অমিত শাহ রাজ্যসভায় জানাইলেন, মুসলমান শরণার্থীদের ভারতে ঠাঁই হইবে না। ধর্মের কারণেই রাষ্ট্র তাঁহাদের নাগরিকত্ব দিবে না। সংসদ নামক পরিসরটির কোনও মূল্য যে তাঁহাদের নিকট নাই, এই কথাটি অমিত শাহেরা ইতিমধ্যে বিলক্ষণ বুঝাইয়া দিয়াছেন— কিন্তু, তাহার পরও, সেই সংসদে দাঁড়াইয়া এ-হেন অসাংবিধানিক একটি কথাকে আইনে পরিণত করা কি সম্ভব হইবে, তাহা লইয়া সন্দেহ ছিল। ভারতীয় সংবিধান নাগরিকের ধর্মবিচার করে না। রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক পরিসরে ধর্মের কোনও গুরুত্ব এই সংবিধানের চোখে নাই। কাজেই, কোন শরণার্থী নাগরিকত্ব পাইবেন, আর কে পাইবেন না, সেই বিচারেও ধর্ম স্বভাবতই মাপকাঠি হইতে পারে না। অমিত শাহদের পৌরুষের নিকট সংবিধান তুচ্ছ হইল। লোকসভার পর রাজ্যসভাতেও বিরোধী সংখ্যাকে অনায়াসে ডিঙাইয়া স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে ঐতিহাসিক বৈষম্যমূলক বিলটি আইনে পরিণত হইল। মন্ত্রী স্পষ্ট করিয়া দিলেন, ভারতীয় মুসলমানদের ‘ভারতীয়ত্ব’ প্রমাণের দায়টি নাগরিকের উপর এক শত ভাগ বর্তাইবে। যুক্তির এই ক্রম, এই বিন্যাসই নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন ও জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকে মুসলমান-বিদ্বেষের প্রশ্নে একে অপরের সম্পূরক করে। যে হেতু নাগরিকত্ব আইনের দৌলতে অ-মুসলমান নাগরিকের নাগরিকত্ব এক অর্থে স্বতঃ-সিদ্ধ হইল, ফলে নাগরিকত্ব প্রমাণের দায় রহিল শুধু মুসলমানের। কাগজপত্র জোগাড় করিতে পারিলে, সেই নথির বৈধতা প্রমাণ করিতে পারিলে তাঁহারা নাগরিক হিসাবে থাকিবেন। নচেৎ তাঁহাদের ঠাঁই হইবে ডিটেনশন ক্যাম্পে।
নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিলটিকে কেন্দ্র করিয়া শুধু মুসলমান-বিদ্বেষের বিভেদরেখাটিই জ্বলিয়া উঠে নাই, জ্বলিতেছে ভারতের বহু অঞ্চল। শুধু ধর্ম নহে, জাতি-সহ পরিচিতির যাবতীয় বিরোধ তীব্র হইয়া উঠিয়াছে। লক্ষণীয়, বহু সংঘাতের পর সাম্প্রতিক অতীতে বিভেদগুলির এক রকম ফয়সালা হইয়াছিল— আংশিক হইলেও সাম্যাবস্থা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। অনুপ্রবেশ এই দেশের একটি বড় সমস্যা। কিন্তু তাহার পরও একটি স্থিতিশীলতা ছিল, অন্তত অনুপ্রবেশকে কেন্দ্র করিয়া কোনও ধর্মীয় মেরুকরণ ছিল না। ঠিক উহাই বিজেপি শাসকের না-পসন্দ, তাই নাগরিকত্ব বিলের অঙ্কুশে অমিত শাহেরা সমস্ত ক্ষতকে ফের জাগাইয়া তুলিলেন।
এই অদৃষ্টপূর্ব রাজনৈতিক তৎপরতার লক্ষ্য: পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি। ‘মেরে বঙ্গাল’ বলিয়া অমিত শাহ সেই ইঙ্গিত দিয়া রাখিয়াছেন। ২০২১ সালে এই রাজ্যের মসনদ দখল করিতে বিজেপি মরিয়া। তাহাদের রাজনীতি চিরকালই বিভাজন ও মেরুকরণের অস্ত্রের ভরসায় চলিয়াছে। গত কয়েক বৎসরের অভিজ্ঞতা বলিতেছে, এই রাজ্যেও সেই রাজনীতির জমি বিলক্ষণ উর্বর। অমিত শাহেরা জানেন, বাহাত্তর বৎসর অতিক্রান্ত হইলেও বাঙালির জাতিগত স্মৃতিতে দেশভাগ এখনও তীব্র বাস্তব। পূর্ববঙ্গ হইতে উদ্বাস্তু হইয়া ভারতে আশ্রয় লইতে বাধ্য হওয়ার স্মৃতি যেমন আছে, তেমনই আছে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বিপুল অনুপ্রবেশ সম্বন্ধে ধারণা। সেই ধারণার কতখানি সত্য, সে প্রশ্ন অবান্তর— পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে রাজনীতি হয় না। বাঙালি হিন্দুর মনে যদি দেশভাগের স্মৃতি উস্কাইয়া দেওয়া যায়, সেই যন্ত্রণার ‘প্রতিশোধ’ লইবার পন্থা বাতলাইয়া দেওয়া যায়, তবে হিন্দু ভোটের মেরুকরণ ঘটা সম্ভব বলিয়াই হয়তো বিজেপি নেতৃত্বের ধারণা। লোকসভায় দাঁড়াইয়া অমিত শাহ দেশভাগের পর ধর্মের ভিত্তিতে ভারত গঠন সম্বন্ধে যে মিথ্যা বলিয়াছেন, তাহাও এই সূত্রেই বাঁধা। সাত দশক পূর্বে মুসলমানেরা ‘নিজেদের দেশ’ পাইয়াছিলেন, বিজেপি এত দিনে হিন্দুদের ‘নিজেদের দেশ’ দেওয়ার ব্যবস্থা করিতেছে, এই কথাটি বঙ্গীয় রাজনীতিতে তাঁহাদের পক্ষে ইতিবাচক হইবে, এই আশাতেই কি অমিত শাহেরা আগুন লইয়া খেলিতেছেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy