বিভিন্ন ভোটে দেখা যায়, রাজনৈতিক দলগুলি বিনামূল্যে টিভি, ফোন, ল্যাপটপ, সোনা, গরু, পাখা, সাইকেল পর্যন্ত বিলি করছে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
অর্ধসমাপ্ত অর্থনৈতিক সংস্কার দিয়ে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির অর্থনীতির বৃদ্ধির হার বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। শিল্পোৎপাদন, পণ্য রফতানি এবং কর্মসংস্থানের মতো ক্ষেত্রগুলিতে সরকারের যাবতীয় চেষ্টার পরেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। রাজনীতিবিদদের তরফে এর প্রতিষেধক হিসাবে ভর্তুকি আর নগদ প্রদানের মতো পুরনো নিদানের কথাই বলা হচ্ছে। রাজনীতির কারবারিরা তাঁদের অভিজ্ঞতা দিয়ে জানেন, ভোটের সময় এই নিদানই সব থেকে বেশি কাজে আসে।
এই কৌশলে সর্বপ্রথম সাফল্য পেয়েছিল ১৯৬৭ সালে তদানীন্তন মাদ্রাজে দ্রাবিড় মুন্নেত্র কাজাগম (ডিএমকে)। সেই বছর তারা এক টাকায় এক বিশেষ পরিমাণ চাল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। যদিও রাজধানী শহরের বাইরে এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। কারণ, এই প্রতিশ্রুতি রাজ্য জুড়ে পালন করার মতো সামর্থ্য তাদের ছিল না। ডিএমকে থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজের দল গড়ে এমজি রামচন্দ্রন স্কুলগুলিতে মিড ডে মিল চালু করেছিলেন। এই কর্মসূচির ফল ছিল বহুমুখী। এর ফলে অপুষ্টির মাত্রা কমে, স্কুলগুলিতে পড়ুয়াদের হাজিরা বাড়ে, এমনকি, জন্মহারও কমে আসে। মিড ডে মিল আজ জাতীয় কর্মসূচি। ১৯৮৩ সালে অন্ধ্রপ্রদেশে এনটি রামা রাও ডিএমকের নীতি থেকে কিছু শিক্ষা নেন। ২ টাকায় এক কিলোগ্রাম চাল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি তাঁকে নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য এনে দেয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বিজেপি তার বিরাট প্রতিশ্রুতির (যেমন, কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করা বা দেশকে ৫ ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলার মূল্যের অর্থনীতিতে নিয়ে যাওয়া) ব্যাপারে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। আর সে কারণেই তারা তাদের নিজস্ব কল্যাণকর প্রকল্পের প্যাকেজ চালু করতে চাইছে। যার মধ্যে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য, গৃহনির্মাণে ভর্তুকি, বিনামূল্যে স্বাস্থ্যবিমা ইত্যাদি রয়েছে। কিন্তু এই একই কর্মসূচি যখন অন্য রাজনৈতিক দল অনুসরণ করে, তারা ‘রেউড়ি’ (বিনামূল্যে বিলোনো মিষ্টি) বলে তাকে উপহাস করে। এমনকি, কংগ্রেস পর্যন্ত (যারা গ্রামীণ কর্মনিযুক্তির বিষয়ে গ্যারান্টি দেওয়ার কর্মসূচি চালু করেছিল) আম আদমি পার্টির অনুকরণে কিছু বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা করে। কর্নাটকের সাম্প্রতিক নির্বাচনে কংগ্রেস প্রত্যেক ডিপ্লোমাধারী বা স্নাতক বেকারকে ১৫০০ টাকা এবং ২০০০ টাকা, প্রত্যেক বাড়ির কর্ত্রীকে ২০০০ টাকা ভাতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, খাদ্যশস্য দেওয়ার আশ্বাসও। বিভিন্ন ভোটে দেখা যায়, রাজনৈতিক দলগুলি বিনামূল্যে টিভি সেট, স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ, সোনা, গরু, ইলেকট্রিক পাখা থেকে সাইকেল পর্যন্ত দিতে চাইছে।
ভোটদাতারা রাজ্যে রাজ্যে ভোটের ফলাফল দেখে এবং জাতীয় স্তরে লোকসভা নির্বাচনের ফল বিবেচনা করে তাঁদের মত দেন। রাজ্য বিধানসভার পরবর্তী নির্বাচনগুলি তাই আরও বেশি মাত্রায় কল্যাণমুখী প্রতিশ্রুতি এবং বিনামূল্যে পাইয়ে দেওয়ার খেলা দেখবে। বৃহত্তর নজরে দেখলে কিন্তু বোঝাই যায়, যখন অর্থনীতি যথেষ্ট পরিমাণে কর্মসংস্থান তৈরি করতে ব্যর্থ হয় এবং যখন শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মতো পরিষেবা তার আওতায় বেশি সংখ্যক মানুষকে আনতে পারে না, ঠিক তখনই ভোটে জেতার জন্য ভোটদাতাদের সামনে রাখা হয় কল্যাণকর কর্মসূচির প্রতিশ্রুতি এবং বিনামূল্যে এটাসেটা প্রদানের প্রস্তাব। এ সব কখনওই চাকরি, উন্নত মানের শিক্ষা বা স্বাস্থ্য পরিষেবার বিকল্প হতে পারে না। কিন্তু যদি রাষ্ট্র সেই সব দিতে না পারে, তবে এই সব কল্যাণকর প্রকল্পের অবতারণা অনিবার্য। এ ভাবেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আর্থিক দুরবস্থা এবং সামাজিক অসন্তোষকে চাপা দিয়ে রাখে।
এমন প্রসঙ্গ উঠতেই পারে যে, ভারত অপরিকল্পিত ভাবে এবং এলোপাথাড়ি প্রক্রিয়ায় সামাজিক সুরক্ষার একটি বন্দোবস্ত গড়ে তুলতে চাইছে। এই কাজে তার হাতিয়ার হল বিনামূল্যে খাদ্যশস্য এবং স্বাস্থ্যবিমার মতো প্রকল্প। সরকার কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে গণ-কর্মসূচি তৈরি করতে চাইছে এবং বৃদ্ধ, নিঃসহায়, বেকারদের মতো সমাজের সব থেকে বিপন্ন অংশের হাতে নগদ টাকা তুলে দিতে চাইছে। সেই সঙ্গে তালিকায় জুড়ে যাচ্ছে রান্নার গ্যাস, বাড়ি ইত্যাদির মতো বিষয়ও। কে এর বিরুদ্ধে আপত্তি তুলবেন? যে অর্থনীতিতে দারিদ্র আজও বর্তমান এবং অসাম্য ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, সেখানে মনে পড়তেই পারে ১৯ শতকের আমেরিকান দার্শনিক হেনরি ডেভিড থরুর কথা। থরু লিখেছিলেন, “অধিকাংশ মানুষই শান্ত অথচ হতাশ জীবন যাপন করেন।” এ ক্ষেত্রে এয়ার ইন্ডিয়া, সরকারি টেলিকম সংস্থা এবং সরকারি ব্যাঙ্কের মতো সংস্থার ক্ষতিপূরণে হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা খরচ করার চাইতে জনকল্যাণমুখী প্রকল্প গ্রহণ অবশ্যই কাম্য।
তা হলে বিষয়টা বাধছে কোথায়? ঘুরেফিরে সেই টাকার প্রশ্নেই এসে পড়তে হবে। এমনকি, ধনী রাষ্ট্রগুলিও তাদের জনকল্যাণকর প্রকল্পের ক্ষেত্রে একই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। উন্নত দিল্লি বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতেই পারে, কিন্তু ঋণের দায়ে জর্জরিত পঞ্জাব তা পারে কি? প্রধানমন্ত্রী যখন ‘রেউড়ি’-র প্রসঙ্গ তোলেন, তখনও এ কথা সত্য যে, এই সব দ্রব্য আর পরিষেবা কি অর্থনীতির আধুনিকীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো এবং বিনিয়োগের টাকায় বিনে পয়সায় বিলোনো হচ্ছে? অন্য দিক থেকে দেখলে, ভারত কি এক যথেষ্ট বৃহৎ উৎপাদনশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে চাইছে, যেখান থেকে এক কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় কর আদায় করা সম্ভব হবে? উত্তরে বলা যায়, গত তিন দশকে মাথাপিছু আয় চার গুণ বাড়লেও রাজস্ব এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে খুব সামান্যই আশার আলো দেখা গিয়েছে। তা হলে আমরা কি সরকারি ঋণের পাহাড় তৈরি করে চলেছি, যা কর বা রাজস্বের প্রায় ৪০ শতাংশ আত্মসাৎ করছে? এই কেন্দ্রীয় রাজনীতি-অর্থনীতির প্রশ্নে দ্রুত গণ-বিতর্কের আয়োজন প্রয়োজন। নীতি আয়োগ বা ব্যক্তিগত স্তরেও কোনও চিন্তাশীল ব্যক্তি এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে পারেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy