গত বছরের ১৬ নভেম্বর একটি ‘রিয়্যালিটি শো’-তে, শিক্ষিত ঝকঝকে কয়েক জন তরুণ-তরুণীর একটি ‘তদন্তকারী’ দল নিজেরাই জানালেন, কোথাও ভূতের, মানে অলৌকিক কিছু ঘটনার সন্ধান পেলে, তাঁরা তদন্ত করেন। প্রচেষ্টাটা বিজ্ঞানমূলক, নিদেন সচেতনতামূলক, আন্দাজ করে দেখতে বসে, প্রথম থেকেই যাবতীয় হিসেব গুলিয়ে যেতে লাগল। দেখলাম, এখানে তদন্ত মানে কী/কেন ঘটছে তার ব্যাখ্যা নয়, আসলে কিছু বৈদ্যুতিন (ইলেক্ট্রনিক) যন্ত্রপাতি দিয়ে স্রেফ দেখাবার চেষ্টা যে, ভূত আছে। দ্বিতীয়ত যে-সব যন্ত্রপাতি ওঁরা ব্যবহার করছেন, সেগুলো আসলে কী কাজে লাগে, যে শব্দগুলো ব্যবহার করছেন তাদের প্রকৃত অর্থ কী, সে-সব না জেনে (বা না-জানিয়েই) লোকের সামনে উপস্থাপন করছেন! তৃতীয়ত, অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভূতের যে পদার্থবিজ্ঞান-সম্মত ব্যাখ্যা দেওয়া হল, তেমন অ-পদার্থবিজ্ঞান আর হয় না।
লক্ষ লক্ষ মানুষ বাড়ির ছোটদের নিয়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই রিয়্যালিটি শো দেখেন, কারণ এটা মূলত একটি প্রশ্নোত্তরের অনুষ্ঠান, যেখানে আশ্চর্য সব মানুষের সঙ্গেও পরিচয় হয়। স্বাভাবিক ভাবেই এমন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কোনও ভুল তথ্য এবং কুসংস্কারমূলক ধারণাও খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। তাই যে কোনও সচেতন নাগরিকের দায়িত্বই হল সংশয় ও অসঙ্গতিগুলোকে সামনে আনা। এঁদের কাজের পদ্ধতির ত্রুটি, ছবি, ভিডিয়ো ইত্যাদির অসঙ্গতির কথা ঊহ্য রেখে, আপাতত শুধু যুক্তি ও বিজ্ঞানের কথাগুলোই বলি। প্রথমত, এঁরা ভূত আছে ধরে নিয়ে তার অস্তিত্বকে ‘বিজ্ঞানসম্মত’ ভাবে প্রমাণ করতে চাইছেন। কিন্তু কেন? যে ঘটনা ‘ভূতুড়ে’ বলেই পরিচিত, তাকে নতুন করে ভূতুড়ে প্রমাণ করার দরকার কী? প্রমাণ হোক বা না হোক, ভূত থাকলে তার নিজের নিয়মে আছে, সাধারণ মানুষ তো তাকে দিয়ে মর্জিমাফিক কিছু করিয়ে উঠতে পারবেন না, তা হলে তার পেছনে ছুটে ঠিক কী লাভ! দ্বিতীয়ত, তথাকথিত ‘ভূত ডিটেক্টর’ হিসেবে যে-যন্ত্রটি দেখানো হল, তা আসলে একট ‘ইএমএফ মিটার’, যাতে তড়িচ্চুম্বকীয় (ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক) তরঙ্গের অস্তিত্ব (কম্পাঙ্ক) এবং প্রাবল্যও ধরা পড়ে। এমন যন্ত্রে ভূত ‘ধরতে পারা’ মানে হল, ভূত আসলে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ। কিন্তু এটা কী করে জানা গেল? এখানে বলে রাখি, আমরা যে-সব বৈদুতিন যন্ত্রপাতি (টিভি, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার) ব্যবহার করি, তারা সকলেই নানা কম্পাঙ্কের তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে। তাই এই রকম যে কোনও যন্ত্রের কাছাকাছিই এই ‘মিটার’ বেশ উঁচু ‘রিডিং’ দেখাবে, তার জন্য ভূতের কিছু দরকার নেই। লেজ়ার ও ইনফ্রারেড রশ্মি নির্ভর যে দুটি ‘প্রক্সিমিটি ডিটেক্টর’ দেখানো হল, সেগুলো থেকে বিকীর্ণ রশ্মি কাছাকাছি কোনও কঠিন বস্তুতে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এলে, সেই বস্তুর অবস্থান বোঝা যায়। অর্থাৎ এদের কাজকে কিছুটা বাদুড়ের চলাফেরা (শব্দরশ্মির প্রতিফলন) বা রেডারের (তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের প্রতিফলন) সঙ্গে তুলনা করা যায়। এই যন্ত্রের সাহায্যে ‘ভূত’কে পেতে হলে তাকে ‘কঠিন’ হতে হয়। তা হলে কী দাঁড়াল ! ভূত একটি কঠিন তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ (অর্থাৎ সোনার পাথরবাটি), যা অজ্ঞাত পদ্ধতিতে মাধ্যমকে উষ্ণ করে তোলে। এর চেয়ে তো দাদা ‘অচ্ছে দিন’ বা ‘কালাধন’ বিশ্বাস করাও সহজ !
তৃতীয়ত, তদন্তকারী ভূতাকাঙ্ক্ষীরা ফলাফলের বিশ্লেষণ করেন শক্তির নিত্যতা সূত্র আউড়ে। যুক্তিটা হল, যে হেতু শক্তির সৃষ্টি বা বিনাশ হয় না কিন্তু রূপান্তর হয়, তাই মানুষ হঠাৎ মারা গেলে তার শরীরের যে বিপুল শক্তি তা তো বিনষ্ট হতে পারে না, সেই শক্তিই ‘ভূত’ রূপে চরাচরে বিরাজমান। এ বার এঁদের যুক্তি ধরেই বলি, যখন শিশু জন্মায়, আস্তে আস্তে বড় হয়, তখন কি ‘শক্তি’ সৃষ্টি হয় ? যদি তা না হয়, তা হলে মৃত্যুতেই বা ‘শক্তির বিনাশ’ হতে হবে কেন! তবে আসল কথা হল, মানুষের চলাফেরা কাজকর্ম শরীরের তাপমাত্রা, যাকে আমরা ‘শক্তি’ বলে মনে করি, সেটা আসলে একটা জটিল ফাংশন বা ক্রিয়া; খাবার থেকে পাওয়া কিছু রাসায়নিক শক্তি যান্ত্রিক শক্তি ও তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে এই সব ক্রিয়ার শক্তি যোগায়। সেই শক্তি শরীরের কেন্দ্রে কোনও ‘এনার্জি ব্যাঙ্ক’-এ জমা থাকে না, প্রতি মুহূর্তে সমস্ত কোষে উৎপন্ন হয়ে চলে। প্রাণহীন শরীরে সেই রাসায়নিক প্রক্রিয়া থেমে গিয়ে শক্তির সরবরাহ বন্ধ হয়, তাই ক্রিয়াও বন্ধ হয়ে যায়। একসঙ্গে অনেকটা শক্তি বেরিয়ে আসার প্রশ্নই নেই। তাই শক্তির নিত্যতা সূত্র দিয়ে ভূতের ব্যাখ্যা চলে না।
কিন্তু আসল বিপদটা ভূতে নয়। অপবিজ্ঞানে। এই যে কিছু বিজ্ঞানঘেঁষা শব্দ, কিছু যন্ত্রপাতি দেখিয়ে একটা ভিত্তিহীন বিষয়কে ‘বিজ্ঞানসম্মত, তাই বিশ্বাসযোগ্য’ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা, সাধারণ মানুষের মনে এর প্রতিক্রিয়াটা হয় অনেক বেশি। হাত দেখা, গ্রহরত্ন, মাদুলি-তাবিজ, ভূতপ্রেত, সব বিষয়েই সম্পূর্ণ অর্থহীন বাজে কথাগুলো বিজ্ঞানের ছোঁয়া লেগে যেন শুদ্ধ হয়ে ওঠে, যখন দেখা যায় অনেক বিজ্ঞান-শিক্ষিত মানুষও সে কথা বিশ্বাস করছেন। সে কম্পিউটারে ভাগ্যগণণাই হোক, আংটির পাথরের বিশেষ রশ্মি শোষণ করার তত্ত্ব হোক, চাঁদের প্রভাবে জোয়ার-ভাটা দিয়ে মানুষের রোগব্যাধির বিচার হোক। তাই ভূত যখনই তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তি হয়ে ওঠে, তখন তাকে আর অত সহজে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আপাতত আমরা গরুর দুধ, ময়ূরের অশ্রু, গণেশের প্লাস্টিক সার্জারি ইত্যাদি নানা তত্ত্ব নিয়ে প্রবল ঘেঁটে আছি, তার ওপর ভূতের তড়িচ্চুম্বকীয় ব্যাখ্যা করলে হয়তো একে একে ডাইনির ডিএনএ-র গঠন, ব্রাহ্মণ/দলিতের রক্তের উপাদান, পৈতের জীবাণুনাশক ধর্ম, এ সবের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব উদ্ভূত হতে থাকবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy