Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Babri Mosjid

গণতন্ত্রের নিয়তি

কিন্তু ইতিহাস এই সত্যের অবিনশ্বর সাক্ষী থাকিবে যে, প্রায় সাড়ে চারশো বৎসরের পুরানো একটি সৌধ আধুনিক ভারতে প্রকাশ্য দিবালোকে ধ্বংস হইয়াছে

শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২০ ০১:০০
Share: Save:

আটাশ বৎসর আগে যাহারা বাবরি মসজিদ ভাঙিয়াছিল, ২০২০ সালটি তাহাদের নিকট বিশেষ ভাবে স্মরণীয় হইয়া থাকিবে, কারণ এই বৎসরেই অযোধ্যার ওই নিশানা-ভূমিতে রাম মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হইয়াছে। তাহাদের ভবিষ্যৎ-চিন্তা মন্দিরের স্বপ্নে নিবেদিত, বাবরি মসজিদ তাহাদের হিসাবে বিস্মৃত অতীত। কেবল বিস্মৃত নহে, বিস্মরণীয়। ঠিক সেই কারণেই এই দেশের পক্ষে, তাহার সমস্ত সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকের পক্ষে, তাহার ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের মৌলিক আদর্শের পক্ষে ৬ ডিসেম্বর তারিখটি অবিস্মরণীয়। রামচন্দ্র তাঁহার জন্মস্থান এবং ভাবী মন্দিরের মহিমা সহকারে বিরাজমান হউন, কিন্তু ইতিহাস এই সত্যের অবিনশ্বর সাক্ষী থাকিবে যে, প্রায় সাড়ে চারশো বৎসরের পুরানো একটি সৌধ আধুনিক ভারতে প্রকাশ্য দিবালোকে ধ্বংস হইয়াছে, সেই ধ্বংসের জন্য কেহ শাস্তি পায় নাই এবং— এই বৎসরটিই জানাইয়া দিয়াছে— কেহ শাস্তি পাইবেও না। ইতিহাস বিজয়ীরাই লিখিয়া থাকে। অযোধ্যা-কাণ্ডের নূতন সংস্করণ সেই চিরায়ত সত্যেরই প্রমাণ দিয়াছে। তৎসহ জানাইয়া দিয়াছে, ভারতীয় গণতন্ত্র এখন সংখ্যাগুরুতন্ত্রের নামান্তর— বিজয়ী সংখ্যাগুরুই এই দেশের নূতন ইতিহাস লিখিতে তৎপর। ধ্বংস ও নির্মাণ সেই তন্ত্রসাধনার দুই অঙ্গ।

সংখ্যালঘুর স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার দায় গণতন্ত্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব— এই সত্য বহু-আলোচিত। স্বাধীনতার পরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিকট লিখিত চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যে গভীর সহমর্মিতা ও উদ্বেগের সহিত সেই দায়িত্বের কথা স্মরণ করাইয়া দিয়াছিলেন, তাহার মর্ম অনুধাবনের সাধ বা সাধ্য কোনওটাই তাঁহার বর্তমান উত্তরসূরিদের নাই। কিন্তু সেই আদর্শের পুনরাবৃত্তি না করিয়া অন্য একটি বিষয়ে মনোযোগ করিবার সময় আসিয়াছে। সংখ্যালঘুর প্রতি দায়িত্ব অস্বীকার করিলে সংখ্যাগুরুর আপন স্বার্থও ব্যাহত হয় না কি? ক্ষুদ্র স্বার্থ নহে, বৃহৎ স্বার্থ? যে স্বার্থ অন্যকে উৎপীড়ন করিয়া বা অন্যের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করিয়া আপনাকে চরিতার্থ করে না, যাহা সকলের মঙ্গল বিধানের মধ্যেই আপনার সার্থকতা খোঁজে? ক্ষমতাবানের এই দায়িত্বের কথা বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করিয়া বুদ্ধ উপদেশ দিয়াছিলেন: সবলের ক্ষমতা আছে বলিয়াই দুর্বলের প্রতি তাহার দায়িত্ব আছে। ইহা নিছক সামাজিক নৈতিকতার দাবি নহে, আত্মোন্নতির অপরিহার্য শর্তও বটে। আজ, সবলের উৎপীড়ন মাত্রা ছাড়াইয়াছে বলিয়াই, সেই শর্তের মূল্য বহুগুণ বেশি।

ক্ষমতার কারবারিরা সেই মূল্য দিবেন না, তাহা নিশ্চিত। তাঁহাদের নৈতিকতার উপর ভরসা করা অসম্ভব। তাঁহাদের কথায় যাঁহারা নাচিতেছেন তাঁহাদের অনেকেই হয়তো এখনও শুভবুদ্ধি সম্পূর্ণ বিসর্জন দেন নাই। হয়তো আপন ক্ষুদ্রস্বার্থের আকর্ষণ তাঁহাদের এই সংখ্যাগুরুবাদের প্রতি অনুকূল করিয়া তুলিয়াছে। তাঁহারা ভাবিতেছেন, ‘ওদের’ দমন করিয়াই ‘আমাদের’ আধিপত্য নিরঙ্কুশ হইতে পারে, তাহাই জয়ী হইবার পথ। ভুল ভাবিতেছেন। একটি গোড়ার কথা ভুলিলে চলে না। অপরকে দমন করিয়া যে জয় হাসিল করা যায়, তাহা অন্তঃসারশূন্য, কারণ তাহা বিজয়ীকে আধিপত্যের অধিক আর কিছুই দেয় না, দিতে পারে না। অধিপতিরা ক্ষমতা দখল করেন, হয়তো নিরঙ্কুশ ক্ষমতাও, কিন্তু শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালবাসা, এই সকলই তাঁহাদের নাগালের বাহিরে থাকিয়া যায়— হৃদয় যাহার কঠিন হইয়া গিয়াছে দেবতার কথা সে শুনিবে কী উপায়ে? স্বভাবতই তাঁহারা আপন অনুগামীদেরও কেবলমাত্র ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার বা উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করেন, তাঁহাদের প্রতি কিছুমাত্র সহমর্মিতা ওই শক্তিমানদের মনে অ-সম্ভব। সংখ্যালঘু, আদিবাসী, দরিদ্র বা বিভিন্ন বর্গের প্রান্তিক এবং দুর্বল সহনাগরিকদের উপর উৎপীড়ন চালাইয়া অথবা তাঁহাদের ভয় দেখাইয়া রাজত্ব কায়েম রাখিবার প্রকল্পই যাঁহাদের রাজনীতির ধর্ম, তাঁহাদের অভিধানে কাহারও প্রতি কোনও সুস্থ অনুভূতির স্থান নাই, আপন ‘ভক্ত’দের প্রতিও নাই। একটি মসজিদ ভাঙিয়া যাহারা পৈশাচিক উল্লাসে উল্লসিত হয়, তাহাদের তৈরি মন্দিরের উচ্চতা যাহাই হউক এবং তাহা নির্মাণে যত শত কোটি টাকাই ব্যয় হউক, সেই মন্দিরে ভক্তের ভগবান থাকিতে পারেন না। ৬ ডিসেম্বর এই সত্যের মুখোমুখি

দাঁড়াইবার দিন। বাবরি মসজিদ যত দিন জীবিত ছিল, তত দিন সে ছিল একটি সৌধ। আজ সে এক অতিকায় প্রশ্নচিহ্নে পরিণত হইয়াছে: ভারতীয় গণতন্ত্র কি এই বার সংখ্যাগুরুর স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরিত হইবে?

অন্য বিষয়গুলি:

Babri Mosjid Ayodhya Ram Mandir Independent India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy