রেটিংটা দিয়ে দেবেন স্যর।’ অ্যাপ-নির্ভর গাড়ি কিংবা বাইক ব্যবহার করা যাত্রীরা খুব পরিচিত এই কথাটার সঙ্গে। আঙুলে বোতাম টিপে বিচারক হওয়ার চটজলদি ব্যবস্থা গ্রাহকের মনে ক্ষমতার বোধ জন্মায়। রেটিং ভাল না পেলে পরের বুকিং আসতে দেরি হয়। উবর বা ওলা রেটিং প্রথার মাধ্যমে গাড়ির ড্রাইভারদের তৎপরতা, দক্ষতা মূল্যায়ন করে, নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু চালককে কর্মী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। ঠিকা চালকদের গালভরা নাম, ‘ইনডিপেন্ডেন্ট কন্ট্রাক্টর’।
পুলিশ কিন্তু এই ‘স্বাধীন’ পেশার মর্যাদা দেয় না। যাত্রা শুরুর সময়ে চালক অনুরোধ জানান: যদি পুলিশ বাইক থামায়, তবে আরোহী যেন বলেন, চালক তাঁর আত্মীয় বা বন্ধু। আইন বলছে (মোটর ভেহিক্লস অ্যাক্ট), ব্যক্তিগত গাড়িকে ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করা দণ্ডনীয়। কিন্তু বাণিজ্যিক গাড়ির হলুদ নাম্বার-প্লেট, উবর-ওলার বাইক বা র্যাপিডো চালকদের নেই। সওয়ারি নিয়ে বাইক-চালক দেখলে, পুলিশ গাড়ি থামিয়ে মোবাইল অ্যাপ খুলে চেক করে, চালককে পাঁচ হাজার টাকার কেস দিচ্ছে। কিছু দিন আগেও নাকি জরিমানা হলে কোম্পানিগুলি ক্ষতিপূরণ দিচ্ছিল। এখন চালককেই দিতে হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম এক কেসে। চালক সার্জেন্টকে বলার চেষ্টা করছেন, তিনি খেটে খাচ্ছেন, চাকরি-বাকরি নেই। ট্রাফিক সার্জেন্ট বলছেন, ‘‘চুরি-ডাকাতি করে খা।’’ বললাম, কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না করে, চালককে বলির পাঁঠা করা কেন? সার্জেন্ট বললেন, ও-সব উপরতলার বিষয়, তাঁদের উপর নির্দেশ আছে চালককে জরিমানা করার। জরিমানা এড়াতে অ্যাপ-চালকেরা এখন শহরের গলিঘুঁজি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছন। অর্থাৎ, অ্যাপ রাইড কর্মসংস্থানও করছে, আবার কাজটাকে অপরাধের তকমাদানে শামিলও হচ্ছে।
ডিজিটাল প্রযুক্তি-নির্ভর ব্যবসার একটা গালভরা নাম আছে: গিগ ইকনমি। এদের কর্ণধারেরা দাবি করছেন, তাঁরা এক নতুন কর্মসংস্কৃতি আমদানি করেছেন, যেখানে কর্মপ্রার্থীরা নমনীয় (ফ্লেক্সিব্ল), স্বেচ্ছাধীন, নিজস্ব শর্তে কাজ করতে পারবেন। চাইলে একসঙ্গে তিন-চারটে কোম্পানিতে কাজ করতে পারেন। যখন ইচ্ছে কাজে যেতে পারেন। মাথার উপর টিকটিক করার কেউ নেই, ‘আমরা সবাই রাজা’ মন্ত্রে যখন ইচ্ছে অ্যাপ চালু করে কাজে নামা যাবে। ‘ইনডিপেন্ডেন্ট’, ‘ফ্রি চয়েস’ ইত্যাদি আকর্ষক শব্দ ব্যবহার করে শ্রমিককে শৃঙ্খলমুক্ত করার স্বপ্ন দেখাচ্ছে অ্যাপ-পরিষেবা।
উল্টো দিকের সত্যিটা হল, গিগ অর্থনীতিতে শ্রমিকের কাজের কোনও স্থায়িত্ব, নিরাপত্তা নেই, অনিশ্চয়তাই মূলমন্ত্র। উবর বা লিফটের মতো কোম্পানির বিরুদ্ধে একের পর এক বিক্ষোভ হয়েছে চালক, ফুড ডেলিভারি বয়, সেলুনে বা কনস্ট্রাকশনে কাজ করা শ্রমিকের, মামলা চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ইউরোপে। ক্যালিফর্নিয়াতে গত বছর আইন পাশ হয়, উবর ও অন্য কোম্পানিগুলিকে শ্রমিকদের চুক্তিকর্মীর বদলে কর্মচারী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, তাঁদের ন্যূনতম বেতন কাঠামো আর বেকার-বিমার আওতায় আনতে হবে। গিগ ইকনমির হর্তাকর্তারা হাঁ-হাঁ করে এর বিরোধিতা করছেন। এতে নাকি কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির বিরাট ক্ষতি হবে। চুক্তিতে কর্মী নিয়েও অবশ্য উবরের দশা ভাল নয়। গত অগস্ট নাগাদ ত্রৈমাসিকে বিশ্বের ইতিহাসে সর্বোচ্চ আর্থিক ক্ষতির শিকার হয় উবর, পরিমাণ তিনশো কোটি ডলার!
যাঁরা উবর বাইক চালাচ্ছেন, কেমন রোজগার তাঁদের? আয় ‘ইনসেনটিভ’ নির্ভর। খাবার পৌঁছানোর পরিষেবা থেকে লোক টানার জন্য ওলা, উবরের মতো বাইক রাইড অ্যাপগুলি প্রথমে অস্বাভাবিক হারে ইনসেনটিভ দেওয়া শুরু করে। কিছু দিন পরেই ইনসেনটিভ কমতে থাকে। ফলে রোজগার ধরে রাখতে ট্রিপ বাড়াতে হয়। রাত্রি এগারোটায় এক চালক জানালেন, সেটি তাঁর ২৬তম ও শেষ ট্রিপ, ভোর ছ’টা থেকে কাজ করছেন। এই অমানবিক পরিশ্রম কেন? ২৬টি ট্রিপের ইনসেনটিভ দেড় হাজার টাকা, তেলের খরচ ও যাত্রীর ভাড়া বাবদ তিনি যা পান, তার বহু গুণ বেশি আয় ‘ইনসেনটিভ’ থেকে। অভিজ্ঞ হওয়ার ফলে তিনি জানেন, এই বুদবুদ বেশি দিন স্থায়ী নয়। সুযোগ কাজে লাগাতে তিনি ২০০ কিলোমিটার বাইক চালাচ্ছেন রোজ। গড়ে ১২টা ট্রিপ করতে প্রায় ১০০ কিলোমিটার বাইক চালাতে হয়। ফল শিরদাঁড়ায় অনুভূত হয়।
অ্যাপ ক্যাব জমানা সবে শুরু হয়েছে এই দেশে। উবর ট্যাক্সি চালকেরা ইতিউতি উষ্মা জানিয়েছেন বটে, কিন্তু বিরাট মজুত শ্রমিক শক্তির একাংশ নাম লেখাচ্ছে গিগ কোম্পানিতে। অনেকে অন্য কাজের পর বাড়তি সময়টুকু বাইক চালিয়ে দুটো বেশি টাকা রোজগার করছেন। পরিচিত একটি ছেলে সুপারমার্কেটে রাঁধুনির কাজ করেন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে দুপুর দুটো অবধি (বেতন মাসিক ১১ হাজার), তার পর বাইক নিয়ে উবরের হয়ে খাটেন রাত দশটা অবধি। আবার অনেকে পূর্ণ সময়ের জন্য বাইক পরিষেবায় এসেছেন। দুই তরুণী চালককে চিনি, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার চালাতে এই পেশায় এসেছেন— সামাজিক দুর্নামের ভয় ভেঙে, পুরুষ-যাত্রীর অযাচিত স্পর্শের সম্ভাবনাকে পরোয়া না করে। আজ কলকাতায় রাত ন’টার পর রাস্তা দিয়ে চলা দশটি টু-হুইলারের ছ’সাতটিই হয় খাবার পৌঁছানোর অ্যাপ, নইলে উবর-ওলার বাইক সার্ভিস। এক তরুণ তুর্কি চালক যেমন বললেন, অ্যাক্সিলারেটর ঘোরালেই পয়সা, থামলেই জীবন থেমে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy