মহাত্মা গান্ধী মৃত্যুর পরেও আমাদের মধ্যে বেঁচে রয়েছেন, ভাল কথা। কিন্তু তাঁর নামাঙ্কিত একশো দিনের কাজের প্রকল্পে যে শয়ে শয়ে অশরীরী কাজ করে যায়, সেটা কি ভাল? কেন্দ্র পেয়েছে ওঝার পার্ট। আগে নিয়ম ছিল, কাজ শুরু করার সময় শ্রমিকদের ছবি তুলে অ্যাপ-এ আপলোড করতে হবে। গত ডিসেম্বর থেকে কেন্দ্র নিয়ম করেছে, কাজ শুরু আর শেষ, দু’বারই ছবি তুলতে হবে।
এই শর্ত শুনে হয়তো দুঃখে-লজ্জায় আর এক বার মরে যেতেন গান্ধী। তাঁর দেহ বিদ্ধ-করা তিনটে বুলেটের মতো, তিনটি প্রশ্ন আঘাত করত তাঁকে। এক, গ্রামের মানুষের উপর যদি সরকারি আধিকারিকরা খবরদারি করেন, দু’-দিনের বিডিও যদি পাঁচ বারের নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্যকে ধমকে বলেন, “ক’দিন কাজ করিয়েছেন?” তা হলে তাকে কি ‘স্বরাজ’ বলা চলে? দুই, দুর্নীতি কি প্রকল্পের গায়ে গজানো আঁচিল, না কি অভ্যন্তরের ক্যানসার হয়ে উঠেছে? আর তিন, দুর্নীতিপূর্ণ প্রকল্পে আরও টাকা ঢালা কেন? এ বার বাজেটে তিয়াত্তর হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। সবাই বলছে, আগের চাইতে কম কেন? গান্ধী হয়তো বলতেন, দূষিত কুয়ো আগে সাফ না করেই আরও জল ঢালা কেন?
অনেকেই ঠোঁট উল্টোবেন— কাজে গেল আর না গেল, কী এসে গেল? মেয়েমদ্দ ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেই তো ব্যাঙ্কে টাকা ঢোকে। এই তাচ্ছিল্যের স্বর পার করলে মেলে এক ধরনের উপযোগিতাবাদ। গরিবের হাতে টাকা তো পৌঁছচ্ছে, গ্রামীণ মজুরিও আগের চাইতে বাড়িয়েছে এই প্রকল্প। চুরিটুকু মেনে নিতে হবে।
এ কথা যাঁরা বলছেন তাঁরা দূর থেকে ব্যবস্থাটাকে দেখছেন। নিজেকে মজুরের জায়গায় চিন্তা করলে বিনা কাজে মজুরির পক্ষে সওয়াল করতে পারতেন না। বন্ধ স্কুলের শিক্ষকরা কাজ না করে মাইনে পাচ্ছেন, এই অভিযোগের মুখে শিক্ষকদের কী তীব্র প্রতিক্রিয়া হল, তা তো দেখা গেল। গান্ধী ছিলেন গ্রামজীবনের ভিতরের মানুষ, আদালতে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন ‘চাষি ও তাঁতি’। রাজনৈতিক জীবনের গোটাটাই অপরিগ্রহ আর অস্তেয় (অচৌর্য) প্র্যাকটিস করেছেন, জনজীবনে ন্যায় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে নিজের জীবনে ন্যায়পালনের কোনও তফাত করতেন না, সে তাঁর আত্মকথা পড়লেই মালুম হয়। গরিবের অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকছে, এই যুক্তিতে তাঁর কাছে চিঁড়ে ভিজবে না। দুর্নীতি মানে তো তাঁর কাছে কেবল টাকা নয়ছয় নয়। অনশন করা অহিংসা কি না, চরকা কাটা উচিত কি না, এগুলো গান্ধী বা রবীন্দ্রনাথের কাছে যতটা রাজনীতির প্রশ্ন, ততটাই ব্যক্তিগত নীতিবোধের। সেই কারণেই সেগুলো আজও ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দেয়। খেয়াল হয়, আমরা ধরেই নিচ্ছি গ্রামের দরিদ্র ধান্দাবাজ, অলস, প্রতারক। ওরা ওই রকমই। আমাদের মতো নয়।
আজ যদি আমাদের ভূতে পায়, মানে গান্ধী বা রবীন্দ্রনাথের মতো করে যদি নিজেকে দিয়ে ভাবতে বসি গ্রামের দরিদ্রের কথা, তা হলে কী ভাবে দেখব মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্পকে?
দেখব, এই প্রকল্পের কেন্দ্রে গ্রামবাসীর স্বশাসনের একটা ধারণা রয়েছে। গ্রামের মানুষই ঠিক করবেন কোথায় রাস্তা, পুকুর চাই, বরাদ্দ-ব্যয়ের হিসাবও যাচাই করবেন। মজুরিও মিলবে, আবার গ্রামে রাস্তা, পুকুরের মতো সম্পদও তৈরি হবে। আইডিয়া মন্দ নয়, তবে এ যে গ্রামের ভিতর থেকে আসেনি, কেন্দ্র আইন করে গ্রামের উপর চাপিয়েছে, এতেই দুধে কেরোসিনের গন্ধ পেতেন দুই কর্তা। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, স্বরাজ হল গাছের ফলের মতো, গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেওয়া চিনে লণ্ঠন নয়। তাঁর ‘লোককল্যাণ’ বাইরের উন্নতি আর অন্তরের আনন্দের সম্মিলিত প্রকাশ। একশো দিনের কাজ হল উন্নয়নের প্রকল্প, যার শর্ত তৈরি করে দিল্লি, আর মাপ হয় টাকা খরচে। রাস্তা, পুকুর কোথায় কী তৈরি হল, কার কাজে লাগল, সে সব এলেবেলে কথা। ডিএম ধমকান বিডিওকে, বিডিও তলব করেন পঞ্চায়েত প্রধানকে— টাকা খরচ হচ্ছে কই? ওটাই প্রশ্ন।
কেউ প্রশ্ন করছে না, এত টাকা খরচ হবে কিসে? পশ্চিমাঞ্চলের রুখুশুখু জেলাগুলো ছাড়া এ রাজ্যে আর কোথায় বছর বছর নতুন পুকুর খোঁড়ার জমি রয়েছে? এনআরইজিএ-তে এখন কংক্রিটের রাস্তাও হচ্ছে। কত নতুন রাস্তা হবে? কত গাছ পুঁতবে মেয়েরা? অতএব পনেরো জন মজুরকে পঞ্চান্ন জন দেখানো হচ্ছে, বারো দিন কাজ করিয়ে বাহান্ন দিনের বিল ধরানো হচ্ছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে হয়েছে, দলীয় কর্মীরা যেন ‘কাটমানি’ ফেরত দেয়। এই দুর্নীতির পাঁকে দাঁড়িয়ে ‘তুই কালো না মুই কালো’ করে বেশ দিন কেটে যায়। কিন্তু ঘাড়ে-চাপা দুই ভূত ফিসফিস করে— গ্রামে কাজ কি আর নেই?
অনেক কাজ বাকি, কিন্তু তাকে প্রকল্পের ফ্রেমে আঁটানো কঠিন। কর্তারা ধমক দেবেন— অ্যাইও, ওটা এনআরইজিএ নয়। যেমন, ব্যক্তিগত সম্পত্তি প্রকল্পের বাইরে হলেও, ব্যক্তিগত পুকুর সংস্কার করার একটা ফর্মুলা বার করেছিলেন এ রাজ্যের আধিকারিকরা। পুকুরের মালিককে পঞ্চায়েতের সঙ্গে চুক্তি করতে হত যে মাছ চাষের মতো জল রেখে, বাকি জল গ্রামবাসীকে ব্যবহার করতে দেবেন। এ ভাবে বহু পুকুর সংস্কারের পর ২০১৮ সালে কেন্দ্র বেঁকে বসল। ব্যক্তিগত পুকুর সংস্কার করার জন্য রাজ্যের থেকে ১২০ কোটি টাকা ফেরত চাইল। তার পর থেকে সংস্কারের অভাবে পড়ে রয়েছে মজা পুকুর। একই ভাবে, পানের বরজ তৈরিকে প্রকল্পের অধীনে আনতে দেয়নি কেন্দ্র, যদিও চাহিদা ছিল চড়া।
প্রয়োজনের সঙ্গে প্রকল্পের এমন ব্যবধান ঘটছে, কারণ সংবিধানের পাতায় যা স্বশাসন, কাজের বেলা সেই গ্রাম পঞ্চায়েত হয়ে দাঁড়িয়েছে বিডিও দফতরের গ্রামীণ শাখা। গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্পের যত টাকা এসেছে, ততই পঞ্চায়েত হেঁটেছে স্বরাজ, সক্ষমতার উল্টো দিকে। এখন প্রতি বছর দশ হাজার কোটি টাকা খরচ করে পশ্চিমবঙ্গের ২২৪২টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ইতিহাসে সর্বোচ্চ। কিন্তু গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে এক-তৃতীয়াংশ পঞ্চায়েতে ভোট দিতে পারেননি গ্রামবাসী, সে-ও ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
অনেকে বলবেন, একশো দিনের কাজকে কেবল আর্থিক নিরাপত্তার প্রকল্প বলে দেখলেই তো হয়, এর মধ্যে আবার স্বশাসন, সক্ষমতা টেনে আনা কেন? গান্ধী কিন্তু আনতেন। তাঁর কাছে চরকা কাটা যেমন স্বরোজগারের পথ, তেমনই স্বরাজের। রবীন্দ্রনাথ আপত্তি করলেন, কেবল চরকা কেটে স্বরাজ আসবে, এমন অলীক ধারণায় ভরসা করাই ভারতের দারিদ্র আর অপমানের কারণ। গান্ধী উত্তর দিলেন, খিদেই সেই যুক্তি, যা মানুষকে টেনে আনছে চরকার দিকে। “চরকার ডাক হল সব চাইতে পবিত্র, কারণ তা ভালবাসার ডাক। এবং ভালবাসাই স্বরাজ— লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে স্বরাজের কোনও অর্থ নেই যদি না তারা জানে, চাপিয়ে-দেওয়া কর্মহীনতার আলস্যকে কী করে কাজে নিয়োগ করা যায়... চরকার স্বীকৃতির আবেদন হল শ্রমের মর্যাদার স্বীকৃতির আবেদন।”
জেসিবি মেশিন যে কাজটা আধবেলায় করে, সরকারি প্রকল্প যে সেটার জন্যই গ্রামবাসীর হাতে গাঁইতি-কোদাল ধরিয়ে দেয়, তার নৈতিক সমর্থন মেলে গান্ধীর চরকার যুক্তিতেই। তাই রাস্তা বা পুকুর তৈরিকে টাকা পাওয়ার উপায় বলে দেখা মুশকিল। শ্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে মর্যাদা, ভালবাসা, স্বরাজ। এ সব কথা বলতেও দ্বিধা হয়, এ তো অবাস্তব আদর্শবাদ। কিন্তু এর বিপরীত— শ্রম ও উৎপাদন ব্যবস্থার থেকে স্বশাসনের বিযুক্তি— কী ফল প্রসব করে তা-ও কি বাস্তবে দেখছি না? গ্রামে রাজনীতির নামে যে হিংসা চলে, যেখানে শাসকের আনুগত্যই প্রাণ বাঁচানোর উপায়, তা কি ঔপনিবেশিক হিংসার চাইতে আলাদা?
কর্মহীনতা, খাদ্যহীনতা শ্রমজীবী মানুষের মস্ত সঙ্কট। কিন্তু তার শ্রম যদি এলেবেলে হয়ে যায়, তখন কাজের অধিকার, শ্রমিকের মর্যাদা, কিছুই টেকে না। গ্রামে পথ তৈরির টাকা দিলেই উন্নয়ন হয় না, গ্রামবাসীকে পথ ছেড়ে দিতে হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy