কে কাকে লুট করছে? প্রশ্ন তুলেছেন আমেরিকার প্রবীণ মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবিদ রিচার্ড উল্ফ। প্রশ্নের উপলক্ষ সে দেশের সাম্প্রতিক বিক্ষোভ। শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাঁটুর চাপে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের পৈশাচিক হত্যার পরে দেশ জুড়ে তুমুল বিক্ষোভে ইতস্তত আগুন জ্বলেছে, ভাঙচুর হয়েছে, লুটতরাজও। ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি দিয়েই চলেছেন— লুটপাট শুরু হলেই গুলি চলবে, কেউ ধরা পড়লে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে, ইত্যাদি। কেবল শাসকরা নয়, তার বাইরেও বহু মানুষ প্রতিবাদীদের সংযত থাকতে, ঘরে ফিরে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন। স্থিতাবস্থার চেনা পরামর্শ।
রিচার্ড উল্ফ চর্বিতচর্বণে যাননি, একটি মৌলিক প্রশ্ন তুলেছেন: লুণ্ঠন কাকে বলে? তার সাফ জবাবও দিয়েছেন: ‘গত দু’মাসে আমেরিকায় লুট হয়ে গেছে চার কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা, কারণ হঠাৎ তাঁদের কাজ চলে গেছে— এই ভয়ানক দুর্দিনে। জীবিকা-লুণ্ঠনের খাঁড়া ঝুলছে দেশের আরও বারো কোটি কর্মীর মাথার ওপর, যে কোনও মুহূর্তে যাঁদের কাজ চলে যেতে পারে বা উপার্জন কমে যেতে পারে— দেশে বেকার বাড়লেই কর্মীরা কম পয়সায় কাজ করতে বাধ্য হন, কারণ তাঁরা জানেন, এবং মালিকরাও জানেন যে, আরও কম পয়সায় খাটার জন্য অনেক বেকার লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।’ এই মহালুণ্ঠনের তুলনায় শো-রুমের কাচ ভেঙে টিভি সেট তুলে নিয়ে যাওয়া— তুশ্চু!
না, রিচার্ড উল্ফ দোকান লুট করাকে সমর্থন করছেন না। তিনি কেবল আমাদের চোখের সামনে যে ছবিটা আছে তার পরিপ্রেক্ষিতটা একটু ঠিক করে দিতে চাইছেন। আমরা ভাঙচুর লুটপাটের ছবি দেখছি, জীবিকা লুট হওয়ার ছবি দেখছি না, দেখলেও তাকে লুণ্ঠন বলে চিনতে পারছি না, তিনি চিনিয়ে দিচ্ছেন। সেই লুণ্ঠনের জন্য তিনি কোনও ব্যক্তিকে বা সংস্থাকে দায়ী করছেন না, এর দায় সেই ‘সিস্টেম’ বা ব্যবস্থার, যা এমন বিপদের দিনে কর্মীর জীবিকা ও জীবনের কোনও দায় স্বীকার করে না। ব্যবসার প্রয়োজনে যে কোনও সময় কর্মীদের বিদায় জানানোর স্বাধীনতা চায় সে। মুনাফা তার একমাত্র লক্ষ্য। যে কোনও মূল্যে। মনে রাখতে হবে, এই বিপর্যয়ে বহু ব্যবসায়ীও অস্তিত্বের লড়াই লড়ছেন। মন্দার তাড়নায় বহু ব্যবসা লাটে উঠছে, অনেক উদ্যোগী বিপন্ন, বহু সংস্থার পক্ষে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সব কর্মীকে বহাল রাখার সাধ্যই নেই তাঁদের। কিন্তু এই প্রক্রিয়া তো ধনতন্ত্রের স্বভাবধর্ম— আর্থিক সঙ্কট এই ভাবেই পুঁজির অতিকায় হয়ে ওঠার পথ প্রশস্ত করে। এক দিকে বহু শ্রমজীবীর (এবং স্বনিযুক্ত ব্যবসায়ী, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগী, ইত্যাদির) সর্বনাশ, অন্য দিকে তিমিঙ্গিলদের পৌষ মাস— দুইয়ের সমাহারেই লুণ্ঠনের ষোলো কলা পূর্ণ হয়, নিয়োলিবারাল ধনতন্ত্র সার্থক হয়। ভুললে চলবে না যে, এই অভূতপূর্ব অতিমারির বাজারে তিন মাসে মার্কিন বিলিয়নেয়ারদের সম্পদ বেড়েছে পঞ্চাশ হাজার কোটি ডলার!
এই কৃষ্ণগহ্বর থেকে মুক্তির পথ কী? সমাজতন্ত্র? রিচার্ড উল্ফ সমাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাস করেন। তিনি চান এক শোষণ-মুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে শ্রমিক-কর্মীরাই উৎপাদন সম্পর্কে সমস্ত সিদ্ধান্ত নেবেন, উদ্বৃত্তের বণ্টন নির্ধারণ করবেন। তেমন ব্যবস্থা জারি থাকলে শ্রমজীবীদের এই দুর্দশা হত না, মার্ক জ়াকারবার্গ, জেফ বেজ়োসদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার সুযোগও থাকত না। কিন্তু এই আলোচনায় উল্ফ সেই প্রসঙ্গে যাননি, যথেচ্ছ কর্মী ছাঁটাইয়ের মেড-ইন-আমেরিকা মডেলটির বিকল্প হিসেবে এখানে তিনি কোনও সমাজতন্ত্রের সম্ভাবনার কথা বলছেন না, বলছেন ইউরোপের একাধিক দেশের বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা। যেমন, জার্মানি। মন্দার কবলে সে দেশের অর্থনীতিও। কিন্তু কর্মসংস্থানের ছবিটা খুব একটা বদলায়নি। কোভিডের আগে বেকারত্বের হার যা ছিল, এখনও তা মোটামুটি একই আছে। ইউরোপের অন্য নানা দেশে, যেমন ডেনমার্কে, ফ্রান্সে বা হল্যান্ডে, ছবিটা মোটের ওপর একই রকম। এরা কেউই সমাজতান্ত্রিক দেশ নয়। তবে এদের আর্থিক নীতিতে সমাজতান্ত্রিকতার কিছুটা স্বীকৃতি আছে। এদের সরকার বলেছে, অতিমন্দার প্রকোপ সামলাতে বেসরকারি সংস্থাকে তারা সাহায্য করবে— কিন্তু এই শর্তে যে, কর্মীদের বহাল রাখতে হবে। সব দেশে সাহায্যের মাত্রা এক নয়, কর্মীদের বহাল রাখার অনুপাতও এক নয়, কিন্তু শর্তটা বহু ক্ষেত্রেই জারি আছে। আর তার ফলেই আমেরিকার মতো দেশের সঙ্গে একটা বড় তফাত ঘটে গেছে।
কেন হয় এমন তফাত? উত্তর: রাজনীতি। ইউরোপের বহু দেশে রাজনীতির বাস্তব আমেরিকা থেকে অনেক দূর। সেখানে শ্রমিক সংগঠনের গুরুত্ব আছে, জনকল্যাণে রাষ্ট্রের ভূমিকার স্বীকৃতি আছে, সমাজের স্বার্থে বাজারের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকে প্রয়োজনীয় মনে করার ঐতিহ্য আছে। বাজার অর্থনীতির কুমন্ত্রণায় সেখানেও এই ঐতিহ্যের জোর কালক্রমে কমেছে, কিন্তু বিপদের দিনে কর্মীদের পত্রপাঠ বিদেয় করার ব্যবস্থা সমাজ এবং রাজনীতি আজও সহজে মানবে না। সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই বেসরকারি সংস্থাতেও মার্কিন দুনিয়ার মতো গো অ্যাজ় ইউ লাইক চলে না। আর, কোনও সংস্থা আর্থিক সঙ্কটের কালে কর্মীদের কাজে বহাল রাখতে অক্ষম বা নারাজ হলে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হয়, বাজেটের ঘাটতি অনেক বাড়লেও। রাষ্ট্রের স্বভাব আকাশ থেকে পড়ে না, দেশের রাজনীতিই তাকে বিপন্ন মানুষের দায়িত্ব নিতে বাধ্য করে। বিল ক্লিন্টনের সেই স্লোগানটি ঈষৎ পাল্টে নিয়ে রিচার্ড উল্ফ বলতে পারেন: ইট’স দ্য পলিটিক্স, স্টুপিড!
রাজনীতিটাকে পাল্টানোর জন্য দরকার নতুন চেতনা, নতুন বোধ, নতুন ভাবে পৃথিবীকে দেখা। পুরনো ভাবনার আধিপত্যে ঘা দেওয়া। সহজ নয় সে কাজ। দীর্ঘকাল যাবৎ অর্থশাস্ত্রের আধিপত্যকারী ‘মূলধারা’য়— বিশেষত আমেরিকায়— সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র, মার্ক্সবাদ ইত্যাদি ধারণাগুলির ঠাঁই মেলেনি। ২০০৭-০৮’এর বিপর্যয়ের পরে অনেকে কার্ল মার্ক্স সম্পর্কে আগ্রহী হয়েছেন বটে, কিন্তু নিয়োলিবারাল ধনতন্ত্রের শেখানো চিন্তাকাঠামোর বাইরে দাঁড়িয়ে ভাবতে পারা আজও কঠিন। রিচার্ড উল্ফ সেই কঠিন কাজটিই শিখিয়ে চলেছেন, শুধু স্বদেশের নয়, দুনিয়ার পাঠক ও শ্রোতাদের। নিরলস আগ্রহে ইতিহাস ও সমকালের ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিক বিশ্লেষণ করে চলেছেন তিনি বিভিন্ন পরিসরে। তার অন্যতম হল ডেমোক্র্যাসি অ্যাট ওয়ার্ক নামক গোষ্ঠী ও তার ওয়েবসাইট, যেখানে তিনি নানা বিষয়ে কথা বলেন, প্রশ্নের উত্তর দেন, অন্য তাত্ত্বিক ও সমাজকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। সেখানেই এক সংক্ষিপ্ত ভিডিয়োতে সম্প্রতি তিনি বুঝিয়েছেন: কে কাকে লুট করছে। ক্ষমতাশ্রয়ী চিন্তার আধিপত্য ভেঙে প্রতিস্পর্ধী বিকল্প ভাবনার প্রসার ঘটাতে এই ভাবেই চলে তাঁর লড়াই।
প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি গড়ে তোলার লড়াই। যে রাজনীতি ক্ষমতাবানদের বাধ্য করবে ক্ষমতাহীনের জীবিকা ও জীবনের দায়িত্বকে স্বীকার করতে। সেই রাজনীতি যদি যথেষ্ট সংগঠিত হয়, তা হলে রাষ্ট্র এবং অর্থনীতির অধিপতিরা শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থকে অবলীলাক্রমে মন্দাক্রান্ত বাজারের আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলতে পারবেন না। সমাজতন্ত্র অনেক পরের কথা, আপাতত এই প্রাথমিক লক্ষ্যে এগনোর জন্যই রাজনৈতিক বোধের অনুশীলন জরুরি। ‘স্বাভাবিক’ স্থিতাবস্থার নিরন্তর শান্তিকল্যাণে যে মহালুণ্ঠন চলেছে, তাকে চিনে নেওয়া জরুরি।
রাজনীতি গড়ে তোলা কঠিন, হারিয়ে ফেলা সহজ। কত সহজ, আমরা তা হাড়ে হাড়ে বুঝছি। অগণন শ্রমজীবী মানুষের জীবন লুট হয়ে যাচ্ছে, জনস্বাস্থ্যের প্রাথমিক প্রয়োজনটুকুও অপূর্ণ, দেশের সরকার কথার ফানুস ওড়াচ্ছে, বড় পুঁজি বাজারের মাধ্যমে ছোট পুঁজিকে গ্রাস করছে এবং রাষ্ট্রের সাহায্যে আত্মসাৎ করছে প্রাকৃতিক সম্পদ— অথচ প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি স্তিমিত, ছন্নছাড়া। ইউরোপে— বা অন্যত্র— যা সম্ভব ভারতে তা-ই সম্ভব, এ-কথা বাতুলেও বলবে না। কিন্তু কী সম্ভব, কী নয়, তা তো পঞ্জিকায় লেখা থাকে না। রাজনীতি সম্ভাব্যতার শিল্প। তার অনুশীলন পিছু হটতে হটতে দিগন্তে বিলীন হয়েছে বলেই এ দেশে রাষ্ট্র ও অর্থনীতির অধিপতিরা এত নিশ্চিন্ত, নিরাপদ, বেপরোয়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy