বিশ্বের যে কোনও সভ্য দেশের অন্যতম লক্ষ্য সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সকলের জন্য সমান সুযোগ। সমান অধিকার। এবং সমান আচরণ। সামাজিক ন্যায়বিচারের মূল সূত্রই এই তিনটি। আর ঠিক এই কারণেই সামাজিক ন্যায়বিচারের গুরুত্ব প্রত্যেক দেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছে অপরিসীম। রাষ্ট্রপুঞ্জ তাই ২০ ফেব্রুয়ারিকে ‘বিশ্ব সামাজিক ন্যায়বিচার দিবস’ হিসাবে গ্রহণ করেছে। ভারতীয় সংবিধানেও সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয়টি সুনিশ্চিত করা হয়েছে। নাগরিকেরা যাতে সেই অধিকার ভোগ করতে পারেন, তার দায়িত্ব বিচার বিভাগের।
রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসাবে সামাজিক ন্যায়বিচারের ধারণার জন্ম হয়েছিল শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে। শ্রেণি ও পেশাগত বিভাজন মুছে দিয়ে তখন এমন এক সমাজ তৈরির কথা ভাবা হচ্ছিল, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের সব কিছুতেই সমান সুযোগ ও অধিকার থাকবে। জন রলস তাঁর ‘আ থিয়োরি অব জাস্টিস’ বইয়ে এর ব্যাখ্যাও করেছেন। মোদ্দা কথা হল, সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছে আর্থ-সামাজিক সকল সুযোগসুবিধা পৌঁছে যেতে পারে একমাত্র এই সামাজিক ন্যায়বিচারের মাধ্যমেই।
বিচারের ‘সততা’ এবং তার ‘সামাজিকতা’র দিকটি সমাজের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে সম্পর্কিত। সেই কারণেই বিশ্বের যে কোনও সভ্য দেশের অন্যতম লক্ষ্য এই সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা। ধরা যাক, কোনও এক জন নাগরিক নানাবিধ ভাবে প্রতিকূল অবস্থায় রয়েছেন। তিনি নিজেকে অবহেলিত এবং বঞ্চিত মনে করছেন। সামাজিক ন্যায়বিচার তাঁকে সেই সমানাধিকার ও ন্যায্য সুযোগ করে দেবে, যাতে তিনি সমাজের কোনও স্তরেই আর নিজেকে বঞ্চিত মনে করবেন না। প্রগতিশীল সেই সমাজে কোনও বঞ্চনা থাকবে না। এবং প্রত্যেক নাগরিক ভাল ভাবে উন্নত মানের জীবনযাপন করার সুযোগ পেতে পারবেন। সেই লক্ষ্যেই সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস থাকে সকল দেশের। আমাদের দেশেও।
ভারতের একটা ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার রয়েছে। নানাবিধ বৈষম্য ও বঞ্চনার সঙ্গে সে বিশেষ ভাবে পরিচিত। তা সত্ত্বেও কোথাও একটা সামাজিক ‘অখণ্ডতা’ও তৈরি হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। ব্রিটিশ রাজের সময়ে। শতকের পর শতক ধরে ঔপনিবেশিক শাসনের বঞ্চনার কারণে জাতির মনোবল কমেছে। কিন্তু স্বাধীনতার পরেই গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে কিন্তু ভারত সামাজিক ন্যায়বিচারকে সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’য় নিয়ে এসেছে। এবং দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচারকে সুনিশ্চিত করেছে তার সংবিধানের মাধ্যমে।
আমাদের সংবিধানের যখন খসড়া তৈরি হচ্ছে, তখন সেই খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান বি আর অম্বেডকর কিন্তু সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য কোনও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের কথা কোথাও উল্লেখ করেননি। তা সত্ত্বেও ভারতীয় সংবিধানে এমন কিছু ছিল, যা দেখে ইতিহাসবিদ গ্রেনভিল অস্টিন বলেছিলেন, ‘‘সমাজকে পরিবর্তন এবং পুনর্গঠনের জন্য এতখানি আবেগ ভারতীয় সংবিধান ছাড়া বিশ্বের আর কোনও দেশের নেই।’’ অম্বেডকর এ ভাবেই সামাজিক ন্যায়বিচারকে বুনেছিলেন ভাবনায়।
ভারতীয় সংবিধানে সামাজিক ন্যায়বিচারের ধারণার কথা বলা হয়েছে তার ‘প্রস্তাবনা’তেই। সেখানে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সুবিচারের কথা বলা হয়েছে। সুযোগের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে সমতার কথা। ব্যক্তির মর্যাদা এবং জাতির অখণ্ডতা বাড়াতে সৌভ্রাতৃত্বের কথাও বলা হয়েছে। একই সঙ্গে অম্বেডকর বলেছিলেন, ‘‘সাংবিধানিক নৈতিকতাকে প্রতিনিয়ত অনুশীলন করে যেতে হবে। আমাদের অনুধাবন করতে হবে যে, দেশবাসীর এখনও এটা শেখা উচিত।’’ এ যেন ঠিক জমিতে চারাগাছ লাগানোর মতো। সেগুলিকে লালনপালন করলে তবেই ফসল ফলবে। নচেৎ নয়। পরিচর্যার অভাব থাকলে ফসল ঘরে আসবে না।
সত্যি কথা বলতে, সামাজিক ন্যায়বিচারের সুতোতেই ভারতীয় সংবিধানের মালা গাঁথা হয়েছে। সংবিধানে সামাজিক ন্যায়বিচার সুরক্ষিত হয়েছে মৌলিক অধিকার দিয়ে। সঙ্গে নির্দেশমূলক নীতি এবং মৌলিক কর্তব্য। সংবিধানেরই ১৪ থেকে ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে রয়েছে আইনের চোখে সমতার অধিকার। স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে ১৯ থেকে ২২ নম্বর অনুচ্ছেদে। শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার রয়েছে সংবিধানের ২৩ এবং ২৪ নম্বর অনুচ্ছেদে। ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে ২৫ থেকে ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে। সংবিধানের ২৯ এবং ৩০ নম্বর অনুচ্ছেদে রয়েছে সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকারের কথা।
এই মৌলিক অধিকারের মধ্যেই কিন্তু বলা হয়েছে কর্মসংস্থানের কথা। সংবিধানের ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রত্যেক ভারতীয়ের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। দেশের যে কোনও সরকারি চাকরিতে নিয়োগের প্রতিযোগিতায় রয়েছে সমান সুযোগ। সেটাই নিশ্চিত করে সংবিধানের ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদ। সেখানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রকে অবশ্যই সরকারি চাকরির প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য সরকার সংবিধান অনুযায়ী সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য সংরক্ষণ নীতি মেনে চলতেও বাধ্য।
ভারত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। গণতন্ত্রের নির্যাস সমাজের সব স্তরে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব সরকারি কর্মচারীদের। তা প্রত্যন্ত গ্রাম পঞ্চায়েত হোক বা পুরসভা— সর্বত্র। নইলে আমাদের অগ্রজদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না। যাঁরা আইন প্রণয়ন করেন, তাঁদের মনে রাখতে হবে উন্নত থেকে বঞ্চিত, সকল শ্রেণির প্রতিই সংবিধান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এবং সকল নাগরিক সামাজিক ন্যায়বিচার দাবি করবেন। কারণ, সেটা তাঁর অধিকার।
সংবিধানের কারণেই সমাজের বাস্তুতন্ত্র টিকে আছে। নাগরিকের সুষ্ঠু এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাত্রা নিশ্চিত করতে আইনপ্রণেতা, শাসনবিভাগ, বিচারবিভাগ, সমাজকর্মী এবং সাংবাদিকদেরও নিজেদের দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে হবে। পৌঁছতে হবে একেবারে তৃণমূল স্তরে। প্রত্যেক নাগরিক যাতে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারেন তা-ও নিশ্চিত করতে হবে। ওটাই তো অগ্রজেরা আমাদের উপহার দিয়ে গিয়েছেন সংবিধানের মাধ্যমে।
স্বাধীনতার আগে আমরা দারিদ্র, অশিক্ষা, বেকারত্বে জর্জরিত ছিলাম। এখন তো অনেক কিছুর অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু বঞ্চিতরা পাচ্ছেন তো? যদি আইনি অধিকারের কথাই ধরি, বিনামূল্যে সাহায্যের বিধান রয়েছে সংবিধানেই। তার পরেও বঞ্চিতদের আদালতে বিচার দিতে পারছি তো? বলতে পারছি তো, আইন আপনাকে সাহায্য করবে? নাগরিকেরা জানেন তো তাঁদের অধিকার পাইয়ে দিতে আমরা চোখে কালো কাপড় বেঁধে বসে নেই? যদি নাগরিকেরা বোঝেন, তবেই বুঝব সামাজিক ন্যায়বিচারের ভাবনা সার্থক হয়েছে। না হলে ধরে নিতে হবে, এখনও অনেক পথ হাঁটা বাকি।
(লেখক কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি। মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy