Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
সম্পাদকীয়

রূপকথা ও বাস্তব

কানাডায় একটি সমীক্ষায় দেখা গেল, সৎমায়েরা মোটেই নিষ্ঠুরা হন না, বরং তাঁহাদের অধিকাংশই ভাঙা সংসারকে এমন নিপুণ ভাবে জোড়া দেন, এবং স্বামীর ও তাঁহার প্রাক্তন স্ত্রীর সন্তানদের এমন স্নেহ ও প্রশ্রয়ে ভরাইয়া দেন, তাহারা অতি চমৎকার মানুষ হিসাবে গড়িয়া উঠে।

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৭ ০০:৫৫
Share: Save:

কানাডায় একটি সমীক্ষায় দেখা গেল, সৎমায়েরা মোটেই নিষ্ঠুরা হন না, বরং তাঁহাদের অধিকাংশই ভাঙা সংসারকে এমন নিপুণ ভাবে জোড়া দেন, এবং স্বামীর ও তাঁহার প্রাক্তন স্ত্রীর সন্তানদের এমন স্নেহ ও প্রশ্রয়ে ভরাইয়া দেন, তাহারা অতি চমৎকার মানুষ হিসাবে গড়িয়া উঠে। বিবাহবিচ্ছেদের পর যে পুরুষেরা পুনর্বিবাহ করেন, তাঁহাদের নূতন পত্নী আসিয়াই সংসারে অশান্তি করিবেন, সন্তানগুলিকে খেদাইয়া দিবেন, খাইতে দিবেন না, স্বামীর সহিত নিজের সন্তান হইলে তাহাদের অগ্রাধিকার দিবেন ও চাহিবেন স্বামীর পূর্বের সন্তানগুলি বাহির হইয়া যাউক— এমন ধারণা প্রাচীন রূপকথা হইতে জন্মানো বিচিত্র নহে। বিশেষত বিখ্যাত ‘সিন্ডারেলা’ রূপকথাটির কথা উল্লেখ করা হইয়াছে, যেখানে নিরীহ বালিকার প্রতি বিমাতা ও সৎভগিনীরা নৃশংস ব্যবহার করে। বাস্তবে এই ধারণার কোনও ভিত্তি নাই, বরং বিপরীতটিই সত্য, ইহাই সমীক্ষাটির প্রতিপাদ্য। ব্যাপারটি অভিনব নহে, কারণ পৃথিবীর অধিকাংশ ‘স্টিরিয়োটাইপ’ বা একধাঁচী ধারণাই ত্রুটিপূর্ণ, তাহা বাস্তবের সহিত সামঞ্জস্য না রাখিয়া বরং গল্প জমাইয়া তুলিবার একমাত্রিক উপায় হিসাবে বিরাজ করে। আসলে, মাতৃত্ব এমন প্রশ্নাতীত পবিত্র জ্যোতি পাইয়াছে, বিমাতা আসিয়া মাতার স্থান লইবেন এবং সুচারু ভাবেই সকল কার্য সম্পাদন করিবেন, সংসারে স্থিতি ও শান্তি আনিবেন— ইহা মানিয়া লইলে মাতার গৌরব স্তিমিত হয়। কথকদেরও মহা সংকট উপস্থিত হয়, কারণ এমন সহজে কাহিনির ভিলেন নির্মাণ আর সম্ভব নহে। বিমাতা আসিয়া দুধের শিশুদের অত্যাচার করিলে, তাহা পাঠকের হৃদয়কে মূহূর্তে দ্রব করিয়া তুলে ও প্রতিকারের আশায় চঞ্চল করিয়া তুলে।

রূপকথাগুলি কেবল সৎমায়ের ক্ষেত্রে নহে, বহু ক্ষেত্রেই এমন কিছু ধারণার বাহক, যাহা লইয়া ইদানীং বহু তাত্ত্বিক সরব হইয়াছেন। ‘হানসেল ও গ্রেটেল’-এর গল্পে তাঁহারা খুঁজিয়া পাইতেছেন শিশুনিগ্রহ, বন্দিদের সহিত অমানুষিক ব্যবহার, দাম্পত্য সম্পর্কে পরস্পরের প্রতি অশ্রদ্ধা। ‘রেড রাইডিং হুড’ পড়িয়া বলিতেছেন বালিকার মনের যৌন উৎকণ্ঠাকে এমন রূপ দেওয়া হইয়াছে। বাংলার লোককথায় দেখা যাইবে, বিনা দোষে বাঘকে অপদস্থ করিয়া চতুর শৃগালের হাস্য। দেখা যাইবে, নিজের সন্তান একটি বাড়তি পিঠা খাইয়া ফেলিয়াছে বলিয়া পিতা তাহাকে অরণ্যে পরিত্যাগ করিতেছেন। দেখা যাইবে বৃদ্ধাকে ডাকিয়া বাঘ বলিতেছে, তোকে খাইব। দেশ-বিদেশ জুড়িয়া লোককথা ব্রতকথা উপকথায় পুরুষের বীরত্ব ও নারীকে উদ্ধার, শ্বেতাঙ্গিনীর উদ্যম ও বামনদের পার্শ্বচরিত্র যাপন— রাজনৈতিক বেঠিকতার উৎসব। ইহা ব্যতীত, প্রতিশোধ, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, নিষ্ঠুরতা মিছিল করিয়া চলিয়াছে। হ্যামেলিনের বংশীবাদক একটি ব্যবসায়িক আদানপ্রদানে অসন্তুষ্ট হওয়ায় একটি গোটা শহরের সকল শিশুকে বিনাশের পথে লইয়া যাইতেছে। রূপকথাগুলিকে রাজনৈতিক ঠিকতা প্রয়োগ করিয়া নূতন করিয়া লিখিবার প্রবণতাও ইদানীং চলিতেছে।

আবার সেই প্রবণতাকে ব্যঙ্গও করা হইতেছে। কারণ, অনেকে মনে করিতেছেন, যে কাহিনিগুলি যুগ যুগ ধরিয়া দেশে দেশে মানুষ নির্মাণ করিয়াছেন, তাহাতে ঔচিত্যের মোড়লগিরি করিলে রসের প্রবল হানি হইবে। তাঁহারা প্রশ্ন তুলিতেছেন, মানুষ যদি অন্যায়কে জীবনের আবশ্যিক অঙ্গ হিসাবে মানিয়া লয়, আর তাহা জয় করিয়া নায়ক-নায়িকারা কাহিনির উপসংহারে অনন্তকাল সুখে কালযাপন করে, তবে সে দৃষ্টিভঙ্গিকে বিকৃত বলা হইবে কেন। বরং বিশ্বের কেবল ভাল দিকগুলিকে চিনির দানার ন্যায় শিশুদের গিলাইতে হইবে, এই ভাবনার মধ্যেই খণ্ডদর্শন রহিয়াছে। শিশুরা এই পৃথিবীতে নূতন আসিয়াছে বটে, কিন্তু তাহাদের বুঝিতে বিলম্ব হয় না যে এই গ্রহে সকলই শান্তিকল্যাণ হইয়া নাই। তদুপরি, সেই কথা বুঝানো অভিভাবকদেরও কর্তব্য। কেহ যদি কেবল জীবনের ইতিবাচক দিকগুলি সম্বন্ধে অবহিত হয় ও নেতিবাচক দিকগুলি সম্বন্ধে অজ্ঞ হইয়া থাকে, তাহার মানসিক গঠন একঝোঁকা হইয়া পড়িবে। বরং তাহাকে জীবনের বহু বর্ণ গন্ধ স্বাদের সহিত পরিচয় করাইলে, এবং ‘সততা ও চারিত্রিক জোর দিয়া আঁধার অতিক্রম করিবার শক্তি সংগ্রহ করা যায়’ শিখাইলে, সে সার্বিক দৃষ্টি লাভের সুযোগ পাইবে। আর, সকল গল্পের উদ্দেশ্য কেবল শিক্ষাদান, ইহাও উদ্ভট ধারণা। এই সকল তত্ত্বের টানাপড়েনে বাস্তবে মানুষের রূপকথা সম্পর্কিত ধারণার পরিবর্তন হইয়াছে কি না, তাহা লইয়া বরং সমীক্ষা হইলে ভাল।

যৎকিঞ্চিৎ

যুগে যুগে বীরত্বের সঙ্গে পৌরুষ, আর ভীরুতার সঙ্গে নারীত্বের সরলরেখা টানা হয়েছে। তা নিয়ে নারীবাদীরা প্রবল সরবও হয়েছেন। এ বার আমেরিকা যে ভয়ানক বোমা ফেলল, তার ডাকনাম দেওয়া হল, ‘সব বোমার মা’। বোঝাই যাচ্ছে, মার্কিন রণবিশারদরা কট্টর নারীবাদী, কারণ দুর্দান্ত দাপট বা দুরন্ত মারকুটেমি বোঝাতে ‘সব বোমার বাবা’ নাম দেওয়াই চলতি ধারণার সঙ্গে মানানসই হত। বাংলা অবশ্য আরও এগিয়ে, কারণ বোমা বলতে গেলে শেষে মা উচ্চারণ বাধ্যতামূলক!

অন্য বিষয়গুলি:

Fairy tale Reality
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE