কিটস মৃত্যুর ঠিক আগে নিজের এপিটাফ লিখেছিলেন, ‘হেয়ার লাইজ় ওয়ান হুজ় নেম ওয়াজ় রিট ইন ওয়াটার’। যদি লিখতেন বোধহয় ঠিক বিপরীত হত রবীন্দ্রনাথের ভাবনা। যদিই বা কেন, তিনি তো সারা জীবন ধরেই বার বার তাঁর বিদায়বেলার মুহূর্তটির মুখোমুখি হতে চেয়েছেন কল্পনায়। বলা যায়, দীর্ঘ সৃজনজীবনে, তিনি নিজেই তাঁর নিজস্ব দর্শনকে প্রতিস্থাপিত করে ‘বাইশে শ্রাবণ’কে এমন ভাবে ‘নির্মাণ’ করে গিয়েছেন যে আমাদের সাধ্য কি তার বাইরে অন্য কিছু ভাবি! শুধু নিজের মৃত্যু নয়, আপামর বাঙালির জন্যও রবীন্দ্রনাথ এমন এক শান্ত সমাহিত বিদায় আবহ রচনা করে গিয়েছেন যে, প্রিয়জনের চিরবিদায়কে কবি নির্মিত এই ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর বৃত্তের মধ্যে এনে আমরা একটু মনের আরাম খুঁজি।
এ পথ দেখিয়ে ছিন্নপত্রাবলীতে তাঁর লেখা, ‘ব্যক্তি হিসেবে দেখতে গেলে মৃত্যু কত উৎকট, যার মধ্যে কোনো সান্ত্বনা নেই কিন্তু বিশ্বজগতের হিসেবে দেখতে গেলে মৃত্যুটা অতি সুন্দর ও মানবাত্মার সান্ত্বনাস্থল’। আশৈশব উপনিষদে দীক্ষিত কবি এই বিশ্বাসে শান্তি পেতে চেয়েছেন যে, মৃত্যু শুধু স্থূল শরীরের পরিত্যাগ, আমিত্বের চেতনাবিলোপ, আত্মা অখণ্ড মহাবিশ্বে বিলীন হয়। কিন্তু সংশয় সদা তাড়া করে ফিরেছে।
সারা জীবন ধরে একের পর এক প্রিয়জনের মৃত্যু তাঁর পিছু ছাড়েনি তিনিও মৃত্যুর সঙ্গে বোঝাপড়া ছাড়েননি। কুড়ি বছরের টগবগে যৌবনেও তিনি মৃত্যু নিয়ে ভাবছেন, মৃত্যুর বাঁধা ছক ভেঙে ফেলছেন, ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যামসমান’।
৩১-এর ভরা জীবনে নিরালা রাতেও সেই পরানসখার সঙ্গে তাঁর দে দোল দোল খেলা, ‘আমি পরানের সাথে খেলিব আজিকে মরণখেলা নিশীথবেলা’। ‘ঝুলন’ কবিতায় ‘আমি’ আর ‘সে’, জীবন আর মরণের দ্বন্দ্বকে পাশাপাশি বসিয়ে বুঝিবা এক সমঝোতার চেষ্টা, ‘মরণদোলায় ধরি রশিগাছি/ বসিব দুজনে বড়ো কাছাকাছি,/ ঝঞ্ঝা আসিয়া অট্ট হাসিয়া মারিবে ঠেলা,/ প্রাণেতে আমাতে খেলিব দুজনে ঝুলন-খেলা/ নিশীথ বেলা’।
রাধাভাবে শ্যামরূপে মৃত্যুকে কামনা করেও সংশয় একটু থেকেই যায় আর সেই শঙ্কাকে জয় করার আকুতি সবখানে, ‘...জীবন আমার/ এত ভালোবাসি বলে হয়েছে প্রত্যয়,/ মৃত্যুরে এমনি ভালো বাসিব নিশ্চয়’। কখনো বা ধৈর্যচ্যুতি, ‘...নূতন ঊষার স্বর্ণদ্বার খুলিতে বিলম্ব কত আর’। আবার তার পরেই সম্পূর্ণ বীপ্রতীপ ঘোষণা, ‘...মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’! এই দ্বন্দ্বে দীর্ণ হতে হতে ‘মৃত্যুঞ্জয়’ কবিতায় সেই দুর্জয় নির্দয় মৃত্যু, পৃথিবী কাঁপে যার শাসনে তাকে শেষ পর্যন্ত জয় করেই ফেললেন, ‘আমি মৃত্যু চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা ব’লে/ যাব আমি চলে’। এর পরেও মৃত্যুদর্শন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনের ভিতরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভবের প্রকাশ সমগ্র রবীন্দ্রনাথ রচনাবলী জুড়ে। কেমন হবে রবিহীন পৃথিবী, কল্পনায় তা বারবার আসে কবির মনে, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’ অথবা ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে/ কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি/ কৌতূহলভরে’। মৃত্যুকে অস্বীকার করার কোনও পথ নেই। অনন্ত সময়ের কাছে নগণ্য একটি বিন্দুও নয় জীবনের অবস্থান। ‘হায় রে নির্বোধ নর,/ কোথা তোর আছে ঘর,/ কোথা তোর স্থান’। এই সত্যবীক্ষণ হলে তাকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। ‘যেতে যদি হয় হবে—/ যাব, যাব, যাব তবে’। এ বার নিঃশর্ত সমর্পণ। অমোঘ সত্যকে যতখানি নান্দনিক ভাবে নির্মাণ করা যায়, পূজা পর্যায়ের সব গানেই তারই প্রকাশ।
ধূসর নরম আলো বিছানো চরাচর। না রাত না দিন। ছায়া ছায়া অচেনা গাছ। অচেনা ফুলের গন্ধ। আকাশ জল ঝরায় কিন্তু কেউ ভেজে না। অস্পষ্ট দিগন্তরেখার দিকে এক আলোকিত প্রাণ ধীরে হেঁটে চলেছেন, সাদা কালো ওয়াশে আঁকা, কোনও রং নেই তবু কী বর্ণময় দ্যুতি। আবহসঙ্গীত বাজে, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে’। কোনও উচ্চকিত শব্দ নেই। কেউ আঁচলে চোখ মুছলে কানে বাজে, ‘নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ,/ সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে’
আকাশগঙ্গায় ঢেউ ওঠে পড়ে, পায়ের কাছের ঝরাফুল কুড়িয়ে প্রিয়জন যখন দীর্ঘশ্বাস গোপন করতে পারেন না, তখন তার কর্ণকুহরে কেউ গেয়ে চলেন, ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতদূরে আমি ধাই/ কোথাও দুঃখ কোথাও মৃত্যু কোথা বিচ্ছেদ নাই’।
তার পরেও কখনও কেউ ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘আর কি গো দেখা হবে,/ আর কি সে কথা কবে,/ কেহ নাহি জানে’। ঠিক তখনি ফুটে ওঠে, ‘ফুরায় যা, তা/ ফুরায় শুধু চোখে,/ অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার/ যায় চলে আলোকে।/ পুরাতনের হৃদয় টুটে/ আপনি নূতন উঠবে ফুটে,/ জীবনে ফুল ফোটা হলে/ মরণে ফল ফলবে’।
সারা জীবন ধরে জন্ম ও মৃত্যুর জটিল অঙ্ক মেলানোর সাধক রবীন্দ্রনাথ। জীবনস্মৃতিতে তাঁর নিজের কথায়, ‘আমার তো মনে হয় আমার কাব্যরচনার এই একটি মাত্র পালা। সে পালার নাম দেওয়া যাইতে পারে, সীমার মধ্যেই অসীমের সহিত মিলনসাধনের পালা’।
‘বাইশে শ্রাবণ’ আসলে কোনও বিচ্ছেদ, কোনও চলে যাওয়া নয়, শত শ্রাবণের বৃষ্টিও নেভাতে পারে না, এমন এক স্থির অকম্পমান অনন্ত চিরাগশিখার নির্মাণ, যাকে কেউ ‘মৃত্যু’ বলে ভুল নামে ডাকে!
দুর্গাপুরের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy