পায়ের খানিকটা নীচে কাঁচা ডালপাতা নিয়ে আহ্লাদি পোষ্যের মতো খেলে বেড়াচ্ছিল ঘোলা জল। তার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক নিজেকেই বলছিলেন—ছেলেবেলা থেকে শুরু এই যুদ্ধ। আর যে পারি না। আর পারি না।বেলা গড়িয়ে গিয়েছে তখন। অস্তমিত সূর্যের গা ধোওয়া রং গাছপালা, মাথা-মুখ আর চারপাশের বাঁধ,জল— সব হলুদ হয়েছিল। তিরতিরে হাওয়ায় শব্দ হচ্ছিল গাছের পাতায়। তাকিয়ে দেখেছিলাম,হাতে রাখা মাটির ঢ্যালাতাঁরই বুড়ো আঙুলের চাপেগুঁড়োগুঁড়ো হয়ে যাচ্ছিল। দু’হাতে তালি বাজানোর মতো করে সেই ধুলো ঝেড়ে ফেলছিলেন জলে। নিজের জীবনের অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষার মতো সে সব মিলিয়ে গেল সেই ঘোলা জলের মধ্যে।
আয়লা-বিধ্বস্ত সুন্দরবনের আর্তি।
ঝড়ে চেপে সেই জলই তো গ্রামের মাথায়দাঁড়িয়েনৃত্য করেছিল! ঘরবাড়ি, স্কুল,বাজার, খেতখামার, পুকুর,নদী, নদীবাঁধ বারবার তছনছ করেছে যে জল আর হাওয়া, তা-ই এখন একেবারে শান্ত,নিরীহ। প্রায় নিয়ম করে বদলায় সাগরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা নদী।তার সঙ্গে ভাসতে ভাসতে নিজের শৈশব, কৈশোর,যৌবন পেরিয়ে চলেছেন এঁরা। এই এক জীবনে যে তাঁদের কতবার জন্ম হয়,আয়লার ধাক্কায় টলমল এক বিকেলে তারই বিবরণ দিচ্ছিলেন সেই প্রান্তিক কৃষক। কতবার,তার হিসেব গুলিয়ে যায় ভাসতে থাকা এই সব জীবনের। বাঁধের উপর বসে সঙ্গীদের সাক্ষী রেখেবলেছিলেন— ‘‘ছেলেবেলা থেকে শুরু এই যুদ্ধ। ফের সব নতুন করে করতে হবে!’’ পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই ভদ্রলোক।
ওঁর সঙ্গে প্রতিবেশী, বাপ-ঠাকুর্দার অভিজ্ঞতার কোনও ফারাক নেই। চরাচর জুড়ে তার প্রমাণ ছড়িয়ে। সে দিকেই হাত ছুড়ে প্রতিবেশী মৎস্যজীবী বলেছিলেন— ‘‘কী ফারাক?আমাদের এই লুটে যাওয়া প্রাণ তো কোনও ভাবেই আলাদা নয় গো!’’ এই ‘আমাদের’ বন্ধনীটা কিন্তু বিরাট। ঠিক কতটা জায়গায় এ ভাবেই তাঁদের জীবন ও জীবিকার নিয়ন্তা প্রকৃতি? শুধু এই সাগরদ্বীপেই অন্তত তিন লক্ষ মানুষের জীবন ঘুর্ণিতেই ঘুরছে।ঘুরেঘুরে আসা এই দুর্বিপাকের শিকার সাগরের প্রায় সব পরিবার। চুরাশি শতাংশ সাক্ষরের সাগরের মানুষের কাছে এই অনিবার্যতার ব্যাখ্যা জলের মতো স্পষ্ট। তাঁরা জানেন, দুর্যোগ আর দুর্ভোগের সঙ্গে তাঁদের নাড়ির যোগ। ছিঁড়লেও ছেঁড়ে না। ঘর ভাঙে, গড়ে ওঠে, আবার ভাঙে। এই বৃত্তের পিছনে যে বিজ্ঞান, তা-ও জানা তাঁদের।
এই যে পুনর্গঠনের কাজ হবে, তা দুর্বল, অপর্যাপ্ত। ফলে, প্রকৃতির তাণ্ডবের সামনে তা আরও অর্থহীন হয়ে পড়ছে।এক শীতের অবেলায় রাস্তা থেকে দেখেছিলাম, দোকানের বাইরের দিকে বসে হাতে-মাথায় তেল ঘষে চলেছেন মাসিমা।সাগরদ্বীপের মাটিতে পা রাখলে মাসিমার মুখ চোখে পড়বেই। এই তো গত জানুয়ারি মাসেও মেলার প্রস্তুতির সময় দেখে এলাম সাজানো দোকান, সংসার আর তৃপ্ত স্নেহময়ী চেহারা। আয়লার ধাক্কা সামলে বাঁশের গায়ে টিন মোড়া দোকানে থিতু হওয়ার ধুলো জমেছিল। বাইরের দেওয়ালের গায়ে একটা যাত্রাদলের পোস্টার লাগানো ছিল।
স্থানীয় দলের ম্যানেজারের রোদচশমা চোখে ছবি। আর তাঁর কোট পরা ছবির বুকের উপর দিয়ে আড়াআড়ি করে ছাপা মোবাইল ফোনের নম্বর। গঙ্গাসাগরের মেলার জন্য মালপত্রে ভরা মাসিমার সেই দোকান। বাইরে জল আর ঠান্ডা পানীয়ের বোতল জড়ো করা। রঙিন চিপসের প্যাকেট উপচে পড়ছে ভিতর থেকে। আর ভিতরে চায়ের আয়োজন। কেটলি, সসপ্যান, কাচের গ্লাস, মাটির ভাঁড়, ছাকনি। নিশ্চয়ই গুঁড়ো দুধ, চা পাতা, বিস্কুটও। সকালের দিকে এই দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে এক কাপ চা নিলে শীতের রোদ পিঠে এসে পড়ে। গরমের বিকেলে জোলো হাওয়া এসে নাকমুখ ছুঁয়ে যায়।কিন্তু এখন? যে আমপান অমন হাতির মতো কচুবেড়িয়া জেটিঘাট ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে, তার সামনে তো সাগরের বেশির ভাগ ঠিকানাই খড়কুটো।
এই তো মেলার আগে এক সকালে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম সাজানো সাগরের ভিড়ে। এ গলি, ও গলি চক্কর কাটতে কাটতে গিয়ে পড়েছিলাম একেবারে পিচরাস্তায়। সেখান থেকেই নাকে এসেছিল খেজুর রস জ্বালানো গন্ধ। সেই গন্ধের পিছু নিয়ে এগোতে এগোতে পৌঁছেছিলাম তিন প্রজন্মের রসসাগরে। মাটির বাড়ির উঠোন-পিছন ছড়ানো খড়বিচুলি। তারই একধারে হা হা করে জ্বলছে কাঠের উনুন। কাদাতোলা বিরাট টিনের ট্রেতে রস ফুটছে টগবগ করে। আর তার বুকপেট থেকে দলা পাকিয়ে উঠছে সাদা ধোঁওয়া। গন্ধ এসে চারপাশে মেখে যাচ্ছে। রস জ্বালিয়ে গুড় বানাচ্ছে। পারিবারিক গুড়ের ব্যবসা। লাভ-লোকসানের হিসেব কম। বেশি আসলে পারিবারিক কাজের ধারাবাহিকতা। গাছের রস, বাড়ির উনুন, কাঠের আঁচের সঙ্গে আত্মীয়তার বোধ। মাটিতে থেবড়ে বসে অচেনা অতিথিকে থেমে থেমে সেই সব সুখ-শখ শুনিয়েছিলেন ভদ্রলোক। সকাল ৮টায় আগুন জ্বলেছে। রস ফোটানো চলবে বিকেল পর্যন্ত। সেই উঠোনে ঝড় আছড়ে পড়লে কী হতে পারে, তা দেখে জানার দরকার কী?
ওই টিনের লম্বা ট্রেটা কী আছে সেই উঠোনে আর? রস-গুড়ের মতো প্রজন্মের পর প্রজন্ম জ্বাল দেওয়া মিষ্টি স্বপ্নগুলো উড়ে গেল সেই ঝড়ের সঙ্গেই? এই লড়াইয়ে এ বার আরও লক্ষ মুখ যোগ হয়ে গেল। চোখে ভাসছে আবদুল্লাদের তিন ভাইয়ের মুখ। শীতে গরম জামা লাগে না, গরমে ঘরে ফেরার তাড়া থাকে না।
সকাল, দুপুর, বিকেল বা রাতে আলাদা করে খাবার লাগে না। কোনওমতে একবেলা কিছু পেটে পড়লেও মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখে। উল্টো দিকের মুখে সামান্য হাসি-ভাব দেখলে গায়ের কাছে চলে আসে। একটু আহ্লাদ পেলে ছোট ছোট আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে অতিথি, অপরিচিতের গায়ে।
সেই তিন শৈশব এগোচ্ছে কৈশোরের দিকে, যৌবনের দিকে। পা রাখছে সেই ‘আমাদের’ বন্ধনীতে।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত। ছবি: চৈতালি বিশ্বাস)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy