নদিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বসবাসকারী পূর্ববঙ্গ থেকে আগত এক সুবিশাল জনগোষ্ঠী তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত চড়কের লোকায়ত সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে পূর্বজ প্রকরণকে অক্ষত রেখে।
কথায় বলে ‘চোতের ঢাকে কাঠি পড়েছে’— অর্থাৎ গাজনের বাজনা বেজে উঠেছে। ‘অন্ত্যজ শ্রেণির মহোৎসব’ চড়ক-গাজন বাংলার লোকসমাজে বর্ষশেষের অনুষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত। অঞ্চলভেদে এ উৎসব ‘দেলপুজো’ নামেও পরিচিত। লোকনাট্যের লক্ষণাক্রান্ত চড়ক, বাংলাদেশের আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে ইতিহাস ও ভূগোলের পটভূমিকায় বিবর্তিত ও বিকশিত হয়েছে। যুগে যুগে জনজাতির বিবর্তন, বিচিত্র সংস্কৃতিধারার ঘাত-প্রতিঘাত এবং সংযোগ-সমন্বয়ের সম্মেলনে গড়ে ওঠা চড়ক উৎসব এখনও পরিশুদ্ধ আচার-প্রবণতায় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। পশ্চিমি হাওয়া ও চটকদার অত্যাধুনিক চলতি-সংস্কৃতি আঁচড় কাটতে পারেনি নদিয়ার চড়কের মূল পূজাচারে। লোকায়ত মননে গুরু-শিষ্য পরম্পরাগত ভাবে চড়কের দীর্ঘলালিত ধারা আজও একই ভাবে প্রবহমান এই জেলায়।
গ্রামবাংলার নিম্নবর্গীয় শ্রমজীবী (বিশেষ করে কৃষিজীবী) মানুষেরাই এই উৎসবের মূল হোতা। কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্যে দিয়ে এই শিবসাধনা বাঙালি হিন্দুদের অন্য পালা-পার্বণের চেয়ে একটু ভিন্ন ধরনের। একদিকে গভীর নিষ্ঠা, অন্যদিকে অধ্যাত্মবাদে প্রবল বিশ্বাস চড়ক বা দেল পার্বণকে বিশুদ্ধ ধর্মাচরণমূলক অনুষ্ঠানের শিরোপা দান করেছে। এ অনুষ্ঠানে আচার-আচরণের কোনও প্রকার ত্রুটি ঘটলে শিবের ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপিত হয়ে গাজুনে-সন্ন্যাসী শারীরিক ও মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং তার ফল ভোগ করতে হবে বংশানুক্রমে— এ বিশ্বাস লোকসমাজে আজও গভীর ভাবে প্রোথিত হয়ে আছে।
বাণ ফোঁড়া, বঁড়শি ফোঁড়া, দা বটি, কাঁটার উপর ঝাঁপ দেওয়া, গনগনে আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া— এ সব যন্ত্রণাদায়ক কঠোর শারীরিক কসরৎ কেন এ পুজোর সঙ্গে গভীর ভাবে অঙ্গীবদ্ধ এবং কেন শিবভক্ত বা পাটভক্ত্যারা সেই অসহনীয় কৃচ্ছ্রসাধনে ও পরিশুদ্ধি প্রবণতায় এখনও অটল— তা জানতে হিন্দুশাস্ত্র ‘ধর্মসংহিতা’য় একবার চোখ রাখা যাক। সেখানে কথিত আছে, পরম শৈব বাণরাজার কন্যা ঊষার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধের প্রণয় ঘটে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
এই প্রণয় কাহিনিকে কেন্দ্র করেই বাণরাজার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধকালে শ্রীকৃষ্ণের চক্রের আঘাতে বাণরাজার দুই হাত কাটা যায়। ছিন্নবাহু বাণরাজা রক্তাপ্লুত অবস্থায় শিবের সামনে নৃত্য শুরু করেন। তার নৃত্যে খুশি হয়ে শিব এই বর দেন যে, যদি কোনও শিবভক্ত এই রূপ শোণিতাক্ত কলেবরে সরল মনে নিষ্ঠাচারে নিরাহারে থেকে এমনি নৃত্য করে, তবে সে শিবের পুত্রবৎ হবে। বাণরাজার সেই নৃত্যের তিথিটাকেই গাজনের তিথি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সুদীর্ঘকাল ধরে সেই বিশ্বাস শিরোধার্য করে চলেছে শিবভক্তেরা। এই সব প্রথায় তাই আজও ভাটা পড়েনি এবং অন্যথাও ঘটেনি।
নদিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বসবাসকারী পূর্ববঙ্গ থেকে আগত এক সুবিশাল জনগোষ্ঠী তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত চড়কের লোকায়ত সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে পূর্বজ প্রকরণকে অক্ষত রেখে। এই জনগোষ্ঠীই এখনও বিশেষ ভাবে সংযুক্ত হয়ে আছে এই উৎসবের সঙ্গে। চড়কের দিন চরকির দুই প্রান্তে বঁড়শি ফুটিয়ে শিবভক্তের ঘোরা সবচেয়ে দৃশ্যমান হলেও এ উৎসব শুরু হয় চৈত্রমাসের তিনদিন বাকি থাকতে। প্রথমদিন ঘটপুজো বা ঘাটস্নান, দ্বিতীয় দিন নীলপুজো, তৃতীয় দিন চড়ক। যাঁরা চড়কের সময় সন্ন্যাসী বা ভক্ত্যা হন, তাঁরা পয়লা চৈত্র থেকে নিরামিষ আহার করেন। আতপ চাল আর শাক-সবজি সহযোগে দিনে এক বার খাবার গ্রহণ করেন। রাতে রুটি, ছাতু বা ফল, দুধ খেয়ে থাকেন। পোশাক বলতে চারহাতি সাদা থানকাপড়, গায়ে গেঞ্জি আর একখানা নতুন গামছা। গেরিমাটি (গেরুয়া রঙের মাটি) জলে গুলে তার ভিতর চুবিয়ে নেওয়া হয় কাপড় আর গেঞ্জি। সচরাচর এঁরা জুতো পরেন না। যদিও বা কেউ পরেন, তা অবশ্যই রাবারের। কখনই চামড়া-নির্মিত জুতো নয়। সকাল-সন্ধ্যায় শিবার্চনা অবশ্য করণীয়। এই এক মাস অনেকে হবিষ্যান্নও গ্রহণ করেন। রাতে শয়ন করেন মেঝেয় মাদুর পেতে। খাট-বিছানা কখনও ব্যবহার করেন না। দূরে থাকেন নারীসঙ্গ থেকেও। তেল, সাবান, চিরুনি কোনও কিছুই শরীরে স্পর্শ করান না। যাঁরা পিঠে বঁড়শি ফুটিয়ে চড়কে ঘোরেন, তাঁরা মেরুদণ্ডের পাশে নির্দিষ্ট জায়গায় এই এক মাস ধরে দুপুরে এবং রাতে পুরনো ঘি মাখান। এ কালের সৃষ্ট কোনও মলম বা ডাক্তারি পরামর্শে জায়গাটিতে উপযুক্ত করে তোলার জন্য কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
ঘটপুজোর দিন সূর্য পুব-আকাশে থাকাকালীন ঘটস্থাপন করা হয়। একজন কথক থাকেন, যিনি দেলপুজোর পূর্বাপর বৃত্তান্ত ছড়ার সুরে আবৃত্তি করে যান। তিনিই এই পুজোর পুরোহিত। যিনি ‘বালাদার’ নামে কথিত। কিন্তু তাঁকে ব্রাহ্মণ শ্রেণির হতে হবে, এমন নয়। যে কোনও গোত্রের, যে কোনও শ্রেণির তিনি হতে পারেন। তাঁর কণ্ঠে প্রথাগত সুরেই ছড়াগুলি উচ্চারিত হয়। কোনও আধুনিক সুর তার কণ্ঠে কখনওই স্থান পায় না। এই ছড়া বা গানগুলিকে বলা হয় ‘বালা’ বা ‘বালাকি’। সঙ্গে বাজে ঢাক আর কাঁসি। অন্য কোনও বাদ্যযন্ত্রের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তিন দিনের এই অনুষ্ঠানে এই দু’টি বাদ্যযন্ত্রই ব্যবহার করা হয়। এই তিন দিন সন্ন্যাসীরা পুজোর নির্দিষ্ট স্থানেই রাত কাটান চট বা খেজুর-পাতার পাটি অথবা মাদুর বিছিয়ে নিয়ে। বাড়ি গিয়ে বৈদ্যুতিক পাখার নীচে ঘুমান না। নীলপুজোর রাতে মূল সন্ন্যাসী ‘হাজরা-ভোগ’ রান্না করেন মাটিতে গর্ত খুঁড়ে কাদা দিয়ে তৈরি করা উনুনে। শ্মশান থেকে আনা কাঠ দিয়ে সেই উনুন জ্বালানো হয়। রান্না হয় মাটির হাঁড়িতে। অত্যাধুনিক রান্না-ব্যবস্থা সেখানে অচল।
চড়ক উৎসবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক অনুষ্ঠান ‘চড়ক-ঘোরা’। চরকির দুই প্রান্তে দড়ির সঙ্গে বাঁধা বঁড়শিতে ঝুলে থাকা পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের অধুনা-সভ্যতা-লালিত গাজুনে সন্ন্যাসীরা পিঠে বঁড়শি ফোঁড়ার আগে পানের মতো চিবিয়ে খেয়ে নেয় জঙ্গলের নিমুখি লতার পাতা আর শিকড়। টিটেনাস টক্সায়েড নয়, অ্যান্টিসেপ্টিক হিসেবে পায়ের গোছায় জড়িয়ে নেয় নিমুখি লতা। বেশ কিছুক্ষণ চরকিতে ঘুরপাক খাওয়ার পর চরকি থেকে তাদের নামিয়ে, পিঠের বঁড়শি খুলে খাইয়ে দেওয়া হয় আঁটি-সহ একটি কচি আমের অর্ধাংশ।
ব্যস, চিকিৎসা ওই পর্যন্তই।
কল্যাণী থেকে তেহট্ট-করিমপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ জনপদে উদ্যাপিত চড়ক উৎসবে সুদীর্ঘকাল ধরে উচ্চারিত হয় একই ধ্বনি ‘বলো শিব মহাদেব’, ‘বাবা তারকনাথের চরণের সেবা লাগে’। আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, আহাররীতি, গীতি-বাদ্যেও একই ধারা বহমান। এর কোনও প্রকার পরিবর্তন ঘটেনি আজও। তা সে চাকদহের বালিয়া, মসনের মাঠ, গাংনাপুরের খড়ের মাঠ কিংবা করিমপুরের নাটনা, ফলেয়া বা রানাঘাটের ফুলিয়া যেখানেই হোক না কেন। হিন্দুদের ধর্মাচরণে চড়ক অত্যন্ত পরিশুদ্ধ ও আচারনিষ্ঠ হওয়ায় অন্য ধর্মের মানুষ এখনও এর সংস্পর্শে আসেন না। যদিও ‘উদারতা’ শব্দটা এ কারণে কোথায় যেন একটু টোল খেয়ে যায়। তবুও ‘চড়ক’ আছে ‘চড়কে’ই।
লেখক সরিষাডাঙা ড. শ্যামাপ্রসাদ হাইস্কুলের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy