নেতৃত্ব: এনসিপি সভাপতি শরদ পওয়ারের সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১ ডিসেম্বর, মুম্বই। ছবি পিটিআই।
বিরোধী-জোট এখন আলোচনার সবচেয়ে বড় বিষয়। যেমন বাংলায়, তেমনই গোটা দেশে রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে এই প্রশ্নে। সম্ভাব্য জোটের চেহারা কী হবে, বাঁধন কতটা শক্ত করা যাবে, জোট-জট তৈরি হলে তাতে লাভ কার ইত্যাদি অনেক কিছু নিয়েই শেষ কথা বলার দিন এখনও আসেনি। সময় ঢের বাকি।
কিন্তু বিরোধী জোটের অবয়ব তৈরির কাজে বাংলার তৃণমূল কংগ্রেস যে ভাবে অগ্রণী হয়েছে, তা নজর এড়িয়ে যাওয়ার নয়। আগে বলা কথাটি আজ তাই আরও এক বার বলতে হচ্ছে। সেটা হল, বিরোধী পরিসরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে তোলা অবশ্যই এই উদ্যোগের অন্যতম লক্ষ্য। পূরণ হওয়া পরের কথা।
জোট নিয়ে মমতার ভূমিকা সম্পর্কে কিছু দিন ধরে দু’টি ব্যাখ্যা ঘুরছে। একটি হল, তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চান। দ্বিতীয়টি, তাঁর ‘পরিকল্পিত’ কার্যকলাপে জোট-রাজনীতি ধাক্কা খাবে এবং নরেন্দ্র মোদীর সুবিধা হবে। ব্যাখ্যা দু’টি অবশ্য পরস্পরবিরোধী। কারণ কেউ নিজে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলে কি মোদীর সুবিধা করে দিতে যাবেন?
আর যদি ধরে নিতে হয়, মমতা একার জোরে জোট ‘ঘেঁটে’ দিতে পারবেন, তা হলে তো এটাও মেনে নেওয়া উচিত যে, জাতীয় স্তরে বিরোধী জোটের চাবিকাঠিটি আসলে তাঁরই আঁচলে বাঁধা! নয়তো বাংলায় মাত্র ৪২টি লোকসভা আসন যাঁর মূল রণভূমি, তাঁকে নিয়ে এত আলোচনা হবে কেন?
এ কথা শিশুও বোঝে যে, সকলকে নিয়ে শক্তপোক্ত জোট ছাড়া বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করা এখন সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে জোট-ই হল ন্যূনতম বিকল্প। জরুরি অবস্থার সময় কালিমালিপ্ত ইন্দিরা গাঁধীকে হারানোর জন্যও জোট বাঁধতে হয়েছিল বিরোধীদের। দেশের মানুষ তৈরি ছিল ইন্দিরার বিরুদ্ধে রায় দিতে। তবু তাকে সংগঠিত করার জন্য জোট ছিল অবশ্যম্ভাবী। সেই উদ্যোগে সর্বসম্মত ভাবে নেতৃত্ব দিতে পেরেছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ। তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি। কিন্তু তাঁর ডাকে নিজেদের রাজনীতি সরিয়ে রেখে সবাই তাৎক্ষণিক ভাবে এক হয়েছিলেন উদ্দেশ্যসাধনে।
আবার রাজীব গাঁধীকে হটিয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ যখন ‘মিস্টার ক্লিন’ সেজে নেমে পড়েছিলেন, তখন তাঁকে মধ্যমণি করে পরস্পরের হাত ধরতে অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং জ্যোতি বসুর কোনও সমস্যা হয়নি। অর্থাৎ, সোজা কথায়, বড় লক্ষ্য পূরণের স্বার্থে জোট যদি অনিবার্য বিকল্প হয়, তখন তার পরিধি ছোট করলে চলে না। সরিয়ে রাখতে হয় পারস্পরিক অসূয়া।
জোট-রাজনীতির সবচেয়ে সফল দৃষ্টান্ত, নিঃসন্দেহে, পশ্চিমবঙ্গ। সিপিএমের নেতৃত্বে বামেদের জোট চৌত্রিশ বছর একাধিপত্য চালিয়েছে। শরিকদের মধ্যে নিজস্ব অশান্তি ছিল না, তা নয়। সিপিএমের সঙ্গে ফরওয়ার্ড ব্লক-আরএসপি-দের ক্ষমতার লড়াইতে খুনোখুনিও বাদ যায়নি। মনে হত, এই বুঝি সব ভেঙে গেল!
কিন্তু জোট টিকিয়ে রাখার গুরুত্ব ফ্রন্ট নেতারা বুঝতেন। কারণ বাংলায় তার একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ছিল। দেশে যেমন ইন্দিরা গাঁধী, রাজ্যে তেমনই সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বামফ্রন্ট তৈরি হয়। তাই একা সিপিএম যখন নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেয়েছে, তখনও জোট ভাঙার কোনও ভাবনা জ্যোতিবাবুরা প্রশ্রয় দেননি।
কেন? তখনকার একাধিক প্রবীণ নেতার কথা ছিল, জোট বিষয়টি এক ধরনের সংগঠিত শক্তির ধারণা দেয়। মানুষ মনে করে, একের বিরুদ্ধে বহু সর্বদা গরিষ্ঠ। সেখানে এক বার যদি জোট ভেঙে যায়, তা হলে তার বিপরীত ধাক্কা সামাল দেওয়া সহজ হয় না। তাঁদের একটি বয়ানই ছিল, বামফ্রন্টের ঐক্যকে চোখের মণির মতো রক্ষা করতে হবে। আজ ভোটের ময়দানে পর্যুদস্ত হয়েও তাই কাগজে-কলমে বামফ্রন্টের অস্তিত্ব বহাল!
তবে মমতার রাজনৈতিক উত্থানে জোটের ভূমিকা অন্য রকম। বস্তুত ২০১৯-এর আগে কখনও তিনি নিজে বিরোধী জোট গড়তে অগ্রণী হননি। বৃহত্তর প্রেক্ষাপট নিয়ে এত বেশি মাথাও ঘামাননি।
কখনও শাসক কংগ্রেস, কখনও শাসক বিজেপির জোটে তিনি শরিক হয়েছেন ঠিকই। সেগুলি আসলে ছিল চলার পথে তাঁর নিজস্ব কুশলী পদক্ষেপ। কারণ রাজ্যই তখন মমতার কাছে মাছের চোখ। তাই জোট রাজনীতির ছকে ওইগুলিকে ফেলা বোধ হয় ঠিক হবে না।
২০১৬-য় প্রথম রাজ্যে বাম-কংগ্রেস জোট এবং বিজেপির বিরুদ্ধে একা লড়ে অনায়াস জয়ের পরেই মমতার জোট-ভাবনা জাতীয় স্তরে প্রসারিত হতে থাকে। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে যখন তিনি ‘ইউনাইটেড ইন্ডিয়া’-র ডাক দিয়ে ব্রিগেডে বিরোধীদের সমাবেশ করেন, তখন উনিশটি দলের শীর্ষনেতারা তাতে যোগ দিয়েছিলেন। এর থেকে দু’টি বিষয় তখন সাব্যস্ত হয়। এক, বিজেপির বিরুদ্ধে জোট গড়ার পরিসর আছে এবং দুই, মমতার ডাকে অন্যদের সাড়া মেলে।
এ বার স্বাভাবিক ভাবেই মমতার ‘আত্মবিশ্বাস’ একটু একটু করে বাড়তে থাকে। যেটা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে গত বিধানসভা নির্বাচনে ‘অমিত-শক্তিধর’ বিজেপি এবং দুর্বল কংগ্রেস-বাম জোটের বিরুদ্ধে একা লড়ে ফের তাঁর বিপুল জয়। আজকের বিরোধী জোট নিয়ে তাঁর আগুয়ান হওয়া এক দিক থেকে তারই ক্রমপরিণতি।
যদিও এটা ঘটনা যে, উনিশের জোট-উদ্যোগ নিদারুণ ভাবে ব্যর্থ হওয়া মমতা-সহ সকল বিরোধীর কাছে ধাক্কা। জোট যে গড়ে উঠছে না, তার আভাসও মিলেছিল ভোটের আগেই। যার দায় সম্মিলিত বিরোধী পক্ষের উপর বর্তায়। কম-বেশির তুলনা সেখানে অবান্তর।
কিন্তু একটি বিষয় লক্ষণীয়। ওই জোট-উদ্যোগেও মমতা এবং কংগ্রেসের মধ্যে সম্পর্কের শীতলতা ছিল। রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে মমতার তীব্র বিবাদের জেরে প্রদেশ কংগ্রেসের নেতারা ব্রিগেডে যাননি। দিল্লি থেকে তৎকালীন বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খড়্গের হাতে বার্তা পাঠান সনিয়া গাঁধী। বার্তা আসে রাহুলের কাছ থেকেও। সেগুলি পড়া হয়। সবটাই ছিল কেমন যেন আনুষ্ঠানিক।
খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, মমতার সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্কের জটিলতা নতুন কিছু নয়। বাংলায় কংগ্রেস বিরোধিতার জমি থেকেই তৃণমূলের সৃষ্টি ও উত্থান। ‘বদলা’-ও বলা চলে। রাজীব-পরবর্তী সময় থেকে এর শুরু। প্রদেশ স্তরে বিবাদ, মমতাকে কোণঠাসা করে দেওয়া, একের পর এক বিষয়ে মতানৈক্য, ধাপে ধাপে কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল তৈরি, ভোটে সেই তৃণমূলের পর পর সাফল্য ইত্যাদিতে দুই দলের মধ্যে দূরত্ব বেড়েই গিয়েছে।
আবার রাজ্যে কংগ্রেসের ক্রম-অবক্ষয়ও ঘটেছে মমতার কারণেই। এবং ঘটনা হল, দিনের শেষে মানুষ এখানে মমতাকে গ্রহণ করেছে, কংগ্রেসকে করেনি। সেই শ্লাঘায় তিনি বলতে পারছেন, কংগ্রেস তাঁর ‘বস’ নয়।
এই অবস্থায় তৃণমূল নেত্রী এবং উপরতলার কংগ্রেস নেতৃত্ব কেউই যে খুব স্বচ্ছন্দে পরস্পরের হাত ধরতে পারবেন, এটা ভাবা ঠিক নয়। কংগ্রেস স্বভাবতই তার জাতীয় রাজনীতির অবস্থানকে গুরুত্ব দেবে, মমতাকে পাত্তা দিতে চাইবে না। মমতাও পাল্টা নিজের প্রাধান্য জারি রাখতে চাইবেন। পারলে দল ভাঙাবেন, অন্য রাজ্যে কংগ্রেসের ক্ষুব্ধ অংশকে নিজের দলে টেনে তৃণমূলের বৃদ্ধি ঘটাবেন। উভয় তরফ থেকেই এটা কতকটা ‘দেখ কেমন লাগে’ মানসিকতা। ঘটছেও সেটাই।
এর সঙ্গেই আজকের বৃহত্তর জোট রাজনীতির রসায়ন জড়িত। সার্বিক জোট না হলে বিজেপি যে তার সুযোগ পেয়ে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই। সে জন্য কেউ মমতাকে দুষবেন, কেউ কংগ্রেসকে। তাতে আখেরে লাভ কার?
এখন কিন্তু কোনও জয়প্রকাশ নেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy