Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
KMC Poll

TMC: ‘আমি সেই না-লেখা ওয়েব সিরিজটির মধ্যে বসবাস করছি’

এবারেও আসন্ন পুরসভা নির্বাচনে আমার পরিবারের দু’জন মানুষ লড়ছেন। তবে এবার একটু অন্যভাবে। একজন শাসকদলের হয়ে। আরেকজন নির্দল প্রার্থী হয়ে।

গ্রাফিক : শৌভিক দেবনাথ

সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:০২
Share: Save:

‘একলা হতে শিখিয়েছ তাই, একলা হাঁটে আমার শপথ/ আমিই আমার পক্ষ এবং আমিই আমার বিরুদ্ধ মত।’

২০১৬ সালে ‘শুধু বিঘে দুই’ প্রকাশনা থেকে আমার একটি শীর্ণকায়ী কবিতার বই ‘হয় প্রেম নয় রাজনীতি’-র ‘বিভাব’ কবিতা ছিল এটি। তখন অন্য কোনও প্রেক্ষাপটে হয়তো সত্যি ছিল এই পঙ্‌ক্তি। কিন্তু কোনও দিন যে তা এমন ভাবে ফিরে আসবে জীবনে, তার জন্য হয়তো প্রস্তুত ছিলাম না।

গত কয়েক দিন বড় অস্থিরতায় কাটিয়েছি। খানিক দোলাচলেও। যেন একটা কোনও পক্ষ বেছে নিতেই হবে আমায়। দলীয় রাজনীতি থেকে সরে থাকার সচেতন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যখন আমার দৈনন্দিনে ঢুকে পড়ে দলীয় রাজনীতি তখন বুঝতে পারি, হয়তো এটাই আমার নিয়তি। শেক্সপিরীয় নাটক কিংবা গ্রিক ট্র্যাজেডির ‘নিয়তি’!

গত পুরসভা নির্বাচনের ফল বেরিয়েছিল যে দিন, সে দিনও আমি বড় একলা হয়ে গিয়েছিলাম। এক দিকে বহুজাতিক সংস্থা ছেড়ে রাজনীতিতে আসা আমার জীবনসঙ্গীটির প্রথম নির্বাচনের জয়। অন্য দিকে সেই নির্বাচনেই আমার বাবার হার। এমনকি, কেবল হারই নয়, বিরোধী পক্ষের যে প্রার্থী সেই নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন, তাঁকেই পরে বাবার তৎকালীন দল গ্রহণ করে নেয়। সে দিন সম্ভবত আমি অফিসে ছিলাম। এক বিদেশি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম তখন।

এ বারেও আসন্ন পুরসভা নির্বাচনে আমার পরিবারের দু’জন মানুষ লড়ছেন। তবে অন্য বারের চেয়ে একটু অন্য ভাবে। এক জন শাসকদলের হয়ে। আর এক জন নির্দল প্রার্থী হয়ে। ভিন্ন এলাকায়। প্রথম জন সম্পর্কে আমার স্বামী। নাম অরূপ চক্রবর্তী। দ্বিতীয় জন আমার বাবা। সচ্চিদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়।

খানিকটা পলিটিক্যাল ড্রামার মতো লাগছে শুনতে। তাই না? ভাবুন তা হলে, আমি সেই না-লেখা ওয়েব সিরিজটির মধ্যে বসবাস করছি। আর করছি বলেই লিখে ফেলার একটা তাগিদ তৈরি হচ্ছে আমার। না হলে তো এ বিষয় নিয়ে আমার বলার বা লেখার কথা নয়। কারণ, আমার দৈনন্দিন কাজ তো এই দলীয় রাজনীতির থেকে অনেক দূরে। আমার কাজ তো আসলে ওই ওয়েব সিরিজ, চলচ্চিত্র এ সবের চিত্রনাট্যে, ভাষার রাজনীতি ও রাজনীতির ভাষার গবেষণায়, কবিতা কিংবা উপন্যাসে। তবে এ-ও কি কোনও গল্প উপন্যাসের চেয়ে কম?

এই টানটান কনটেন্টের মধ্যে রোজ থাকতে থাকতে বুঝছি, চরিত্রদের যখন যেখানে সেখানে বসিয়ে দিই, কী অবস্থাটাই না হয় তাদের! মশকরা করছি বটে, তবে মন খুব মশকরার আবহে নেই। আর তাই বোধহয় নিজেকে আর এই ঘটনাপ্রবাহকে খানিক দূর থেকে দেখতে চাইছি।

আমার বাবা দলের বিরুদ্ধে না হলেও আঞ্চলিক দলীয় কিছু নেতার বিরোধিতা করে নির্দল প্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছেন। প্রতিবাদ হিসেবে। ওঁর রাজনৈতিক জীবনের দিকে ফিরে তাকালে বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না, যে তিনি চাইলেই অন্য যে কোনও দলে চলে যেতে পারতেন। কিন্তু তা ওঁর নীতিবিরুদ্ধ ছিল। আর তাই দলবদলের যুগে দলবদল না করে নির্দল প্রার্থী হয়ে নিজের প্রতিবাদকে রেখেছেন উনি। যা গণতান্ত্রিক দেশের নীতির বিরোধিতা করা নয়।

কিন্তু ‘নীতি’ এক আপেক্ষিক শব্দ। সংসারের নীতি, রাজপ্রাসাদের নীতি, প্রেমের নীতি, পরকিয়ার নীতি, বন্ধুত্বের নীতি— এই সব নীতি আসলে একে অন্যের চেয়ে আলাদা। আর সব চাইতে বেশি আলাদা হল— রাজার নীতি। যদিও বাবার দলীয় সদস্যপদ নেই, তবুও কোনও এক ভাবে দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওঁকে বহিষ্কারের। কারণ, বহু অনুরোধেও উনি মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি।

আর এক দিকে আমার স্বামী দলের হয়ে লড়ছেন এই নির্বাচনে। তিনি দল করেন। যে কোনও দলের সিদ্ধান্তই সেই দলের প্রতিটি ব্যক্তির সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। অন্তত ‘ডিসিপ্লিন’ সেই কথা বলে। আর রাজনীতিতে ডিসিপ্লিনই শেষ কথা। ‘অ্যানার্কি’ লাগে বিপ্লবে। কিন্তু সেই অ্যানার্কিকেও সাংগঠনিক ডিসিপ্লিনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় প্রকৃত অর্থে রাজনীতি হয়ে উঠতে গেলে। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ‘ম্যান বাই নেচার ইজ আ পলিটিক্যাল অ্যানিম্যাল।’ এ কথা তো সত্যিই যে, মানুষ মাত্রেই রাজনৈতিক। দলে, নির্দলে, সংসারে, দফতরে রাজনীতিই তো শেষ কথা বলে।

এই সব কিছুর মধ্যে হয়তো বার বার যে প্রশ্ন উঠে আসছে, তা কেউ কেউ আমাকে সোজাসুজি করছেন। আবার কেউ হয়তো করছেন না। কিন্তু সারাটা দিন পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে ফিরে আসা স্বরের মতো আমার কানের কাছে বেজে চলেছে, “কোন দল? তুমি কোন দল?’’

আনন্দবাজার অনলাইনে আমার এই লেখা কেবল সেটুকুর জবাব দেওয়ার কারণে। যে জবাবদিহির হয়তো কোথাও কোনও প্রয়োজন নেই। তবু তো মানুষ আয়নার দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে কথা বলে। এ-ও হয়তো খানিক তেমনই। এক বার ভেবেছিলাম, এই পুরো বিষয়টা থেকে সরে থাকাই তো ভাল।

কিন্তু যা সত্য তা থেকে কোনও দিনই যখন সরিনি, আজই বা কেন? আর আজ আমি না সরে কলম তুলে নিলে হয়তো আগামী দিনে আরও কেউ এইটুকু সাহস অন্তত দেখাবে যে, মাঝে মাঝে একটা কোনও রাস্তা বেছে নিতেই হবে, তার কোনও মানে নেই। নিজের কাজের রাস্তায় নিবিষ্ট থেকে বাকি রাস্তায় যে যে ভাবে হাঁটছে তাকে হাঁটতে দিয়ে সম্পর্ককে খানিক গণ্ডিমুক্ত রাখাই বরং ভাল।

এই পরিস্থিতি সম্পর্কে, ভিন্ন জনের ভিন্ন অবস্থান সম্পর্কে, দল সম্পর্কে কিছু ব্যক্তিগত মতামত নিশ্চয়ই আমার ভিতরে তৈরি হয়েছে। কিন্তু যে হেতু আমি সক্রিয় দলীয় বা নির্দলীয় কোনও রাজনীতিই করি না, তাই সেই ভাবনাকে, সেই মতকে আমি আমার মধ্যেই রাখতে চাই।

তবে প্রকাশ্যে যেটা বলতে চাই, তা হল, এই নানান দোলাচল আর নানান অস্থিরতা থেকে নিজেকে খানিক মুক্তি দিয়ে আমি বুঝেছি— ব্যক্তির রাজনৈতিক অবস্থান আর পারিবারিক অবস্থান তো আলাদা। আমি সচেতন ভাবে কেবল এটুকু চাই যে, আমার অন্দরমহলে দলীয় রাজনীতির কোনও ছায়া যেন পারিবারিক বিভাজন তৈরি না করে। কারণ, দলমত নির্বিশেষে দু’জন ব্যক্তির সঙ্গে আমার যা সম্পর্ক, সেটাই আমার কাছে সত্যি। আর এই পুরো সময়টা জুড়ে বা তার পরেও সেটাই সত্যি থাকবে।

পরিবারের ভিতর সম্পর্কের যে উষ্ণ রোদ খেলা করে, সেখানে যেন কোনও মেঘ ঘনিয়ে না আসে। প্রত্যেকের নিজস্ব লড়াই, নিজস্ব দল, নিজস্ব আদর্শ থাকুক। কিন্তু আমি জানি, প্রকৃত আদর্শের কোনও দল রাজনৈতিক বিভাজন সত্ত্বেও পারিবারিক বিভাজনকে কাম্য মনে করে না। ইতিহাসে এমন নজির অসংখ্য।

এই রাজা-রানির খেলায় আমি নেই বলেই হয়তো আর নিজেকে প্রজা বলে জানি বলেই প্রজার নীতি দিয়ে রাজার নীতিকে বিচার করার মূর্খামি করতে চাই না। বরং চাই, রাজার নীতি দাবার ছকের মতো এগিয়ে চলুক কিন্তু প্রত্যেকের ব্যক্তিগত নীতি যেন ব্যক্তিগত জগতে সোজা হয়ে থাকে। রাজনীতির ময়দানে খেলা জমে উঠুক, কিন্তু যে ভাবে খেলতে যাওয়ার পোশাক ছেড়ে ঘরে ফিরে হাত পা ধুয়ে খেতে বসতে হত ছোটবেলায়, আমি চাই কেবল আমার অন্দরমহল নয়, প্রতিটি দলীয় রাজনৈতিক পরিবারের অন্দরমহলে যেন প্রত্যেকে রাজনীতির পোশাক খুলে তবে ঘরে ঢোকেন। আর প্রতিটি দল যেন সেই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে। সম্মান করে।

ছোটবেলা থেকে যে সব রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের কাকু, জেঠু, কাকি, পিসি ডেকে বড় হয়েছি, আজও যাঁদের সঙ্গে দেখা হয় ভিন্ন সময়, আগামিকাল দেখা হলে কারও স্ত্রী হিসেবে যেমন তাঁদের অভ্যর্থনা করে নেব, কারও মেয়ে হিসেবেও মুখ ফিরিয়ে চলে যাব না। কারণ, আমার শিক্ষা ব্যক্তিকে ব্যক্তির বিরুদ্ধে দাঁড় করায় না, মতকে মতের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পারে বড় জোর। আমি তাকেই প্রকৃত রাজনীতি বলে জানি। আর এই কারও কন্যা আর কারও স্ত্রীর পরিচয় পেরিয়ে ব্যক্তিকে, রাজনীতিকে, পরিস্থিতিকে যখন এক জন লেখক বা গবেষকের চোখ দিয়ে দেখি, তখন আমার মনে পড়ে যায় ফুকোর কথা। ফুকো বলেছিলেন, ‘‘পাওয়ার ইজ কনস্টিটিউটেড থ্রু অ্যাকসেপ্টেড ফর্মস অব নলেজ, সায়েন্টিফিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং অ্যান্ড ট্রুথ।’’

এক আশ্চর্য রাজনৈতিক সংকটে দাঁড়িয়ে এক স্বাধীন ব্যক্তি হিসেবে আমি কেবল এইটুকু চাইতে পারি, বর্তমান ও আগামী দিনের রাজনীতি এই ক্ষমতারই আরাধনা করুক, যে ক্ষমতায় মিশে আছে জ্ঞান, বিজ্ঞানসম্মত বোধ এবং সত্য। আর সত্যে প্রাধান্য পাক মানুষ এবং মানুষের মানুষের পরিষেবা। যার জন্য এত দল আর এত ভোটের আয়োজন।

এ সব কথা ভাবতে ভাবতে আজ আকাশের দিকে তাকাচ্ছি যখন, দেখছি বৃষ্টির পরেও সব মেঘ কাটেনি এখনও। তবে ভাগ্যিস আকাশের কোনও দল হয় না। তাই মেঘেরা যে দিকে ইচ্ছে ভেসে বেড়াতে পারে!

(লেখক কবি, চিত্রনাট্যকার এবং গবেষক। মতামত একান্ত নিজস্ব)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy