শেয়ার বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার সঙ্গে প্রকৃত অর্থনীতির সম্পর্কটা কী রকম? ভারতে শেয়ার বাজারের অগ্রগতি শুরু হয়েছে মোটামুটি ১৯৯১ সালে আর্থনীতিক সংস্কারের সময় থেকে। শেয়ার বাজারের ব্যাপ্তির গুরুত্বপূর্ণ সূচক ‘মার্কেট ক্যাপিটালাইজ়েশন’ বা সংক্ষেপে ‘মার্কেট ক্যাপ’। কোনও অর্থব্যবস্থায় যত সংস্থা শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত, তাদের সব শেয়ারের মূল্যের যোগফলকে বলে মার্কেট ক্যাপ। বর্তমানে ভারতে মার্কেট ক্যাপের মূল্য তিন লক্ষ একুশ হাজার কোটি ডলার। ২০২১-এ ভারতে মার্কেট ক্যাপ ছিল জিডিপি-র ১১০%, ১৯৯৩-এ যা ছিল মাত্র ২০%। ভারতীয় শেয়ার বাজারের এই দ্রুত উত্থান হার মানায় আমেরিকান শেয়ার বাজারকেও। এই সূচক ৭ থেকে ৭১ শতাংশ হতে সে দেশে ৮৫ বছর লেগেছিল (১৮১০-১৮৯৫)।
ভারতীয় শেয়ার বাজারের এই অভূতপূর্ব উত্থানের প্রভাব কি দেশের শিল্প-উৎপাদন তথা জিডিপি-তে পড়েছে? বিশেষত, বিগত দু’বছরের ছবি খুবই বিভ্রান্তিকর। ভারতে মার্কেট ক্যাপ-এর একটা বড় অংশ অধিকার করে আছে গুটিকয়েক বড় সংস্থা। যত বেচা-কেনা এগুলিকে ঘিরেই। বাকি অনেক সংস্থার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ তথ্যও থাকে না বিনিয়োগকারীদের কাছে। বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ (বিএসই) আর ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ (এনএসই) মিলিয়ে ৫০৬৪টি সংস্থা তালিকাভুক্ত। আর, মার্কেট ক্যাপ-এর সিংহভাগ অধিকার করে আছে মাত্র শ’খানেক বড় সংস্থা। বলা চলে যে, ভারতে শেয়ার বাজার যথেষ্ট ‘পরিণত’ নয়।
২০২০-র ১১ মার্চ কোভিড-১৯’কে অতিমারি ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। পরের দিনই শেয়ার বাজারে ধস নামে, সেনসেক্স পড়ে যায় ২৯১৯ পয়েন্ট। এর প্রধান কারণ বিদেশি পুঁজির বেরিয়ে যাওয়া। বিনিয়োগকারীরা ৩৪,০০০ কোটি টাকা তুলে নেন ভারতের শেয়ার বাজার থেকে। কিন্তু, বাজার ফের ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে কয়েক মাস পর থেকেই। তার পর ক্রমে ৬১ হাজারের ঘরে পৌঁছে, তার থেকে প্রায় দশ হাজার পয়েন্ট পিছলে পড়ে, ফের উঠে সূচক এখন ৫৯ হাজারের আশেপাশে। এই উত্থান-পতনের পিছনে যে কারণটির কথা উঠে আসছে, তাকে বলে ‘হার্ড বিহেভিয়ার’ বা গোষ্ঠীবদ্ধ প্রতিক্রিয়া— তথ্যের উপর ভরসা না করে অন্যের আচরণ অনুসরণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা। এর ফলে বাজার প্রয়োজনীয় কুশলতায় পৌঁছতে পারে না, হঠাৎ অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
অতিমারির সময়ে তালিকাভুক্ত শিল্প উৎপাদক সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে শেয়ারের ‘মিসপ্রাইসিং’ হয়েছে— অর্থাৎ, শেয়ারের মূল্য যা হওয়া উচিত ছিল, তার থেকে অনেক বেশি হয়েছে। শেয়ারের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে অতিমারির সময় ডিম্যাট অ্যাকাউন্টের সংখ্যাবৃদ্ধির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে। গল্পটা এই রকম— আমেরিকা তার অর্থনীতিতে প্রচুর নগদ জোগান দিতে থাকলে ভারতে বিদেশি বিনিয়োগ ফিরে আসতে শুরু করে, শেয়ারের দাম বাড়ে, সেই দেখে হাতে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকা ভারতীয়দের একটা অংশ শেয়ার বাজারে ঢোকেন, যার প্রমাণ ডিম্যাট অ্যাকাউন্টের সংখ্যাবৃদ্ধি, ফলে শেয়ারের দাম আরও বাড়ে। প্রশ্ন হল, শেয়ার বাজারের দ্রুত উত্থানের ফলে প্রকৃত বিনিয়োগ কি বেড়েছে? তা বাড়েনি, ফলে জিডিপির উপরও তেমন সদর্থক প্রভাব পড়েনি।
দেখা গিয়েছে যে, ভারতে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত শিল্প উৎপাদক সংস্থাগুলি তুলনামূলক ভাবে ইকুইটির উপর নির্ভর করে বেশি। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে অন্য উন্নত দেশের এখানেই একটা বড় ফারাক। উন্নত দেশের সংস্থাগুলি সাধারণত প্রথমে জমানো টাকা দিয়ে বিনিয়োগ-ব্যয় করে, তার পর বাজারে ছাড়া বন্ডের মাধ্যমে, এবং সবশেষে হাত বাড়ায় শেয়ার বাজারে। কিন্তু ভারতের মতো দেশে সংস্থাগুলি প্রথমেই ঝোঁকে শেয়ার বাজারে, কারণ এ পথে সহজেই নগদের সংস্থান হয়। বহু সংস্থার হাতে জমানো টাকাও যথেষ্ট থাকে না, কারণ বেশির ভাগ সংস্থা খাতায়-কলমে খুব কম লাভের মুখ দেখে। বন্ডের বাজারে সুদের হার বেড়ে যাওয়াটাও একটা কারণ হতে পারে।
কোনও শেয়ারের ‘প্রাইস-টু-আর্নিং রেশিয়ো’ যদি খুব বেশি হয়, তা হলে বুঝতে হবে যে, সেই শেয়ারের দাম মাত্রাতিরিক্ত। ১৯৯২ সালে এই অনুপাত ছিল ৯.৩ আর তা বেড়ে এখন হয়েছে ৩১.৪ (অক্টোবর, ২০২১)। এই অনুপাতকেই উল্টে দেখলে পাওয়া যাবে ‘কস্ট অব ক্যাপিটাল’, অর্থাৎ পুঁজির জন্য শেয়ার বাজার থেকে টাকা তোলার ব্যয়। ১৯৯২-এ সেই ব্যয় ছিল ১০.৭, আর ২০২১-এ তা হয়েছে ৩.২। অর্থাৎ, শেয়ার বাজার থেকে পুঁজি ধার করার খরচ এখন অনেক কমে গিয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আমেরিকার শেয়ার বাজারে দু’টি বড় উত্থান ঘটেছিল। প্রথম উত্থান ১৯৪০-এর শেষ থেকে ১৯৬০-এর শেষ অবধি, যখন সে দেশের প্রকৃত অর্থনীতিরও অনেক উন্নতি হয়। কিন্তু, ১৯৮০-র দশকের শুরুতে শেয়ার বাজারের যে উত্থান হয়, তখন প্রকৃত অর্থনীতির উন্নতি হয়নি। ভারতের শেয়ার বাজারের বর্তমান উত্থান কি আমেরিকার এই দ্বিতীয় সময়ের প্রতিফলন? তা হলে প্রচলিত তত্ত্ব— যা বলে যে, শেয়ার বাজারের উন্নতির ফলে প্রকৃত অর্থনীতির উন্নতি হয়— তা খারিজ হয়ে যাবে। সরকারের পক্ষে এই বিষয়টি থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা অনুচিত হবে।
কোভিড-পরবর্তী সময়ে শেয়ার বাজারের এই অস্থিরতা অনেক বিপদ ডেকে আনতে পারে। এর ফলে অর্থব্যবস্থার উপরে আস্থা হারাতে পারেন বিনিয়োগকারীরা। উপরন্তু, শেয়ারের মূল্যকে কেউ আর সম্পদের মাপকাঠি হিসেবে মানবেন না। ১৯৯৪-৯৫’এ মেক্সিকোর সঙ্কটের আগে সে দেশে শেয়ার বাজারের অস্থিরতা আমেরিকায় একই সময়কালে (১৯৮৩-৯৩) বাজারের অস্থিরতার ১৫ গুণ বেশি ছিল। বিদেশি পুঁজির লগ্নি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতি ভারতেও কি হতে পারে? শেয়ার বাজারের অতীত দুর্নীতিগুলি থেকে শিক্ষা নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি-কে আরও দৃঢ় পদক্ষেপ করতে হবে, যাতে শেয়ার বাজারের বুদ্বুদ ফেটে গিয়ে আর্থিক সমস্যার উদ্ভব না হয়।
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy