কর্নাটক হাইকোর্টের এক বিচারপতি সম্প্রতি বলিয়াছেন, ধর্ষণের পর নিদ্রা ভারতীয় নারীর পক্ষে অশোভন। শুনিয়া দেশের ঘুম ছুটিয়াছে। ইহা কেমন বিচার? মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, তাই নানা ব্যক্তির স্বভাবে-আচরণে সাদৃশ্য থাকিবে, তাহা প্রত্যাশিত। কিন্তু কোনও একটি পরিস্থিতিতে সকল ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া সর্বদা একই রকম হইবে, এমন প্রত্যাশা অর্থহীন। কোর্টে নির্যাতিতা জানাইয়াছেন, ধর্ষণের পরে শ্রান্ত অবস্থায় তিনি ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন। বিচারপতি তাহাতে ধর্ষণের সত্যতা সম্পর্কে সন্দিহান হইয়াছেন। এমন মনোভাব উদ্বেগের কারণ। ওই মহিলা যে রাতে অভিযুক্তের সহিত দেখা করিতে দফতরে গিয়াছিলেন এবং এক সঙ্গে মদ্যপান করিতে আপত্তি করেন নাই, তাহাও উল্লেখ করিয়াছেন বিচারপতি। ধর্ষণে অভিযুক্ত জামিনে মুক্তি পাইয়াছেন। বেশ কথা, কিন্তু ‘ভারতীয় নারী’-র ছাঁচ হইতে ভারতের মেয়েদের মুক্তি মিলিবে কবে? বলিউডের ছবি, টিভি সিরিয়াল মিলিয়া যে ছাঁচ খাড়া করিয়াছে, সেই ‘ভারতীয় নারী’ জীবন্ত মানুষের প্রতিকৃতি নহে। সেই নারী সংসার ও সন্তানপালনে সর্বশক্তিময়ী, কিন্তু পুরুষের অন্যায় আবদারে অসম্মতি জ্ঞাপনের শক্তি তাহার নাই। খাইবার, শুইবার, বন্ধুত্ব করিবার বিষয়ে স্বাধীন ইচ্ছার প্রকাশ তাহার পক্ষে বেয়াদবি। এই কারণেই তৃণমূল দলের এক নেতার বিরুদ্ধে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ উঠিলে পশ্চিমবঙ্গের এক মন্ত্রী বলিয়াছেন, অভিযুক্তের সহিত নির্যাতিতা তরুণীর ‘সম্পর্ক ছিল’। যেন বন্ধুত্ব বা প্রেমের সম্পর্কে সম্মতি থাকিলে যৌন সম্পর্কে অসম্মত হইবার অধিকার মেয়েদের নাই। যৌন নির্যাতনের ঘটনা সংবাদে আসিলেই নেতা-মন্ত্রীদের এমন অসংবেদী মন্তব্য শুনা যায়। বাক্য শক্তিমান, তাই তাহার ব্যবহারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। যাঁহার বাক্যের যত বেশি শ্রোতা, তাঁহাকে তত বেশি সতর্ক হইতে হইবে।
এমন আরও একটি মন্তব্য সম্প্রতি শুনা গিয়াছে। গুয়াহাটি হাইকোর্ট বলিয়াছে, বিবাহের চিহ্নস্বরূপ শাঁখা-সিঁদুর না পরিবার অর্থ, বিবাহকে স্বীকার করিতে অনিচ্ছা। একবিংশ শতকের ভারতে কয়েক দিনের মধ্যে ভারতীয় নারীর আচরণবিধি নির্দিষ্ট করিল দুইটি আদালত। বর্ণ-জাতি-লিঙ্গ, একটি পরিচিতি দিয়া এক গোষ্ঠীর সকল মানুষকে একটিই ছাঁচে ঢালিবার চেষ্টা কেবল ভ্রান্ত নহে, অন্যায়। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তুলনায় ক্ষমতাহীন গোষ্ঠীগুলির উপর আচরণের এমন শর্ত আরোপ করিয়া থাকে। বিবাহিত নারীকে শাঁখা-সিঁদুর পরিতে হইবে, বধূর জন্য নির্দিষ্ট কর্তব্য পালন করিতে হইবে, না হইলে তাহার ‘স্ত্রী’ পরিচয় লইয়া টানাটানি পড়িবে। বিবাহিত পুরুষের বেশবাস বা কর্তব্যপালনের কোনও বিধি নাই, তাহার স্বামিত্ব সর্বাবস্থায় প্রশ্নাতীত। ধর্ষণের মামলার বিচারে প্রাথমিক পর্যায়েও বিধিলঙ্ঘনের দায় ধর্ষিতার উপরেই আসিয়া পড়ে। পুরুষ নিয়োগকারী অধস্তন মহিলা কর্মীকে রাত্রে দফতরে ডাকিয়া মদ্যপান করিলে কি বিধিভঙ্গ হয় না? সকল প্রশ্ন অপেক্ষা গুরুতর হইয়া উঠে মেয়েটির নিদ্রা— ধর্ষণের পরে ঘুমাইল কেন? সিঁদুরে অনিচ্ছা বিবাহিতার ছাঁচ ভাঙিতে চায়, নিদ্রার ইচ্ছা ধর্ষিতার ছাঁচ ভাঙিতে চায়। ছাঁচ-ভাঙা নারী বিপজ্জনক, তাহাদের শিক্ষা দিতে সমাজ সদা সমুদ্যত। ধর্ষণ বা বধূনির্যাতনের চাইতেও বড় অপরাধ, পুরুষতন্ত্রের ক্ষুদ্রতা ও নির্বুদ্ধিতা দেখাইয়া দেওয়া। নিদ্রিত বিবেক জাগাইবার শাস্তি তো মিলিবেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy