গাঁধীজি এক জন নিতান্ত আটপৌরে মানুষ, নেহরু, সুভাষ, কিংবা জিন্নার মতো বহিরঙ্গের চটক যাঁর মধ্যে একান্তই অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু তিনি যে ভাবে সারা ভারতবাসীর মন জয় করে নিয়েছিলেন তা ছিল এক কথায় অকল্পনীয়। তিনি রাজনীতির এক নতুন ঘরানা তৈরি করেছিলেন যা ছিল পাশ্চাত্য ঘরানার তথাকথিত আধুনিক রাজনীতির বিপরীত। ১৯০৯ সালে ‘হিন্দ স্বরাজ’-এ তিনি তাঁর ভাবনাচিন্তার মূল কাঠামোটা তুলে ধরেন। পরবর্তী কালে তাতে কিছু পরিবর্তন এলেও মূল কাঠামোটি প্রায় অপরিবর্তিত থাকে।
গাঁধীজির কাছে স্বরাজ মানে প্রত্যেক মানুষের নিজের জীবনের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ। তিনি বলেন এটা সম্ভব হতে পারে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে, কারণ কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাই হিংসার উৎস। হিংসা বলতে শুধু শারীরিক নিগ্রহ ও রক্তপাত নয়, ব্যক্তিত্বের ধ্বংসই হিংসা। এ রকম দমনমূলক কেন্দ্রীকরণের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত হল রাষ্ট্র। ব্যক্তিগত স্তরে স্বয়ম্ভরতা দিয়ে সেই হিংসার প্রতিরোধ প্রয়োজন। সে কারণেই তিনি জোর দেন নিজেদের খাদ্যবস্ত্র যথাসাধ্য উৎপাদন করার ওপর, যাতে জীবনধারণের প্রাথমিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমে। অবশ্য পুরোপুরি স্বয়ম্ভরতা কোনও সমাজের পক্ষেই সম্ভব নয়। বেঁচে থাকার জরুরি প্রয়োজনগুলি মেটাবার জন্য মানুষকে পরস্পরের ওপর নির্ভর করতেই হয়। তার জন্য গাঁধীর বিকল্প ব্যবস্থা সমবায়, যাতে কেউ কারও ওপর আধিপত্য বিস্তার করবে না, কেউ কারও অধীন হবে না। সমমর্যাদার মানুষরা স্বেচ্ছায় সামাজিক নিয়ন্ত্রণ মেনে নেবে নিজেদের প্রত্যেকের ও সমগ্র সমাজের মঙ্গলের জন্য। গাঁধীর বিকেন্দ্রীকরণ প্রকল্পের একক হল গ্রাম, যা শুধু অর্থনৈতিক ভাবেই নয়, প্রশাসনের ক্ষেত্রেও স্বয়ম্ভর হবে। কোনও ক্ষেত্রে গ্রামস্তরের সংগঠন যথেষ্ট না হলে একই নীতির ভিত্তিতে একাধিক গ্রামের সমবায় গড়ে তোলা যায়।
গাঁধী ব্রিটিশ শাসনকে সমালোচনা করেন খুব মৌলিক স্তরে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যে সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত তিনি আসলে তারই সমালোচনা করেন, ‘যত পারো উৎপাদন করো, যত পারো ভোগ করো ও তার জন্য নির্মম প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হও’— সীমাহীন আকাঙ্ক্ষা ও ভোগের এই যে মানসিকতা, গাঁধীর মতে এটাই সাম্রাজ্যবাদের মূল চালিকাশক্তি। আত্মনির্ভরতার প্রতীক হিসেবে গাঁধী চরকাকে তুলে ধরেন, এবং তুলে ধরেন সহযোগী অন্যান্য কুটিরশিল্পকেও, যা গ্রামের মানুষদের স্বয়ম্ভর করে তুলবে। শুধু গ্রামের গরিবদের নয়, গাঁধী চরকা কাটার পরামর্শ দিয়েছিলেন শহুরে ও ধনীদেরও। আলস্য ত্যাগ ও কায়িক শ্রমের উপযোগিতা অনুধাবন করার জন্য।
জাতীয় নেতৃবর্গের কাছে স্বরাজ মানে ছিল ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি। কিন্তু গাঁধীর কাছে তা ছিল স্বরাজ অর্জনের পথে একটি ধাপ মাত্র। মৃত্যুর কয়েক দিন আগেই তিনি কংগ্রেসের অবলুপ্তির ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন স্বাধীনতা লাভের পর কংগ্রেসের প্রয়োজন ফুরিয়েছে এবং তাকে নতুন পরিস্থিতির উপযুক্ত করে পুনর্গঠন করা প্রয়োজন। প্রয়োজন হলে তিনি যে নতুন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতেও তিনি পিছপা হবেন না তা প্রায় পরিষ্কার হয়ে যায়। তাঁর এক কালের সহকর্মীদের কাছে গাঁধীজি অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠেন। তাঁর মৃত্যুর পর সরকারি উদ্যোগে মহা সমারোহে গাঁধীভজনা চলতে থাকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে গাঁধীবাদের স্বপ্নগুলিকে কার্যত বিসর্জন দিয়েই।
কিন্তু গাঁধী তর্পণ করে যাঁরা ভেবেছিলেন গাঁধীবাদকে নিষ্ক্রিয় করা গিয়েছে, তাঁরা ভুল ভেবেছিলেন। গাঁধীর ভূত বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে বিভিন্ন রূপে। বিনোবা ভাবের ভূদান আন্দোলন, সুন্দরলাল বহুগুণার পরিবেশ আন্দোলন, নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের মতো নানা আন্দোলনের মধ্যে সেকেলে হয়ে যাওয়া গাঁধী সাম্প্রতিক হয়ে ওঠেন। কেন্দ্রীয় শক্তির আস্ফালনের বিরুদ্ধে গাঁধীবাদ প্রতিরোধের ভাষা হয়ে উঠতে পারে, রাজনৈতিক আন্দোলনের নতুন ছক তৈরি করতে পারে আজকের বিশ্বায়িত দুনিয়াতেও। গাঁধীবাদী ভাবনাচিন্তা যে প্রথাগত শ্রমিক আন্দোলনের চেহারা বদলে দিতে পারে তা স্পষ্টতই দেখা গিয়েছে শঙ্কর গুহ নিয়োগীর আন্দোলনে, যেখানে মজুরি বৃদ্ধির পাশাপাশি শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, পরিবেশ, আত্মসম্মান বৃদ্ধিও জায়গা করে নেয় শ্রমিক আন্দোলনের কর্মসূচিতে।
গাঁধীর ভাবনাচিন্তায় পরিবেশ একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে। উন্নয়নের নামে নির্বিচারে পরিবেশ ধ্বংস করে মানবসভ্যতা আজ খাদের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের স্বপ্নের পৃথিবী আজ বসবাসের অযোগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতি ও মানুষের নিবিড় সম্পর্ক গাঁধীর বিশ্ববীক্ষার অন্যতম স্তম্ভ ছিল। প্রকৃতি আমাদের উজাড় করে রসদ জুগিয়ে চলেছে জীবনধারণের। কিন্তু মানুষের অপরিসীম লোভ তাকে শেষ করতে চলেছে। তিনি তাই বলতে পারেন, এই পৃথিবী, বায়ু, জমি, জল আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া সম্পত্তি নয় বরং পরবর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে নেওয়া ধার, যা আমাদের তাদের হাতে তুলে দিতে হবে, অন্তত সেই অবস্থায়, যে অবস্থায় আমরা তাকে পেয়েছিলাম। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কোন পৃথিবীকে রেখে যাব? এই প্রশ্ন গাঁধীজি কত দিন আগে করে গিয়েছেন, ভাবলে অবাক হতে হয়। তিনি আমাদের সচেতন করেছেন যে, এই পৃথিবী আমাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য যথেষ্ট হলেও লাগামছাড়া লোভ মেটানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়।
গাঁধীজির পরিবেশভাবনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে তাঁর আশঙ্কা। দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে পথ পশ্চিমি দেশগুলো আমাদের সামনে রেখেছিল তাতে তিনি আতঙ্কিত হয়েছিলেন। সেই উন্নয়ন কেবলমাত্র মুষ্টিমেয় মানুষের বস্তুগত উন্নয়নকেই প্রকৃত উন্নয়ন বলে ভাবাতে শিখিয়েছিল আমাদের— পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্র প্রায় একই পথ অবলম্বন করেছিল। এর বিপরীতে গাঁধী এক বিকল্প উন্নয়নের মডেল তুলে ধরেছিলেন যার মূল ভিত্তি ছিল পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে স্বনির্ভরতা অর্জন। নির্মম প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতার মধ্য দিয়ে স্বয়ম্ভরতা। পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্নতা নয়, পরিবেশের সঙ্গে নিবিড় ভালবাসার বন্ধনে জড়িয়ে থাকা। স্বাভাবিক ভাবেই পশ্চিমি উন্নয়নের নির্বোধ অনুকরণ দেখে তিনি আহত হয়েছিলেন। এমন উন্নয়ন যা স্বাধীন ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষকে তাদের পরিবেশ থেকে উৎখাত করে ‘আধুনিক ভারতের মন্দির’ নির্মাণের স্বার্থে, যে উন্নয়ন গরিবকে আরও গরিব করে, ধনীকে আরও ধনী। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষকে আরও প্রান্তিক করে তোলে। গাঁধীর মতো সেকেলে মানুষকেই বোধ হয় আজ আমাদের বেশি প্রয়োজন।
আজকের বিশ্বে সবচেয়ে দুর্লভ ও মহার্ঘ বস্তু হল শান্তি— ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় ক্ষেত্রেই। সারা দুনিয়া আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সারা পৃথিবী জুড়ে শত সহস্র লড়াই হয়েছে বা হচ্ছে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। বড় যুদ্ধের পর নিয়ম করে শান্তি সম্মেলন হয়েছে, যা আবার নতুন অশান্তির জন্ম দিয়েছে। হিংসা দিয়ে যে শান্তি আনা যায় না, গাঁধী তাঁর জীবন ও কাজের মধ্য দিয়ে তা বোঝানোর চেষ্টা করে গিয়েছেন। সশস্ত্র শান্তি যে প্রকৃত শান্তি নয়, তা আজ আর বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। অথচ সেই শান্তির মরীচিকার পিছনে না ছুটে আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তোলার উদ্যোগ করি না সে ভাবে। শুধু আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ও আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। সন্ত্রাস দমনে রাষ্ট্রীয় প্রতি-সন্ত্রাস সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে।
ধর্ম নিয়ে গাঁধীজির ভাবনাচিন্তাও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক আজ। যাকে আমরা সচরাচর ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি মনে করি গাঁধীজি তাতে বিশ্বাসী ছিলেন না। পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা গড়ে উঠেছিল পোপতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের মধ্যে এক দীর্ঘ ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে, যা ভারতের ক্ষেত্রে খাটে না। পাশ্চাত্য ধাঁচের ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা আরোপিত মনে করেছিলেন তিনি। তিনি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করতেন নিজ ধর্মে স্থিত হয়েও অন্য ধর্মের ভাল দিকগুলোকে গ্রহণ করা যায়। ইতিহাসের পরিহাস এই যে, গাঁধীর জন্মভূমিতে দাঁড়িয়েই এক দল মানুষ হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য প্রচার করছেন অন্য ধর্মের প্রতি বিষোদ্গার করে। তাঁরাই আবার গাঁধী আরাধনাও করছেন ধুমধাম করে।
সাত দশক আগে গাঁধী নিহত হলেও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গাঁধীদের তাই দেখা যায় বার বার। ১৯৮০’র দশকে পোল্যান্ডের শ্রমিকরা যখন কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন, তাঁরা তাঁদের নেতা লেচ ওয়ালেসাকে তাঁদের গাঁধী বলে ঘোষণা করেন। গাঁধীর শান্তিপূর্ণ অথচ সক্রিয় প্রতিরোধের ধারণা তাঁদের আন্দোলনকে পুষ্ট করে। একই ভাবে ফিলিপিন্স-এ বেনিনো আকুইনো যখন নিহত হন, ম্যানিলার রাজপথে একই চিত্র দেখা যায় যা পোল্যান্ডে দেখা গিয়েছিল। মানুষ তাঁকে তাঁদের গাঁধী বলে সম্বোধন করেন। মায়ানমারের ছাত্ররা যখন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে রাস্তায় নামেন তখনও গাঁধীর দেখা পাই আমরা, তাঁদের নেত্রী আউং সান সু চি গাঁধী হয়ে ওঠেন। খান আব্দুল গফ্ফর খান থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা, বার বার তাই গাঁধীরা ফিরে এসেছেন বিভিন্ন রূপে। ভবিষ্যতের গাঁধীরা তৈরি হচ্ছেন গ্রেটা থুনবার্গদের মতো কিশোরকিশোরীদের মধ্য থেকে যাঁরা নির্লজ্জ, স্বার্থপর বুড়োখোকাদের পরিবেশ বাঁচাতে সচেতন করছেন, সারা বিশ্ব জুড়ে আন্দোলন গড়ে তুলছেন এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলার জন্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy