রাজ্যে ‘শিবির সংস্কৃতি’ ক্রমেই ডালপালা ছড়াচ্ছে, তার নিদর্শন ‘সেবাশ্রয়’। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের সংসদ এলাকা ডায়মন্ড হারবারে বারোশো চিকিৎসক এবং কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে বিনা পয়সায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসার আয়োজন করা হয়েছে সম্প্রতি। বিষয়টি রাজনৈতিক মহলে রীতিমতো চাঞ্চল্য ফেলেছে— তৃণমূলের সর্বভারতীয় সম্পাদক কি ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে, তাঁরই দলের সরকার গ্রামের মানুষের কাছে চিকিৎসা পৌঁছতে পারেনি? বিরোধীরা সেই ব্যাখ্যাই করছেন। সরকার যে বিব্রত, তারও ইঙ্গিত মিলছে। আগামী মাসে কয়েক হাজার সরকারি চিকিৎসকের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৈঠক করবেন, ঘোষণা হয়েছে। এ হয়তো সরকারি তৎপরতার নিদর্শন। কিন্তু তৎপর হওয়াই যথেষ্ট নয়, নীতি যথাযথ হওয়ার দরকার। বছর দুয়েক আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘দুয়ারে ডাক্তার’ কর্মসূচির ঘোষণা করেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়িতে স্বাস্থ্য শিবির করতে পাঠানো হয় এসএসকেএম-এর চিকিৎসকদের। প্রশ্ন উঠেছিল, গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থার পরিকাঠামোকে পোক্ত না করে, সাময়িক শিবির করে কী লাভ? শহর থেকে ডাক্তার এনে দু’চার দিনের শিবির করা কার্যত দেখনদারি। এতে মেডিক্যাল কলেজগুলির মানবসম্পদ এবং সরকারি অর্থ, দুটোরই অপব্যয় হয়। কলকাতার ডাক্তারকে গ্রামের শিবিরে পাঠানোর পরিকল্পনা আর এগোয়নি।
এখন সেই একই ধারণা ‘সেবাশ্রয়’ মোড়কে হাজির হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাড়তি প্রশ্ন ওঠে, সাংসদ-আয়োজিত শিবির কি কোনও সরকারি কর্মসূচির অন্তর্গত? তা কি স্বাস্থ্য ভবনের অনুমোদন পেয়েছে? সরকারের কাছে ‘সেবাশ্রয়’ শাঁখের করাত। যদি সরকার তা অনুমোদন না করে, তা হলে প্রশ্ন উঠবে, সরকারি চিকিৎসক বা সরকারি পরিকাঠামো কী করে ব্যবহার করতে পারে শিবির? তৃণমূল দলের মধ্যে রাজনৈতিক ফাটলও স্পষ্ট হবে। যদি অনুমোদন করে, তা হলে সরকারের মুখরক্ষা কঠিন হবে। সাময়িক স্বাস্থ্য শিবিরে চিকিৎসাপ্রার্থীদের ভিড় যত বাড়বে, সরকারি হাসপাতালে পরিষেবার ঘাটতি তত স্পষ্ট হয়ে উঠবে। প্রশ্ন উঠবে, বিরোধী দলের সাংসদরা গ্রামে স্বাস্থ্য শিবির করলে সরকার সমান সহায়তা দেবে তো? কেউ বলতে পারেন, বিধানসভা নির্বাচনের আগে জনসংযোগের নানা চেষ্টা তো হবেই, স্বাস্থ্য পরিষেবার মাধ্যমে সে চেষ্টা করলে ক্ষতি কী? তৃণমূলের সাংসদরা যদি নির্বাচনী প্রচার ব্যয়ের অংশ হিসেবে গ্রামীণ স্বাস্থ্যের জন্য কয়েক কোটি টাকা খরচে উৎসাহী হন, তাতে গ্রামের মানুষেরই লাভ। সে কথা নিঃসন্দেহে সত্য, কিন্তু যে উদ্দেশ্যে খরচ, তা পূরণ হওয়া চাই। গ্রামের শিবির থেকে কলকাতার হাসপাতালে রোগী রেফার করার চাইতে, কলকাতায় যাওয়ার প্রয়োজন কমানোই দরকার। দিনকয়েকের শিবিরে ধুমধাম হয় বেশি। কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিকাঠামোর উন্নতি, মেডিক্যাল পরীক্ষার যন্ত্র ও কর্মীর ব্যবস্থা, ব্লক স্তরের হাসপাতালগুলিতে নানা ধরনের পরিষেবা ও রোগী সহায়তার ব্যবস্থা, এগুলোতেই কি লাভ বেশি নয়?
নির্বাচনী রাজনীতির বিষয় হওয়া দরকার স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাও। তবে সেই রাজনীতি যেন হয় দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের আশ্রয়। ‘শিবির’ মডেলটি তার পরিপন্থী। স্বল্পমেয়াদি প্রয়োজনের জন্য শিবির আয়োজন করা যায়, কিন্তু তা নিয়মিত পরিষেবার জায়গা নিতে পারে না। ‘দুয়ারে সরকার’ শিবিরগুলির জন্য বহু ব্যয় হয়। কিন্তু সেগুলি জনসংযোগের উদ্যোগ হয়েই রয়ে গিয়েছে, সরকারি দফতরগুলির প্রশাসনিক শক্তি, পরিষেবার প্রসার বাড়ায়নি। তেমনই, প্রাথমিক হাসপাতাল থেকে জেলার সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল, সব স্তরে চিকিৎসার সরঞ্জাম, চিকিৎসক, চিকিৎসা-কর্মী ও স্বাস্থ্য কর্মীর যথেষ্ট জোগানকে জনসমর্থন পাওয়ার ভিত্তি করতে হবে। অসুস্থ রাজনীতিই যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অসুখ, তা গ্রামের মানুষও বোঝেন। চটজলদি কর্মসূচি দিয়ে চিকিৎসা-সঙ্কট ঘুচবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy