নাম বদলের রোগটি পুরাতন। পুরাতন বলিয়াই বোধ করি সুকুমার রায় ছাতার নাম প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, গাড়ুর নাম পরমকল্যাণবরেষু ইত্যাদি ভাবিতে পারিয়াছিলেন— কৌতুক আকাশ হইতে পড়ে না। ডালহৌসি স্কোয়ারকে বিবাদী বাগ বা পার্ক স্ট্রিটকে মাদার টেরিজ়া সরণি বানানোর বৈপ্লবিক ইতিহাস পার হইয়া মেট্রো রেলের টালিগঞ্জ স্টেশনের নাম মহানায়ক উত্তমকুমার হইয়াছে, তাহাও আজ অনেক দিনের কথা। এমনকি, সত্যজিৎ রায় ধরণি— যাহা দেখিলে সুকুমার রায়ও নির্ঘাত লজ্জায় ও ভয়ে কলমখানি গুটাইয়া রাখিতেন— সর্বংসহা কলিকাতা তাহাও দেখিয়াছে এবং হজম করিয়াছে। কিন্তু তাহার পরেও বলিতে হয়, মুঘলসরাইকে দীনদয়াল উপাধ্যায়, ফৈজ়াবাদকে অযোধ্যা, ইলাহাবাদকে প্রয়াগরাজ, আগরাকে অগ্রবন কিংবা উত্তরপ্রদেশের দৃষ্টান্ত অনুসরণে এই পশ্চিমবঙ্গে ইসলামপুরকে ঈশ্বরপুর বানাইবার যে উৎকট তৎপরতা চলিতেছে, তাহা সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের।
গোত্রের নাম আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদ। নিছক নাম বদলাইবার হুজুগ নহে, ইহা ইতিহাস বদলাইবার গূঢ় উদ্যোগ, যাহাকে ষড়যন্ত্র বলিয়া তুচ্ছ করিবার কারণ নাই— ষড়যন্ত্র মাত্র ছয় জনের ব্যাপার। এই অতিকায় উদ্যোগের এক এবং অদ্বিতীয় লক্ষ্য: ভারত নামক দেশটির আত্মপরিচয় হইতে ইসলামি ঐতিহ্য ও ধারণাগুলিকে মুছিয়া দেওয়া। এই হিন্দুত্ব কেবল আগ্রাসী নহে, ঘাতক। বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতি, বহু ঐতিহ্যের স্বাভাবিক সমন্বয়ে যে ভারতাত্মার সৃষ্টি ও বিবর্তন, এই ঘাতক তাহাকেই বিনাশ করিতে বদ্ধপরিকর। বস্তুত, ইহা এক বহুধাবিস্তৃত প্রকল্পের একটি অঙ্গমাত্র, নানা দিক হইতে নানা ভাবে ভারতের সমন্বয়ী সংস্কৃতিকে ধ্বংস করিবার সেই প্রকল্প কয়েক বছরে বিপুল আকার ধারণ করিয়া চারিধার ঢাকিয়াছে। সঙ্ঘ পরিবারের নামবদল অভিযান লইয়া কৌতুক বা ব্যঙ্গের অবকাশ নাই। কালসর্প লইয়া রসিকতা চলে না।
ভারতীয় সমাজমানসে হিন্দুত্বরূপী এই কালসর্পের প্রবেশ ঘটিয়াছে হিন্দুধর্মের রন্ধ্রপথে। এই হিন্দুত্ব হিন্দুধর্ম নহে, বরং এক অর্থে তাহার বিপরীত। কিন্তু হিন্দুধর্মের এক ভুল ও বিকৃত ব্যাখ্যাকে সে আপন সঙ্কীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিয়াছে এবং করিতেছে। হিন্দুধর্মের বিস্তৃত ও জঙ্গম পরিসরে যুগে যুগে বহুত্বের স্থান মিলিয়াছে, সেই আত্মীকরণের পথেই এই ধর্ম আপন প্রভাব বজায় রাখিয়াছে। যে একশৈলিক, মৌলবাদী এবং পরমত-অসহিষ্ণু হিন্দুত্বের ধ্বজা উড়াইয়া সঙ্ঘ পরিবারের ক্ষমতা দখলের অভিযান, তাহা এই ধারার বিপ্রতীপ। এবং সেই কারণেই ভারতীয় সংস্কৃতির উদার ঐতিহ্যের সহিত ইহার মৌলিক বিরোধ। ইসলাম সম্পর্কে হিন্দুত্ববাদীদের মানসিকতা তাহারই প্রকটতম দৃষ্টান্ত। ভারতীয় সংস্কৃতিতে অজস্র ইসলামি উপকরণ ওতপ্রোত। ভাষায়, সাহিত্যে, শিল্পে, ভাস্কর্যে, সঙ্গীতে, এমনকি ধর্মের নিজস্ব পরিসরেও তাহার অগণিত নিদর্শন। এই সংস্কৃতির মৌলিক চরিত্রেও ইসলামের, বিশেষত সুফি সাধনার প্রভাব বিস্তর। বস্তুত, বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির স্বাভাবিক সহাবস্থান এবং পারস্পরিক আদানপ্রদানে এই দেশের বহুমাত্রিক সভ্যতা বরাবর সমৃদ্ধ হইয়াছে। যোগী আদিত্যনাথ ফৈজ়াবাদকে অযোধ্যা বানাইতে চাহিতেছেন, অথচ ফৈজ়াবাদ-অযোধ্যার যুগ্মটি কেবল ওই অঞ্চলের নহে, সমগ্র ভারতের এক অনন্য সম্পদ। কিন্তু সঙ্ঘ পরিবার মার্কা হিন্দুত্ববাদ এই সমন্বয়ের ঐতিহ্যকে স্বীকার করিতে পারে না, কারণ তাহা হইলে তাহাদের ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’র মডেলটি আর দাঁড়াইবে না। অতএব তাহারা উদার ভারতের ইতিহাস মুছিয়া এক উৎকট ভারতের কল্পিত ইতিহাস প্রতিষ্ঠা করিতে তৎপর। উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী প্রতিটি ভারতবাসীকে এই অনাচার প্রতিহত করিবার দায় স্বীকার করিতে হইবে। নচেৎ, হিন্দুত্ববাদের ঈশ্বরপুরে ভারতাত্মার পাতালপ্রবেশ অনিবার্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy