Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

এক্সক্লুসিভ অভিজিৎ: কলকাতা প্রাণবন্ত মেধাচর্চার একটা বড় জায়গা ছিল, এখন আর তা বলা যাবে না

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সঙ্গে কথা বললেন অভীক সরকারঅভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সঙ্গে কথা বললেন অভীক সরকার

নোবেল: (উপরে) রবীন্দ্রনাথ, মাদার টেরিজ়া, অমর্ত্য সেন। (নীচে) অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।

নোবেল: (উপরে) রবীন্দ্রনাথ, মাদার টেরিজ়া, অমর্ত্য সেন। (নীচে) অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৯ ০০:২০
Share: Save:

প্রশ্ন: মুশকিলে ফেলেছেন। আপনার বাবা আমার মাস্টারমশাই ছিলেন। অনেক দিন আগে অঙ্ক নিয়ে আপনাকে গুগলি দিয়েছিলাম। সেটা আজ সম্ভব নয়। এই স্বীকৃতির পরে তো নয়ই।

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়: তা হলে ধন্যবাদ জানাব। ইতিমধ্যে অন্তত একটা ইন্টারভিউতে বেশ তর্ক করতে হয়েছে। আরও একটা সে রকম না হলেই আমার পক্ষে ভাল।

প্র: লড়ে যদি জেতাই না যায়, তা হলে অনর্থক খুঁচিয়ে লাভ কী?

উ: এটুকু বলতে পারি যে, সে বোধটা পৃথিবীতে এখনও যথেষ্ট সুলভ নয়।

প্র: প্রফেসর ব্যানার্জি...

উ: আমাকে প্রফেসর ব্যানার্জি বলবেন না। ওই সম্বোধনটা আমার নয়, আমার বাবার জন্য।

প্র: ওঁকে আমি দীপকবাবু বলতাম। কলেজে অন্যরা অবশ্য ডিবি বলে ডাকত।... যেটা বলতে চাইছি, ন’জন ভারতীয় নোবেল পেয়েছেন। তাঁদের চার জন বাংলা থেকে, তিন জন চেন্নাইয়ের। আর আছেন হরগোবিন্দ খুরানা। ও হ্যাঁ, ওই শান্তি পুরস্কার পাওয়া এক জনও আছেন। তো, এর মানেটা হল, নোবেলের শতকরা ৮০ ভাগ এনেছে কলকাতা আর চেন্নাই। আপনার আমেরিকার প্রতিবেশী, হার্ভার্ডের ডেভিড রাইখ এর কী ব্যাখ্যা দেবেন? (ডেভিড রাইখ জিনতত্ত্ববিদ, ডিএনএ দিয়ে ইতিহাসের ব্যাখ্যা করেছেন।)

উ: অতটা কিছু নয়, বিশেষ গুরুত্ব দেব না। আমার মনে হয়, এখানে দুটো ব্যাপার আছে। ইতিহাসের একটা পর্বে কলকাতা ছিল ইন্টেলেকচুয়াল চর্চার একটা কেন্দ্র। চেন্নাইয়ের যে তিন জনের কথা আপনি বললেন, তাঁরাও কলকাতায় থেকেছেন। অন্তত তাঁদের দু’জন।

প্র: বেঙ্কি কিন্তু নয়। (স্যর বেঙ্কটরমণ রামকৃষ্ণন, রয়াল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট, রসায়নে নোবেলজয়ী।)

উ: (মাথা নাড়লেন) এ ধরনের যোগাযোগ খুঁজে বার করা সহজ। কিন্তু আমার মনে হয়, অমর্ত্য আর রবীন্দ্রনাথ কেন কলকাতার মানুষ, তার অন্তত একটা কারণ হল, কতকগুলো ঐতিহাসিক ঘটনার যোগাযোগে কলকাতা এক সময় ভারতের বিদ্যাচর্চার একটা বড় জায়গা ছিল। আজ আর সেটা বলা যাবে না। কিন্তু এটা আপনি বলতেই পারেন যে, কলকাতার সঙ্গে ভারতের পাঁচ জন নোবেলজয়ী মানুষের যোগ আছে। আমার বক্তব্য হল, এর সঙ্গে বাঙালিয়ানার বিশেষ সম্পর্ক নেই। বরং এটাই আসলে বড় শহরের মাহাত্ম্য। সেখানে শ্রেষ্ঠ মেধার মানুষেরা আসেন এবং তাঁরা পরস্পরের কাজে অনুপ্রাণিত হন ও অসামান্য সব কাজ করেন। তাঁরা সবাই একে অন্যের চেয়ে আরও ভাল কাজ করতে চান এবং সেটাই হল মহানগরের মহত্ত্বের চাবিকাঠি। এই কারণেই এক সময় সমস্ত শিল্পী প্যারিসে যেতে চাইতেন, সব লেখকের লক্ষ্য ছিল নিউ ইয়র্ক। ভাল লেখক হিসেবে স্বীকৃত হতে চাইলে আপনাকে নিউ ইয়র্কে যেতেই হবে, এটাই ছিল নিয়ম। একটা সময় অবধি কলকাতার এই ব্যাপারটা ছিল। আমি তার শেষের দিকটা দেখেছি আমার বাবার মধ্যে দিয়ে। তাঁর ক্ষেত্রেও এই মহানাগরিক অনুপ্রেরণা কাজ করত। ঠিক যেমন অমর্ত্য সেনের ক্ষেত্রেও। সত্যিই সে এক প্রাণবন্ত মেধাচর্চার জায়গা ছিল বটে। এর পিছনে বাঙালির কোনও বিশেষত্ব আছে বলে আমি মনে করি না, এটা মহানগরের বিশেষত্ব।


অতঃপর

প্র: তার মানে এখন কলকাতার আর কোনও নোবেল পাওয়ার সম্ভাবনা কম?

উ: ভারতের অন্য অনেক শহরেরই এক হাল। দিল্লিতে হয়তো সমস্যাটা তুলনায় কম। আমার মনে হয়, শহর হিসেবে দিল্লি এখন কলকাতার থেকে বেশি সজীব। আসলে ইন্টেলেকচুয়াল সজীবতা ব্যাপারটা নিজেকেই পুষ্টি দেয়, এগিয়ে নিয়ে চলে। আমি এই ব্যাখ্যাটাই দিয়ে থাকি। আমি মনে করি, একটা জায়গায় আরও অনেক বুদ্ধিমান লোক আছে, এটা খুব বড় ব্যাপার। বাবা গল্প বলতেন, সেই যুগের প্রেসিডেন্সি কলেজের গল্প, যখন তিনি সেখানে প্রথম এসেছিলেন। একটা ছোট শহরে তাঁর ছেলেবেলা কাটে। স্কুলের পাট চুকিয়ে বছরখানেকের জন্যে হুগলিতে ছিলেন। তার পর প্রেসিডেন্সিতে আসেন। সেখানে তখন তেরো-চোদ্দো বছরের ছাত্রছাত্রীরা ইন্টারমিডিয়েট পড়তে আসতেন। আমার ধারণা, বাবা যখন ভর্তি হন তখন তিনি সাড়ে তেরো। তো সেখানে দেখেন, তেরো বছর বয়সি বৌধায়ন চট্টোপাধ্যায় মার্ক্স বা ওই রকম কিছু নিয়ে আলোচনা করছেন, কিংবা কবিতা নিয়ে কথা বলছেন। এগুলোই প্রেরণা দেয়। মনে হয়— বাপ রে! ও কত জানে!

প্র: চলে গেল কেন?

উ: অর্থনীতির কারণে। অন্তত কিছুটা। যে সময়ের কথা বলছিলাম তখন কলকাতা ভারতের সবচেয়ে সম্পন্ন শহরও ছিল। এই যোগাযোগটা আকস্মিক বলে মনে হয় না। আমি মনে করি, কিছুটা উদ্বৃত্ত থাকলে তবেই একটা সামাজিক শ্রেণি তৈরি হতে পারে, যাদের তরুণরা ভাল শিক্ষার সুযোগ পায়, যাদের স্বাধীন চিন্তা ও জীবনযাপনের সামর্থ্য থাকে। যারা জানে যে তারা যা পড়তে চায় পড়তে পারবে, আইআইটির প্রবেশিকা পরীক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। এর বিকল্প হল একটা ভীষণ বাঁধা ছকের শিক্ষাব্যবস্থা, যা সাফল্যের কতকগুলো ধরাবাঁধা মাপকাঠি ঠিক করে দেয়। যথেষ্ট সচ্ছল এবং আত্মবিশ্বাসী একটা মধ্যবিত্ত পরিবারেই মা-বাবা ছেলেমেয়েদের বলতে পারেন, যা তুমি নিজে করতে চাও সেটাই করো, কোনও চিন্তা নেই, আমরা আছি।

প্র: একটা চ্যালেঞ্জ করব? আপনার বাবা বা অমর্ত্য সেন যখন ছাত্র ছিলেন সে সময় শিক্ষার দারুণ পরিবেশ ছিল। পরবর্তী কালে কলকাতার শিক্ষাজগতে একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটে গিয়েছে, প্রায় চিনের মাপেই। কিন্তু রাজ্য সরকারি বলয়ের বাইরে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি ছিল, তারা বেঁচে গিয়েছে এবং অনেকেই এখনও সজীব রয়েছে। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের উৎকর্ষ আজ হয়তো তার স্বর্ণযুগের মতো নেই, কিন্তু এখনও তো তা খুবই ভাল।

উ: ১৯৫০-এর দশকের মতো নয়। সে আমলে সংখ্যাতত্ত্বে এবং একটি বিশেষ ধরনের গণিতে দুনিয়ার চারটে সেরা প্রতিষ্ঠানের নাম করতে হলে আইএসআই তাদের একটা হত। স্বয়ং কোলমোগোরভ সেখানে আসতেন, সেখানকার শিক্ষক গবেষক ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ কাটিয়ে যেতেন। (আন্দ্রেই কোলমোগোরভ, রাশিয়ার এই গণিতবিদ, সংখ্যাতত্ত্বে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন) আইএসআই ছিল যেন ওই তাত্ত্বিক দুনিয়ার কেন্দ্র। পৃথিবীকে শাসন করতে পারে এ রকম প্রতিষ্ঠান আমাদের ওই একটাই ছিল। আমার মনে হয় না আজ আর সে কথা বলতে পারি। অবস্থাটা কেমন, সেটা কিছুটা জানি বলেই বলছি।

আরও পড়ুন: ‘প্রেসিডেন্সিতে সবাই উচ্চবর্ণের, জেএনইউ’তে আমার জাতপাতের চেতনা, আর হার্ভার্ড শেখাল কঠোর পরিশ্রম’

প্র: যারা মেধাবী তারা এখন শুধু আমেরিকায় যায়, এমআইটি বা ক্যালটেক-এ। আর একটা ব্যাপার হল, পঞ্চাশের দশকে ভারতের যোজনা কমিশনের টানেও অনেকে আইএসআইতে আসতেন। জে বি হলডেন-এর মতো মানুষেরা। (জীববিজ্ঞানী ও মার্ক্সবাদী, হলডেন অক্সফোর্ড এবং ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ছেড়ে কলকাতা আইএসআইয়ে এসেছিলেন।) পঞ্চবার্ষিক যোজনা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই যোগসূত্রটা ছিঁড়ে গেল। আইএসআই আগের মতো ভাল আছে কি না, সেটা অন্য প্রশ্ন, কিন্তু এখনও তার মান অত্যন্ত ভাল।

উ: আমিও তা মনে করি। এবং আপনি যে বললেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করতে রাজ্য সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, সেটা একেবারে ঠিক কথা। এবং সরকার নির্বোধের মতো একগাদা কাজ করেছিল, সেটাও অবশ্যই বলতে হবে। বামপন্থী সরকার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কী করেছিল, আমি তা একেবারে চোখের সামনে দেখেছি। মাস্টারমশাইদের যেখানে খুশি বদলি করে দেওয়া, কলেজের জন্য টাকাপয়সা না দেওয়া, আজেবাজে লোককে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করে বসিয়ে দেওয়া... আমার বাবা তো তা নিয়ে সম্পূর্ণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। আপনার কথা সম্পূর্ণ সমর্থন করি। কিন্তু এর পাশাপাশি আমি আর একটা কথা বলব। আগেকার যুগে বেসরকারি কলেজের মানও তো অনেক ভাল ছিল। সাহিত্যজগতের কত দিকপাল লোক ছিলেন যাঁরা প্রেসিডেন্সিতে পড়েননি। ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশের দশকে ক’জন আর প্রেসিডেন্সিতে গিয়েছিলেন, তাঁরা তো বঙ্গবাসী বা স্কটিশ চার্চ বা সিটি কলেজ বা এ রকম আরও কত কলেজ ছিল, সেখানে পড়েছেন। কত বড় বড় প্রতিভাধর মানুষ সেই সব কলেজ থেকে বেরিয়েছেন! সরকারি কলেজের কথা বলছি না, তার বাইরেও অনেক ভাল কলেজ ছিল। একটা খুব উচ্চ মানের সংস্কৃতির প্রভাব ছিল তাদের ওপর। গড় মানটাই খুব উঁচু ছিল।

প্র: গড়টাই এক সময় উঁচু ছিল। কিন্তু বেসরকারি কলেজগুলোর শিক্ষকদের মাইনেও তো সরকার দিতে শুরু করল, তার ফলে সেগুলোও কার্যত সরকারি কলেজই হয়ে গেল।

উ: হতে পারে। সরকার হয়তো সব ভুলভাল লোককে চাকরি দিয়েছিল। এটাও ঠিক যে, এক সময় মুড়িমিছরির এক দর হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ১৯৮০’র দশকেও একটা সময় পর্যন্ত কলেজের চাকরিতে অন্য অনেক পেশার তুলনায় ভালই আয় হত। আমার মনে হয় না, কলকাতার শিক্ষার অধঃপতনের কারণ সম্পর্কে সব বিতর্কের মীমাংসা করে ফেলা যাবে, কিন্তু কলকাতা যে আর সত্যিকারের একটা মহানগর নয়, তার একটা ভূমিকা আছে বলেই বিশ্বাস করি। আসলে একটা কিছু তখন ছিল, কোথাও একটা ধারণা ছিল... ওই একটা গোটা প্রজন্মের কথা ভাবুন, কত আশ্চর্য প্রতিভাবান সব মানুষ। যে কোনও ক্ষেত্রে। যেমন ধরুন নাটক— উৎপল দত্ত, বাদল সরকার… আমার মনে হয় তাঁদের সকলের মধ্যেই এই ব্যাপারটা ছিল যে, আমরা যা করতে চাই সেটা করতে পারি। জীবিকা নিয়ে ভাবতে হবে না। এই নয় যে তাঁদের জীবন খুব সচ্ছল ছিল, কিন্তু বিরাট কোনও সচ্ছলতার প্রত্যাশাও তাঁরা করতেন না। আমি যে সময় বড় হয়েছি তখনও এই পাগলামোটা দেখিনি, এই যে একটা অস্বাভাবিক তাড়না যে, আইআইটি’তে পড়তেই হবে, বা অমুক কোম্পানিতে চাকরি পেতেই হবে, এ রকমটা দেখিনি। আমার মতে এটা বুদ্ধি এবং চিন্তার উৎকর্ষ নষ্ট করে দেয়। আসলে আমাদের মন আর মগজের একটু হাত পা ছড়ানোর জায়গা লাগে। আর ওই চিন্তাটা খুব মূল্যবান যে আর পাঁচ জন যা করছে আমি তার থেকে আলাদা কিছু করব। কিন্তু এখন সবাই ভাবছে, যদি আইআইটি না হয়, যদি প্রথম সারিতে থাকতে না পারি তা হলে এই মাঝারিয়ানার ফাঁদে আটকে যাব।

প্র: কিন্তু দিল্লি এরই মধ্যে ভাল করছে?

উ: আমার মনে হয় দিল্লির অবস্থা তুলনায় ভাল, তার একটা কারণ হল, দিল্লিতে একটা উদ্যোগী শ্রেণি আছে। অনেককেই সেখানে চিনি, তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল— এখন ঘটনা হল, সচরাচর তাদের একটা বেশ জোরদার পারিবারিক ভিত আছে, তারা কেউ দরিদ্র পরিবার থেকে আসেনি, এসেছে সচ্ছল মধ্যবিত্ত ঘর থেকে। দিল্লিতে এ রকম বহু পরিবারের বসতি। তাদের অনেকের কিছু সম্পত্তি ছিল, সেটা বিক্রি করে দিয়েছে। এই সব পরিবারের একটা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আছে।

প্র: আর একটা ব্যাপার আছে, যেটার কথা আপনাদের নতুন বইতেও আছে। (অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এস্থার দুফলো-র নতুন বই: ‘গুড ইকনমিক্স ফর হার্ড টাইমস’, জাগারনট প্রকাশিত।) দিল্লি হল অভিবাসীদের শহর। যেমন আপনি যখন জেএনইউ’তে পড়তে গেলেন, তখন তো আপনিও সেখানে অভিবাসী। আপনার জীবনে কার প্রভাব বেশি, দিল্লির না কলকাতার? দুটো প্রতিষ্ঠান তো একেবারে দু’রকমের?

উ: একেবারে আলাদা। আমার সৌভাগ্য হল, যে বাড়িতে আমি মানুষ হয়েছিলাম সেখানে খুবই ভাল লেখাপড়ার পরিবেশ ছিল। আমার লেখাপড়ার ভিত সবল ছিল, অঙ্ক ভাল শিখেছিলাম। অনেকগুলো সুবিধে হাতে নিয়েই আমি শুরু করেছিলাম। দিল্লিতে আমার সুযোগ হল, এক অর্থে, ভারতের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ছিল পুরোপুরি উচ্চবর্ণের মধ্যবিত্ত বাঙালির কলেজ, আর তার ফলে পরিবেশটা ভীষণই একমাত্রিক, কারণ পশ্চিমবঙ্গের উচ্চবর্ণগুলির ভিতরে বিশেষ কোনও বৈচিত্র নেই। তার অর্থ হল, সমাজের বাকি অংশ এই পরিবেশ থেকে বাদ। নানা ক্ষেত্রেই এটা সত্যি। যদি কমিউনিস্ট পার্টির দিকে তাকান, এক হরেকৃষ্ণ কোঙারকে বাদ দিলে উচ্চবর্ণের বাইরে বড় নেতা খুঁজে পাবেন না।

প্র: ফ্রান্‌জ ফ্যানন-এর সেই বিখ্যাত বামপন্থী বই, ‘দ্য রেচেড অব দি আর্থ’! মনে আছে? সেই বইয়ের সঙ্গে কিন্তু এখনকার কমিউনিস্ট পার্টির কোনও মিল নেই।

উ: অন্তত সেখানে নেতাদের কেউ নিম্নবর্ণ নয়, এমনকি সম্পন্ন নিম্নবর্ণও নয়। হরেকৃষ্ণ কোঙারদের পরিবার তো যত দূর জানি বেশ সম্পন্ন ছিল। আর তাঁর মতো নেতাও আপনি কমিউনিস্ট পার্টিতে বিশেষ পাবেন না।

প্র: সবাই ব্রাহ্মণ। এমনকি মমতাও। তাঁর আগে বুদ্ধবাবু ছিলেন, একেবারে ভটচাজ্জি ব্রাহ্মণ। জ্যোতি বসু, তিনিও কায়স্থ, প্রফুল্ল সেনও...

উ: সব উচ্চবর্ণ। আজ অবধি পশ্চিমবঙ্গের যত জন মুখ্যমন্ত্রী, সবাই উচ্চবর্ণের। এই বৈচিত্রহীনতা সত্যিই চমকপ্রদ। তো, যা বলছিলাম, কুড়ি বছর বয়েস পর্যন্ত কাস্ট সম্পর্কে ধারণা ছিল একেবারে শূন্য। কলকাতায় আমার কাস্ট নিয়ে সত্যিকারের কোনও অভিজ্ঞতাই ছিল না। আমার চার পাশের পরিচিত জগতে কাস্ট নিয়ে ভাবারই কোনও কারণ ছিল না। সেখানে সবাই কার্যত ছিল একই কাস্টের লোক। এবং সত্যি বলতে কি, সেই পরিবেশে, ধরা যাক প্রেসিডেন্সিতে যারা পড়ত তাদের মধ্যে কেউ যদি নিজের কাস্টের বাইরে বিয়ে করতে চাইত, সেটাও খুব বড় সমস্যা হত না, সবাই তো উচ্চবর্ণের, আর উচ্চবর্ণের ভিতরে দুটো কাস্টের দূরত্ব এমন কিছু বিরাট ব্যাপার ছিল না, ব্রাহ্মণ-কায়স্থের বিয়ে তত দিনে মোটামুটি সহজে মেনে নেওয়া হচ্ছিল। এখনও কলকাতায় ছবিটা মোটামুটি একই।...

(তিন পর্বে এই সাক্ষাত্কার প্রকাশিত হচ্ছে, আজ প্রথম পর্ব)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE