Advertisement
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
Health

লাগাতার স্বাস্থ্য-শিক্ষা রক্তাল্পতার সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে

আমাদের শরীরে ‘আয়রন’-এর জোগান আসে মূলত খাদ্য ও পানীয় থেকে। আমিষ জাতীয় খাদ্যে যে ‘আয়রন’ থাকে, তা সহজেই শরীর গ্রহণ করতে পারে। অনেকে আবার নিরামিষাশী। তাঁদের ক্ষেত্রে শাক-আনাজ থেকেই ‘আয়রন’ জোগাড় করতে হয়। লিখছেন আজিজুর রহমান২০১৭ সালের ‘গ্লোবাল নিউট্রিশন রিপোর্ট’ অনুযায়ী, ১৪০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান সবার নীচে। প্রজননক্ষম মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতায় আক্রান্তদের সংখ্যা অত্যধিক হওয়ার ফল কিন্তু সুদূরপ্রসারী।

আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা নির্ণয়। ফাইল চিত্র।

আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা নির্ণয়। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৯ ০২:১০
Share: Save:

রক্তাল্পতা বা ‘অ্যানিমিয়া’ একটি পৃথিবীব্যাপী সমস্যা। বিশেষ করে মহিলা ও শিশুরাই এর শিকার। শুধু অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলিই নয়, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও এই সমস্যা বর্তমান। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্ব জুড়ে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী প্রায় ৬১ কোটি মহিলা রক্তাল্পতায় ভোগেন। আর আমাদের দেশের নিরিখে তা প্রায় ৫১ শতাংশ।

২০১৭ সালের ‘গ্লোবাল নিউট্রিশন রিপোর্ট’ অনুযায়ী, ১৪০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান সবার নীচে। প্রজননক্ষম মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতায় আক্রান্তদের সংখ্যা অত্যধিক হওয়ার ফল কিন্তু সুদূরপ্রসারী। এতে এক দিকে যেমন মায়েদের স্বাস্থ্যহানি ঘটে, তেমনই গর্ভস্থ ভ্রূণ ও নবজাতকের উপরেও প্রভাব পড়ে। আমাদের দেশে মাতৃ-মৃত্যুর শতকরা কুড়ি ভাগ ঘটে রক্তাল্পতার কারণে। তেমনই ছ’বছরের কমবয়সি শিশুদের কম উচ্চতা ও উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন দেখা যায়।

মনে রাখা দরকার, রক্তাল্পতা কোনও রোগ নয়। রোগের লক্ষণ মাত্র। ল্যাটিন ভাষায় শব্দটির অর্থ ‘নো ব্লাড’ অর্থাৎ, রক্তশূন্যতা। অথচ, আদতে রক্তাল্পতা হলে দেহে রক্তের মোট পরিমাণ কিন্তু বেড়ে যায়। বিশেষ করে গর্ভাবস্থায়। আসলে রক্তাল্পতার পরিমাপ করা হয় রক্তের লোহিতকণিকায় থাকা ‘হিমোগ্লোবিন’-এর পরিমাণ থেকে। প্রতি ১০০ মিলিলিটার রক্তে ১১ গ্রাম বা তার কম পরিমাণে ‘হিমোগ্লোবিন’ থাকলে রক্তাল্পতা হয়েছে ধরা হয়।

রক্তাল্পতার বহু কারণ আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অপুষ্টি ও লৌহঘটিত খাদ্যের অভাব। ম্যালেরিয়া বা ‘হুক ওয়ার্ম’ জাতীয় কৃমির সংক্রমণেও রক্তাল্পতা ঘটাতে পারে। এ ছাড়া, অর্শ, অত্যধিক ঋতুস্রাবও রক্তাল্পতার কারণ হতে পারে।

গর্ভবতী মা ও শিশুদের ক্ষেত্রে রক্তাল্পতার প্রধান কারণ হল শরীরে লোহা বা ‘আয়রন’-এর অভাব (আয়রন ডেফিসিয়েন্সি অ্যানিমিয়া বা ‘আইডিএ’)। এমনিতে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের ‘আয়রন’-এর চাহিদা একটু বেশিই। কারণ, ঋতুমতী মহিলাদের শরীর থেকে প্রতি মাসে ১২.৫ মিলিগ্রাম করে ‘আয়রন’ বেরিয়ে যায়। তাই মহিলাদের দৈনিক ১.৬ মিলিগ্রাম এবং গর্ভবতীদের দৈনিক ২.৮ মিলিগ্রাম ‘আয়রন’-এর প্রয়োজন হয়।

আমাদের শরীরে ‘আয়রন’-এর জোগান আসে মূলত খাদ্য ও পানীয় থেকে। আমিষ জাতীয় খাদ্যে যে ‘আয়রন’ থাকে, তা সহজেই শরীর গ্রহণ করতে পারে। তাই মাছ, মাংস, ডিম, মাংসের মেটে খাদ্যতালিকায় থাকা দরকার। দুধে ‘আয়রন’ থাকে না। তবে আমাদের দেশের খুব কম পরিবারেরই খাদ্যতালিকায় নিয়মিত ভাবে এগুলি থাকে। অনেকে আবার নিরামিষাশী। তাঁদের ক্ষেত্রে শাক-আনাজ থেকেই ‘আয়রন’ জোগাড় করতে হয়। সবুজ পাতাযুক্ত শাকসবজি, শস্যদানা, বাদাম, গুড়, খেজুর, অঙ্কুরিত ছোলা, তরমুজ ইত্যাদিতে প্রচুর ‘আয়রন’ থাকে।

তবে উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে ‘আয়রন’ পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হল এগুলিতে ‘ফাইটেট’, ‘অক্সালেট’, ‘কার্বনেট’, ‘ফসফেট’ ও ‘ফাইবার’ থাকে, যা দেহে ‘আয়রন’-এর শোষণে বাধা দেয়। আমিষ খাদ্যে আয়রন ‘ফেরাস’ যৌগ রূপে থাকে, যা আমাদের শরীর সহজেই রক্তে শোষণ করতে পারে। কিন্তু উদ্ভিজ্জ উৎসের আয়রন থাকে ‘ফেরিক’ রূপে, যা ‘ফেরাস’ যৌগে পরিণত না হলে শরীরে শোষিত হয় না। এ জন্য দরকার ‘ভিটামিন সি’ অর্থাৎ, টক জাতীয় খাদ্য। তাই শাক-আনাজের সঙ্গে ‘ভিটামিন সি’ সমৃদ্ধ খাবার খেলে তবেই তার ‘আয়রন’ শরীর নিতে পারে। এই ‘আয়রন’ যকৃত বা লিভারে সঞ্চিত হয়। লিভারে সঞ্চিত ‘আয়রন’ নিঃশেষিত হলে ‘আয়রন ডেফিসিয়েন্সি অ্যানিমিয়া’র উপসর্গগুলি প্রকাশ পায়।

গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে রক্তাল্পতার সমস্যা বেশি। কারণ, আমাদের দেশে মহিলারা এমনিতেই অনেকে অপুষ্টি ও রক্তাল্পতায় ভোগেন। আর গর্ভকালীন অবস্থায় ভ্রূণের প্রয়োজনে আরও বেশি ‘আয়রন’ প্রয়োজন হওয়ায় সমস্যা বাড়ে। এই অবস্থায় ‘আয়রন’-এর ঘাটতি হলে ভ্রূণের বৃদ্ধি ও বিকাশ ব্যাহত হয়। সময়ের পূর্বেই প্রসব এবং গর্ভপাত বা গর্ভের মধ্যে ভ্রূণের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রসবের সময়ে অত্যধিক রক্তপাত, ‘হার্ট ফেলিওর’, এমনকি, মায়ের মৃত্যু ঘটেছে।

গর্ভবতী মহিলাদের তাই গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ‘হিমোগ্লোবিন’ পরিমাপ করা দরকার। প্রয়োজন পরিমাণমতো পুষ্টিকর ও ‘আয়রন’ সমৃদ্ধ খাবারের। সঙ্গে গর্ভবতী মায়েদের রক্তাল্পতা আটকাতে দরকার বাইরে থেকে ‘আয়রন’ জোগান দেওয়াও। তাই সরকারি তরফে হবু মায়েদের কমপক্ষে ১০০টি ‘ফলিক অ্যাসিড’ বড়ি দেওয়া হয়। রক্তাল্পতার সমস্যা থাকলে সংখ্যাটা বাড়ে। পাশাপাশি, নিয়মিত গর্ভকালীন পরিচর্যা খুবই দরকারি, যাতে গর্ভবতীকে রক্তাল্পতায় আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করা যায়। তবুও ‘হিমোগ্লোবিন’-এর মাত্রা ৭-এর নীচে নেমে গেলে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয়।

সমস্যার বিষয় হল— বহু মা এবং তাঁদের পরিজনেরা রক্তাল্পতার ভয়াবহতা সম্পর্কে উদাসীন। পিছনের কারণ সেই অশিক্ষা, ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কার, পরম্পরাগত অন্ধবিশ্বাস ইত্যাদি। বেশ কয়েক বছর আগেও অনেক মায়েরা ওই সব ‘আয়রন’ বড়ি ছুঁয়েও দেখতেন না। এখন অবস্থাটা অনেক পাল্টেছে। তবে নানা ভুল ধারণা থাকায় ‘আয়রন’সমৃদ্ধ খাবার থেকে বঞ্চিত হন অনেকে, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও! লাগাতার স্বাস্থ্য-শিক্ষার মাধ্যমে রক্তাল্পতার সমস্যা থেকে ভবিষ্যতে মুক্তি মিলবে, এটাই আশা।

লেখক প্রাক্তন জেলা মাতৃত্ব ও শিশু স্বাস্থ্য আধিকারিক, পুরুলিয়া

অন্য বিষয়গুলি:

Anemia Health Education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy