Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

সুদিনের সাধ ঘুরিয়ে দিয়েছে ভোট, আশাপূরণ হবে তো?

খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ কিন্তু মার্কসবাদ বুঝত না; তারা বুঝত নুন-ভাতের সংস্থান। কিন্তু বামেরা ভাবল, তারা যা বলবে, মানুষ তা-ই মেনে নেবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই ভুলই করলেন। লিখছেন দেবদুলাল কুণ্ডু

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৯ ০৩:০৩
Share: Save:

“তুমি কি মনে কর রাজ্য কেবল সোনার সিংহাসন, হীরার মুকুট ও রাজছত্র?... রাজ্য পাইতে চাও তো সহস্র লোকের দুঃখকে আপনার দুঃখ বলিয়া গ্রহণ কর, সহস্র লোকের বিপদকে আপনার বিপদ বলিয়া বরণ কর, সহস্র লোকের দারিদ্র্যকে আপনার দারিদ্র্য বলিয়া স্কন্ধে বহন কর— এ যে করে সে-ই রাজা, সে পর্ণ কুটিরেই থাক্‌ আর প্রাসাদেই থাক্‌।... রাজাকে বধ করিয়া রাজত্ব মেলে না ভাই, পৃথিবীকে বশ করিয়াই রাজা হইতে হয়।”

‘রাজর্ষি’ উপন্যাসে রাজা গোবিন্দমাণিক্যের মুখ দিয়ে কথাগুলি বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রাজার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আমাদের আসমুদ্রহিমাচল ঘোরাননি তিনি, তত্ত্বকথা শোনাননি; সাধারণ প্রজাদের সুখ-দুঃখের শরিক হতে বলেছেন মাত্র।

পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের চৌত্রিশ বছরের শাসনের ইতিহাস বলছে, তাদের মধ্যে প্রকৃত শাসক হবার গুণ ছিল। কারণ নিত্য খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ কিন্তু মার্কসবাদ বুঝত না; তারা বুঝত শুধু মাত্র নুন-ভাতের সংস্থান। কিন্তু দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে অহমিকা জন্মাল, তারা ভেবে নিল জনগণ তাদের সম্পদ; তারা যা বলবে, যা করবে, তা অবলীলায় সাধারণ মানুষ মেনে নেবে। এখানেই মস্ত ভুল করেছিল তারা। এ বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই ভুলই করলেন। মনে রাখতে হবে, সাধারণ মানুষের কোন রং নেই। সংসদীয় গণতন্ত্রে মানুষই শেষ কথা বলবে। এত দ্রুত রাজ্যে ফের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেখা দেবে, তৃণমূল নেতৃত্ব তা বোধহয় বুঝে উঠতে পারেননি।

তৃণমূলের মনে হয়েছে তারা প্রভূত উন্নয়ন করেছে— কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রী, সবুজ সাথী, রেশনে দু’টাকা কিলো দরে চাল, বেকার ভাতা, ক্লাবগুলিকে সাহায্য, শিল্পীদের অর্থসাহায্য ইত্যাদি। আপাতদৃষ্টিতে এগুলি সবই উন্নয়ন; কিছু মানুষ এতে উপকৃত হয়েছেন—এ নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু যখন দেখি পাড়ার চাকরিজীবী দাদা অথবা বড় ব্যবসায়ী রেশনে দু’টাকা কিলো দরে চাল কিনে দোকানে ১৫ টাকায় বিক্রি করছে, শিক্ষার্থীরা কন্যাশ্রীর টাকা জমিয়ে মোবাইল অথবা স্কুটি কিনছে, স্কুল থেকে প্রাপ্ত সাইকেল সামান্য টাকায় বাইরে বিক্রি করছে, তখন যন্ত্রণা হয়। এই টাকা তো নেতানেত্রীদের পকেট থেকে আসেনি, এই সব প্রকল্পের টাকা জনগণের টাকা। এ দিকে সাইকেলের খুচরো ব্যবসায়ী, বইয়ের দোকানদার, স্কুলব্যাগ ও স্কুলড্রেসের দর্জি-বিক্রেতা সকলের চোখেমুখে হতাশা, বিকিকিনি তলানিতে ঠেকেছে।

শিক্ষাক্ষেত্রেও অবস্থা তথৈবচ। পড়াশোনার তুলনায় মিড-ডে মিল আর ‘শ্রী’ প্রকল্পগুলি বাস্তবায়নের দিকে নজর বেশি। ছেলেমেয়েরা ভূরি-ভূরি নম্বর পাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু গাদা গাদা নম্বর পেয়েও চাকরি পাওয়ার নিশ্চয়তা আছে কি? হুগলি নদীর দুধারে সারি-সারি কারখানার কঙ্কাল। বর্তমান সরকার শিল্প সম্প্রসারণ যেমন করেনি, তেমনি নতুনও গড়েনি। নতুন নতুন ইঞ্জিয়ারিং কলেজ গড়ে উঠলেও ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পরে গলায় পদক ঝুলিয়ে ঘোরা ছাড়া উপায় নেই; এটা প্রাইভেট কলেজ থেকে এক গাদা টাকা খরচ করে বিএড পাশ করার পর সার্টিফিকেট প্রাপ্তির সমতুল।

আনুপাতিক দিক দিয়ে এই রাজ্যে চাকরিজীবীদের সংখ্যা কম; তাদের ভোটে ফলাফলের তেমন হেরফের হয় না; শাসকদল সেটা ভাল করেই জানে। আর তাই তাদের ন্যায্য পাওনাগন্ডা মেটাতে এত গড়িমসি। কিন্তু চাকরিজীবীদের পকেটে যদি পয়সা না থাকে, তবে খুচরো ব্যবসায়ীদের বিকিকিনি কমে আসে; বাজার পড়ে ঝিমিয়ে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়।

কিন্তু সরকারি চাকুরেরা ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারিদের সঙ্গে বেতন কাঠামোর ফারাক রাজ্য সরকারি কর্মচারিরা হয়তো মেনে নিতে পারতেন, যদি দেখা যেত, তাঁদের প্রাপ্য টাকায় বেকারদের চাকরি দেওয়া হচ্ছে, রাজ্যে শিল্প গড়ে উঠেছে। কিন্তু সেই টাকায় তো হরির লুট চলছে; উৎসব চলছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এই ক’বছরে এক কোটি সাইকেল বিলি না করে, সেই টাকায় রাজ্যে একটা বড় শিল্প তো গড়ে তোলা যেত!

সবচেয়ে বড় কথা, সংসদীয় রাজনীতিতে ‘বিরোধীশূন্য’ বলে কোনও কথা হয় না; সেটা ঠিকও নয়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও এক সময়ে বিধানসভায় ‘ক্ষীণকায়া’ বিরোধী শিবিরের উদ্দেশে কটাক্ষ করেছিলেন; তার ফল কিন্তু তাঁকে পেতে হয়েছিল হাতে-নাতে। বর্তমান শাসক দলও ইতিহাস-বিস্মৃত হয়ে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যকে বিরোধীশূন্য করতে চাইল এবং নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারল। সেই প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থানের প্রবল সম্ভাবনা তৈরি হল। তৃণমূলের উঁচু থেকে নিচুতলার কর্মীরাও এর জন্য কম দায়ী নয়। বামেদের মতো এরাও ভেবে নিয়েছে জনগণ তাদের সম্পত্তি; কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এখানেই।

মনে রাখতে হবে বেকার যুবক-যুবতীরা দেশের একটা বড় ভোটব্যাঙ্ক। তাঁদের যেমন চাকরি চাই, তেমনই সাধারণ মানুষও চায় নিরুপদ্রবে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে। কিন্তু যে কোনও সমস্যা নিয়ে গেলে শাসক দলের নিচুস্তরের কর্মীরাও হাত পেতে বসে সাধারণ মানুষের কাছে; টাকা ফেললে তবেই কাজটি সম্পন্ন হবে। সে গৃহনির্মাণের অনুমতি নেওয়াই হোক বা পাশের বাড়ির গন্ডগোল মেটানো। রাজনীতি এখন সত্যিই পেশা। সামান্য পঞ্চায়েত সদস্যও দু’দিনে আঙুল ফুলে কলাগাছ।

অনেকেই এখন বলেন, এখনকার রাজনীতিতে পেশিশক্তির জায়গা সবার উপরে। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে চারপাশের ঘটনা তারই সাক্ষ্য বহন করে। ক্লাব, পার্টি অফিস, কলেজে ছাত্র সংসদ, পঞ্চায়েত দখল করার রাজনীতি নতুন নয়। নিজেকে বাঁচাতে নেতানেত্রীদের জার্সি বদলও আকছার ঘটছে। যে জন্য মানুষ এক দলের বদলে অন্য দলকে ভোট দিল, তাদের দিয়ে উদ্দেশ্য সফল হবে তো? সাধারণ মানুষের প্রাপ্তিই বা কতটুকু? প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Mamata Banerjee Governance
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE