনব শিক্ষাধারা চালু করেছেন অজিত মোহান্তি আর মিনতি পান্ডার দলবল, একাধিক আদিবাসী অধ্যুষিত ইস্কুলে। তাঁরা দেখাতে পেরেছেন যে ভারতের ছোট জায়গাতেও এই পদ্ধতি কার্যকর হচ্ছে। ভাষার সার্থক পঠন-পাঠন নিয়ে এই সব চেষ্টার কথা অধিকাংশের কানে পৌঁছয় না।

তার কারণ, এ দেশে কর্তব্য স্থির হয় সেই অশিক্ষিতদের ধ্বনিভোটে, যাঁরা নিজেদের প্রচণ্ড শিক্ষিত বলে মনে করেন। যাঁরা চরম অনবহিত কিন্তু নিজেদের ওয়াকিবহাল ভাবতে অভ্যস্ত, সেই আত্মসন্তুষ্ট অভিভাবকেরা ভাষা-শিক্ষা-বিষয়ক কোনও বিশেষজ্ঞের কথায় কান দেবেন না

ঠিক করেছেন। তাঁরা সন্তানদের ভর্তি করেন মাতৃভাষা-উপেক্ষাসূত্রে গ্রথিত, প্রি-স্কুল থেকে ইংরেজির মন্ত্রদীক্ষায় আস্থাশীল এক-একখানা কারখানায়। যেগুলির স্থপতিরা আধুনিক শিক্ষাগবেষণায় অ-আ-ক-খ’র ব্যাপারে ওই অভিভাবকদের মতোই অনাগ্রহী।

বিদেশে এবং স্বদেশের নানা গবেষণা ছাড়াও আরও অনেক সূত্র রয়েছে, যা ভাষা শেখা ও প্রয়োগের জীবনীশক্তি বাড়াতে পারে। সেগুলির সঙ্গে পরিচিত হতে পারি আমরা, যদি ইচ্ছেটা জন্মায়। কিন্তু প্রায় প্রত্যেক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির মাথায় (তিনি ভাষা নিয়ে আলাদা করে শিখে থাকুন বা না থাকুন) এই বদ্ধমূল ধারণাটা বসে আছে যে, ভাষাশিক্ষার বিষয়ে তাঁর মন তাঁকে যা যা বলে তা একেবারে ষোলো আনা ঠিক। গণতন্ত্রের ভিত্তি যে অবহিত নাগরিকদের মননপ্রসূত মতামত, সেই ভিত্তি গড়ে তোলার জন্যে নাগরিকদের যে বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে অবহিত হওয়া দরকার, সে কাজ করতে গেলে যে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য ধৈর্য ধরে শোনাও চাই, এই কথাটুকু বোঝাতে বিস্তর বেগ পেতে হয়। ভাষাকে বিশেষজ্ঞদের কাজের এলাকা বলে নাগরিক চিনতেই শেখেনি।

আজকে বাংলাভাষী মানুষের যে সঙ্কটের অনুভূতি হচ্ছে, যার ফলে অনেক মূল্যবোধও বিপন্ন বলে মনে হচ্ছে, সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সবাইকে ভাষার বিষয়ে চিরাচরিত আত্মতৃপ্তি কাটিয়ে উঠতে হবে। পরস্পরের চর্চার বিষয়ের দিকে তাকাতে হবে, তা থেকে শিখতে হবে। না হলে গণতন্ত্র কোথাও রক্ষা পাবে না, ভারতে তো নয়-ই। ‘আমরা-ওরা’ বনামবাজির ব্যাধি সারাতে হলে, ভাষার বিষয়ে ভাবনা থেকেও ওই বিষের অঙ্কুরগুলোকে নির্মূল করতে হবে। আর বুঝতে হবে, বিশেষজ্ঞরা যেটুকু যা খেই ধরতে পেরেছেন, ভাষার শিক্ষা আর চর্চায় সে সবের সাহায্য নিলে ক্ষতি নেই। তাঁদের ভুল ধরতে হলেও তো তাঁদের বক্তব্য জানতে হবে। সেই জন্যই এত বার কড়া নাড়ছি।

অন্য বিষয়গুলি:

Indian Languages Bengali Language
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy