Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
বিরোধীরা নজর কাড়ছেন

মার্কিন রাজনীতিতে এখন শুধু রুটি-রুজি-অর্থনীতির আলোচনা

এই দু’জনের কেউই অবশ্য শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে পারেননি। ১৯৬৮ সালে কেনেডিকে প্রাইমারি এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের  সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে ভাবা হচ্ছিল। যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলন, সিভিল রাইটস, মহিলাদের আন্দোলন, সব মিলিয়ে আমেরিকা তখন অগ্নিগর্ভ।

সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৯ ০০:৪১
Share: Save:

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছরখানেক আগে প্রার্থী নির্বাচন পর্ব থেকেই বিরোধী-শিবিরে এ বার প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার বাড়বাড়ন্ত। আমেরিকার প্রার্থী নির্বাচনের পদ্ধতিটা ভারতের থেকে আলাদা। মূল নির্বাচনের আগে পার্টির মধ্যে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা প্রকাশ্য বিতর্ক করেন এবং তার পর ভোটাভুটি করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী ঠিক করা হয়। চালু কথায় এই পদ্ধতিটিকে ‘প্রাইমারি’ বলা হয়। বিগত অর্ধশতাব্দীতে প্রতিষ্ঠানবিরোধী এবং কিছুটা বাম-ঘেঁষা প্রার্থী হিসেবে প্রাইমারিতে জয়ের কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন মাত্র দুই জন। প্রথম জন ১৯৬৮ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী রবার্ট কেনেডি (জন এফ কেনেডির ভাই)। দ্বিতীয় জন ২০১৬ সালে বার্নি স্যান্ডার্স (ছবিতে)।

এই দু’জনের কেউই অবশ্য শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে পারেননি। ১৯৬৮ সালে কেনেডিকে প্রাইমারি এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে ভাবা হচ্ছিল। যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলন, সিভিল রাইটস, মহিলাদের আন্দোলন, সব মিলিয়ে আমেরিকা তখন অগ্নিগর্ভ। কেনেডি এই আন্দোলনের মুখ হিসেবে ভোটে লড়ছিলেন। তিনি একটি সাক্ষাৎকারে ভিয়েতনাম যুদ্ধকে ‘বিরাট ভুল’ আখ্যা দেন এবং ঘটনাচক্রে সাক্ষাৎকার দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রকাশ্যে গুলিবিদ্ধ হন ও মারা যান। ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলতে থাকে। এই খুন নিয়ে এখনও জল্পনা চলে। তার কারণও আছে। এর ৭ বছর আগে, আমেরিকার পূর্বতন প্রেসিডেন্ট আইজ়েনহাওয়ার প্রকাশ্য বক্তৃতায় আমেরিকাবাসীকে যুদ্ধবাজ এবং শিল্পপতিদের আঁতাঁত সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। অনেকেই ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং কেনেডির হত্যাকাণ্ডের পিছনে এই আঁতাঁতের হাত দেখেন। এই আঁতাঁতই রাষ্ট্র চালায়, এবং এদের বিরোধিতা করলে পৃথিবী থেকে সরিয়েও দিতে পারে, এই হল জল্পনা, যদিও এর কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই।

তুলনায় বার্নির পরাজয় একটু কম রহস্যময়। তিনি ভোটেই হেরেছিলেন, কিন্তু ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ‘প্রতিষ্ঠান’-এর বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ছিলই। সেটা ভুল নয়। পার্টির তৎকালীন অন্তর্বর্তীকালীন চেয়ারপার্সন ডনা ব্রাজিল পরবর্তী কালে লেখেন যে, ক্লিন্টন শিবির এবং ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মধ্যে এক ‘অনৈতিক চুক্তি’ হয়েছিল। এবং ক্লিন্টন প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ করতেন।

এ বারের পরিস্থিতি কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য রকম, ও অভূতপূর্ব। প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে কেবল এক জন প্রতিষ্ঠানবিরোধী আছেন এমন নয়। বরং পুরো নির্বাচনের হাওয়াটাই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার দিকে। বার্নি স্যান্ডার্স স্বয়ং তো দৌড়ে আছেনই। এ ছাড়াও ওজনদারদের মধ্যে আছেন পরিচিত বাম মুখ এলিজ়াবেথ ওয়ারেন। একমাত্র উল্লেখযোগ্য মধ্যপন্থী হিসেবে দৌড়ে টিকে ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। প্রাইমারি বিতর্কের অভিমুখ সম্পূর্ণ ভাবেই প্রতিষ্ঠানবিরোধী। বার্নি ঘোষিত ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট— রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিখরচায় উচ্চশিক্ষা, সবার জন্য চিকিৎসার পক্ষে। চার বছর আগেই তিনি রাজনৈতিক বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। এ বছর বিলিয়নেয়ারদের টিকে থাকারই অধিকার নেই বলে দাবি করেছেন। তিনি বড় কর্পোরেশনগুলির চূড়ান্ত বিরোধী, এবং বহির্বিশ্বে মার্কিন আগ্রাসনের কট্টর সমালোচক। অন্য প্রভাবশালী প্রার্থী এলিজ়াবেথ ওয়ারেনও প্রায় হুবহু একই নীতির সমর্থক। এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, আমেরিকার নির্বাচনী বিতর্ক ঘুরপাক খাচ্ছে এই বিষয়গুলিকে ঘিরেই। ভারতবর্ষের মাটিতে যখন এনআরসির সর্বাত্মক বিরোধিতা করার মতো একটিও মূলধারার দল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না,

তখন আমেরিকান ডেমোক্র্যাটরা প্রায় সর্বসম্মত ভাবে বলছেন, মেক্সিকোর অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের জন্য নাগরিকত্বের পথ খুলে দিতে। রাজনৈতিক বিতর্কে সরাসরি রুজি-রুটি-অর্থনীতির আলোচনা এই পরিমাণে এর আগে কখনও হয়েছে বলে মনে হয় না।

এই পরিবর্তন অবশ্য এমনি এমনি হয়নি। আমেরিকার তৃণমূল স্তরের প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস পুরনো। সেই ষাটের দশকের নানা আন্দোলনের সন্তান ‘বেবি-বুমার’রা এখন সর্বত্রই। বার্নি স্যান্ডার্স নিজেই এই সব আন্দোলনের ফসল এবং সংগঠক, নির্দল প্রার্থী হিসেবে দীর্ঘ দিন ধরে জিতে আসছেন আমেরিকান সেনেটে। কিন্তু শুধু পুরনো আন্দোলন নয়, একবিংশ শতকে তৃণমূল স্তরের সংগঠনগুলি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে মূলত অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট এবং সমসাময়িক অন্য আন্দোলনগুলির হাত ধরে। তার পর গত নির্বাচনে ঘটেছে বার্নির চমকপ্রদ উত্থান। আমেরিকার কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে এই মুহূর্তে প্রতিষ্ঠানবিরোধী বা বাম-ঘেঁষা ছাড়া অন্য কোনও কণ্ঠস্বর খুঁজে পাওয়া কঠিন। ট্রেড ইউনিয়নগুলিও বহুলাংশে প্রতিষ্ঠানবিরোধী। এই লেখা লেখার সময়েই শিকাগোয় চলছে শিক্ষকদের ধর্মঘট। তার উপরে আছে একদা-শিল্পোন্নত মিড-ওয়েস্ট থেকে বহু শিল্প দেশের বাইরে চলে যাওয়ার সঙ্কট, যে সঙ্কটে কাজ হারিয়েছেন বহু মানুষ। আন্দাজ করা হচ্ছে বার্নি প্রার্থী হলে এই অংশটি বার্নির দিকেই সরে আসবে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ‘তৃণমূল’ সংগঠকরা মূল ধারায় উঠে এসেছেন গত চার বছরে।

নিউ ইয়র্ক থেকে মার্কিন কংগ্রেসে নির্বাচিত হয়েছেন একদা-রেস্টুরেন্ট-ওয়েট্রেস আলেকজ়ান্দ্রিয়া ওকাসিয়ো কর্তেজ় (ঘটনাচক্রে তাঁর প্রচার-সচিব আবার বঙ্গীয় বংশোদ্ভূত তরুণ সৈকত চক্রবর্তী)। তিনি এবং আরও কয়েক জন অশ্বেতকায় মহিলা সাংসদ মিলে কংগ্রেসে তৈরি করেছেন এক গোষ্ঠী, যার নাম ‘দ্য স্কোয়াড’, যার কিছু সদস্য বার্নির পক্ষে। নিউ ইয়র্কের কুইন্সে তাদের যৌথ সভায় মানুষের ঢল নেমেছিল।

ভারতের মতোই আমেরিকাতেও ভিড়ই অবশ্য জয়-পরাজয়ের সূচক নয়। নির্বাচনী প্রচারেরও খুব প্রাথমিক পর্যায় এখন। তবে মনে হচ্ছে, তাতে বার্নি বা ওয়ারেনের মতো কোনও এক প্রতিষ্ঠানবিরোধীর ট্রাম্পের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাঁদের ব্র‌্যান্ডের সোজা-সাপ্টা বামপন্থা কী করে ও দেশে তরুণদের উৎসাহ টানছে, সেটা এ দেশের বামপন্থীরা ভেবে দেখতে পারেন।

অন্য বিষয়গুলি:

USA Politics Economy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy