(বাঁদিকে) দোল উৎসব। (ডান দিকে) দামোদরের বুকে চাঁচর। নিজস্ব চিত্র ও লেখক
নদীর বুকে সোনালি বালিয়াড়ি। তার পাড়েই আশ্রম। সরু মেঠো পথ ঘিরে রেখেছে আশ্রমকে। সেখানেই নানা রঙের কাগজের মালা, আলপনা, ভাস্কর্য আর হাতে আঁকা ছবিতে সাজানো আশ্রম। কলকাতা থেকে ঘণ্টা দুয়েকের পথ। বর্ধমান শহর ছাড়িয়ে দামোদর পাড়ে সবুজে ঘেরা কয়েক বিঘা জমি। নদীর জল, পাখির ডাক ছাড়া আর কোনও
শব্দ নেই।
বর্ধমানের শশঙ্গার পঞ্চাননতলা ছাড়িয়েই এমন আশ্রমিক পরিবেশে ‘পঞ্চবটী বসন্ত পার্বণ’। দামোদর চরের বালিতে ন্যাড়া পোড়ার পাশাপাশি, মাদল আর ঢাকের সঙ্গে সাঁওতালি নৃত্যে সেই আশ্রমেই মেতে উঠলেন সবাই। রায়বেঁশে, গান-মেলার সঙ্গে দোল উৎসব। আশপাশের গ্রামের মহিলা, পুরুষদের সঙ্গে পাত পেড়ে খেলেন কলকাতা-সহ নানা জেলার মানুষ, এমনকি, বিদেশিরাও।
বীরভূমের জয়দেবের কেঁদুলির ‘মনের মানুষ’ তথা হাটগোবিন্দপুর, শ্যামসুন্দর, মুক্তিপুর, মধুবনের মতো আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ফকির সাধন দরবেশ (সাধনদাস বৈরাগ্য) এবং মাকি কাজুমি-র এই আশ্রমটির নাম পঞ্চবটী। দোল উপলক্ষে সেই আশ্রমেই কয়েক দিন ধরে চলেছে উৎসব। সঙ্গে নিরামিষ খাবার, দামোদরের টাটকা মাছের ঝোল। গোটা অনুষ্ঠানের নাম, ‘বসন্ত বাউল, লোকগাঁথা’।
করোনা ভাইরাস আতঙ্কে এ বছর বসন্ত উৎসব বাতিল হয়েছিল শান্তিনিকেতনে। তাই এ বার আশ্রমে ছিল আরও সমাগম। কলকাতা থেকে এসেছিলেন মৃন্ময়, সুলগ্না, সেরা, গোপাল, সুমনের মতো অনেকে। সেরা জানান, শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসবে বড় ভিড়। যাতায়াতই করা যায় না। হোটেলে ঘর মেলে না। এ সব কারণেই বিকল্প হিসেবে পর্যটকেরাও খুঁজে নিচ্ছে নতুন জায়গা। পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনাতেও বসন্ত উৎসব হচ্ছে। তার পরেও বর্ধমানের আশ্রমে ছোট্ট উপাসনাকে নিয়ে লেকটাউন থেকে এসেছিলেন দেবশ্রী, সিদ্ধার্থ। তার পর থেকে পঞ্চবটীতে প্রতি বার আসেন, জানালেন দেবশ্রী। আশ্রমবাটীর ঘর তো রয়েছেই, পঞ্চবটীর তাঁবুতেও থাকা যায়। গ্রামের মানুষ আর আশ্রমে আসা অতিথিদের দেখভাল, অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন গোবরডাঙার একটি লোকশিল্পীদের সংগঠনের অন্যতম কর্ণধার রাজীব রায়। তিনি বলেন, “গ্রামের মানুষ, অতিথি সবাই এখানে সমান। গুরুজি বলেন, আমিত্ব বলে আসলে কিছু নেই। আশ্রমের টানে তাই সবাই বার বার ছুটে আসেন।”
এ বারেও আবির আর নানা রঙের পতাকায় সাজানো হয়েছিল পঞ্চবটী। প্রকৃতিও যেন ফুল, ফল আর সবুজে সাজিয়ে দিয়েছিল দামোদরের পাড়। আশ্রমের চারপাশ অশোক, শিমুল, পলাশে লাল। দোলের আগের দিন দেখা গেল, ভোর থেকেই মূল মঞ্চে চলছে বাউল, লোকগীতি, বিভিন্ন গানের আসর। দুপুরে মেলার মাঠ থেকে শুরু হয়ে আশ্রম প্রদক্ষিণ করতে করতে মাদলের তালে সাঁওতালি নৃত্য।
দামোদরের পাড়ে তখন সূর্য ডুবছে। আকাশের অন্য প্রান্তে দোল পূর্ণিমার গোল চাঁদ। মায়াময় সেই সন্ধ্যায় নৌকায় চড়ে পাড়ি দেওয়া হয় দামোদরে। মাঝখানে, বালির চরে। ঢাক, কাঁসর আর শাঁখের আওয়াজে শুরু হয় ন্যাড়া পোড়া। আগুন দেওয়া হয় চাঁচরে। নৃত্যের তালে হাতে হাত দিয়ে গোল করে আগুনের চারপাশ প্রদক্ষিণ করে অশুভ শক্তিকে বিনাশের আহ্বান জানান সবাই। কালো ধোঁয়ার সঙ্গে চাঁচরের আগুনের ফুলকি কাঁপতে কাঁপতে মিশে যায় লালচে আকাশে। ততক্ষণে মেলার মাঠে শুরু হয়ে গিয়েছে আদিবাসী নৃত্য, রায়বেঁশে। শরীরের কসরত দেখান শিল্পীরা। ঘোড়া, কৃষ্ণ, কালী রূপে ঘুরে বেড়ান বহুরূপীরা।
অন্য বার দোল পূর্ণিমার সকালে নগর পরিক্রমা হত। গ্রামে গ্রামে ঢুকে ঢাক ও কাঁসরের তালে চলত আবির খেলা। গ্রামের মোড়ে, অশ্বত্থতলা ঘিরে থাকত প্রাদেশিক নৃত্য। বিদ্যুৎহীন, ধুলো ভরা রাস্তা, ভাঙা কুঁড়েঘর আর খেত থেকে বেরিয়ে আসা মানুষগুলিকে মিষ্টিমুখ করতেন সাধনদাস।
সৌজন্য করোনা ভাইরাস, এ বছর বাতিল ছিল নগর পরিক্রমা। তালবাদ্য শিল্পী সুকুমার দাস বলছিলেন, ‘‘সব সময় এ সব বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। এই আশ্রমে শৃঙ্খলাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।’’
পরিক্রমা বন্ধ তাতে কী, আশপাশের আমরুল, ন’পাড়া, নায়েবপাড়া, মাছিলা, বিহারিপাড়া এ বার জড়ো হয় আশ্রমে। দোলের সকালে রঙ্গোলিতে সাজানো হয়েছিল দোলমঞ্চ, মানববেদী। আশ্রমের আশপাশের নানা শিবমন্দির ও শিবলিঙ্গে আবির দেওয়া হয়। ঢাক-কাঁসরের সঙ্গে আবির খেলা। শুরু হয় নাচ-গান। আবির মাখিয়ে দেন সাধনদাস বৈরাগ্য, মাকি কাজুমির পাশাপাশি, শুভ্রামা, শ্রুতিমা, সরস্বতীমার মতো বিদেশিনিরা। গুরুজনের পায়ে সশ্রদ্ধায় আর সস্নেহে ছোটদের গালে মাখিয়ে দেওয়া হয় ফুলের আবির।
ততক্ষণে আশ্রমের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট-বড় গোল করে শুরু হয়ে যায় গান। এক প্রান্তে সাধনদাসের ‘পোর্টেট’ আর ছবি নিয়ে চলে শিল্পী শফিক আহমেদের প্রদর্শনী। সেই তাঁবুতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা গান ধরেন। গান ধরেন অন্য শিল্পীরাও। আশ্রম উঠোনে তখন কীর্তনে বিভোর আনন্দ খ্যাপা। সঙ্গে খোলে তাল তোলেন যমজ দুই ভাই, সোনা আর মনা। বিশাল ক্যানভাসে ছবি আঁকেন নানা শিল্পী, শিল্পীদের একটি সংগঠনের সদস্য শৌভিক রায়, সংহিতারা। সংহিতা বলেন, ‘‘গুরুজিও সেই কথাই বলেন। আগে সহজ হও, সরল হও। মানুষ ধরে মানুষ হও।’’
দোল পেরিয়েও অনুষ্ঠান চলতে থাকে কয়েক দিন। কলকাতা, বীরভূম, নদিয়া, দেশ-বিদেশ থেকে সপার্ষদ চলে আসেন বাউল, লোকশিল্পীরা। গানে তন্নিষ্ঠ হয়ে থাকেন নীলিমেশ, পাখির মতো অনেকে। চাঁদপাড়া থেকে এসে কখন যেন আশ্রমই ঠিকানা হয়ে গিয়েছে একতারা তৈরির অন্যতম কারিগর নীলিমেশ বিশ্বাসের। তাঁর কথায়, ‘‘গুরুজি বলেন, মনে রাখিস, তোর একতারাই এখন একে ফর্টি সেভেন। এই দিয়েই মানব প্রেমে বিশ্ব জয় করতে হবে।’’
এর মধ্যেই দামোদরের স্নিগ্ধ জলে স্নান করতে নেমে পড়েন কেউ। ফিরতে হবে। বছর পাঁচেক আগে এই ফেরার সময় জয়দেবের কেঁদুলির বছর আটেকের ছোট্ট নন্দিনী পথ আগলে বলেছিল, “চইল্যে যাচ্ছো? না গ্যালে হবেক নাই?” সেই নন্দিনীর দেখা মেলে না এ বার। সেই বয়সেরই আর এক একরত্তি সুপ্রিয়া দাস এ বার ফের পথ আগলে দাঁড়ায়। চোখে জল—আবার কবে দেখা হবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy