Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Economic Inequality

বিশ্বের অন্য দেশগুলির তুলনায় ভারতে অর্থনৈতিক অসাম্যের ছবিটি কেমন? দিনবদল কি আদৌ ঘটছে?

অসাম্যকে মাপার কিছু উপায় রয়েছে। সেগুলি প্রয়োগ করলে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে কী জানা যাচ্ছে? গত ২৫ বছরে কতখানি দূর হয়েছে এ দেশের অর্থনৈতিক অসাম্য?

গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:০২
Share: Save:

নতুন শতকের প্রথম এক-চতুর্থাংশ কাটিয়ে ফেললাম আমরা। এই সময়পর্বে যা সবার আগে বোধ হল, তা এই যে, বিশ্বায়নের মধ্যাহ্ন আমরা পেরিয়ে এসেছি। পেরিয়ে আসা সময়ে আমেরিকা এবং গোটা ইউরোপ জুড়েই রাজনীতির মূল সূরটি ছিল অভিবাসন-বিরোধী মানসিকতার তারে বাঁধা। তার সঙ্গে মিশে ছিল সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ (ইটালির প্রধানমন্ত্রী যাকে ‘ইউরোপে ইসলামি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ’ বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অভিবাসন ছিল আমেরিকান সমাজে ‘বিষবাষ্প’-এর সমতুল)। এরই মধ্যে অর্থনীতির জগতে সাম্প্রতিক অসাম্য এবং যথোপযুক্ত কর্মনিযুক্তির অভাবের ফলে জন্মানো ‘অসন্তোষ’ নিয়ে বিতর্কে এ সবের জন্য বিশ্বায়ন এবং ‘নব্য উদারপন্থা’কেই দোষারোপ করা হতে থাকে।

পশ্চিমের দেশগুলির দিক থেকে দেখলে বোঝা যায়, উপরোক্ত বিষয়গুলিই বিশ্বায়ন-বিরোধীদের দাঁড়ানোর জায়গা এবং চাকরি কেড়ে নিয়েছে। আগে তাঁরা যে সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন, তা থেকে তাঁদের বঞ্চিত করেছে। কিন্তু যে সব দেশ বিশ্বায়নের ফলে উপকৃত হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে কী বলা যায়? যেমন চিন এই সময়ের মধ্যেই ‘বিশ্বের কারখানা’য় পরিণত হয়েছে, ‘ব্যাক অফিস’ এবং গবেষণার কেন্দ্র হিসাবে ভারত পরিচিতি পেয়েছে। এই দুই দেশকেই আগের চেয়ে অনেক বেশি অন্তর্মুখী বলে মনে হচ্ছে। তাদের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)-এ বাণিজ্যের অংশটি কমে এসেছে। ভারতের ক্ষেত্রে অর্থনীতির আঙিনায় আগের চেয়ে অনেক বেশি রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ, রাষ্টের তরফে সুরক্ষা প্রদান এবং ভর্তুকি দেখা দিয়েছে। নীতি নির্ধারণের জগতে নতুন দৃষ্টান্তের উদয় ঘটেছে।

ভুবনায়নের প্রথম ২৫ বছরে যে দ্রুততায় বিশ্বব্যাপী দারিদ্রের মাত্রা কমে এসেছে, সেই গতি কিন্তু আগেকার কোনও কালপর্বে দেখা যায়নি। তার উপর এ-ও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বিশ্বব্যাপী অসাম্যের মাত্রা কমতির দিকে। কারণ, বহু গরিব দেশ ধনী দেশগুলির তুলনায় অর্থনৈতিক উন্নতির ইতিবাচক দিকটিতে অগ্রগতির পরিচয় দিয়েছে। একটি হিসাব মোতাবেক বিশ্বব্যাপী ‘জিনি কোয়েফিশিয়েন্ট’ (অসাম্য পরিমাপের সুচক) গত ২৫ বছরে যথেষ্ট মাত্রায় সংশোধিত হয়েছে। যার ফলে গোটা বিংশ শতক জুড়ে থাকা অসাম্যের অনেকটাই অবসান ঘটেছে। অন্য দিকে, ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট অনুসারে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ থেকে পরবর্তী ৪০ শতাংশের আয় কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে এবং ৫০ শতাংশের নীচে আয় কমেছে।

উপরের ছবিটি গোটা পৃথিবীর। দেশে দেশে অসাম্যের চেহারাটি কেমন? বিশ্ব ব্যাঙ্কের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, জিনি কোয়েফিশিয়েন্টের পতনমুখী প্রবণতা থ্যাচার-রেগন জমানা থেকেই বিপরীত দিকে হাঁটতে শুরু করে এবং ২০টিরও বেশি বৃহৎ রাষ্ট্রে, উন্নত (ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স) এবং উন্নয়নশীল (চিন, ব্রাজিল, মেক্সিকো) উভয় প্রকার দেশগুলিতেই উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। বৃহত্তর অর্থে তুরস্ক ও নাইজেরিয়ার মতো দেশে সার্বিক অর্থে তা অপরিবর্তিতই ছিল। কিন্তু ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় তার অবনমন ঘটে। অসাম্যের তালিকায় ভারত তবু মাঝামাঝি থেকে খানিক উপরের দিকে রয়েছে। ইতিমধ্যে উন্নত দেশগুলির পারিশ্রমিক কাঠামো থেকে বোঝা যায়, শ্রমিকের অভাব বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পারিশ্রমিক (মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে আপস করেও) বাড়তে শুরু করেছে। আমেরিকা ও এবং এই মুহূর্তে কিছু ইউরোপীয় দেশের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য। এ থেকে বোঝা যায়, অসাম্য আরও খানিকটা কমে আসবে।

বিশ্বায়নের অন্যতম লক্ষণ হল মানুষের গতায়াত বৃদ্ধি (পশ্চিমের অভিবাসন বিরোধিতার উল্টো দিকে)। অন্য যে কোনও দেশের চেয়ে ভারত এই বিষয়টি থেকে উপকৃতই হয়েছে। এ কথা সত্য যে, শিল্পোৎপাদনে ভারত চিনের সমান সাফল্য পায়নি। কিন্তু সে দেশ বাদ দিলে বৈদেশিক বাণিজ্যে, বিশেষত খনিজ তেল ছাড়া অন্য পণ্যের ক্ষেত্রে ভারত বেশ সুবিধাজনক অবস্থাতে রয়েছে। জিডিপি-র নিরিখে ভারতে শিল্পোৎপাদনের মাত্রা পশ্চিমের দেশগুলির মতো কমে যায়নি। যে ক্ষেত্রে ভারতের খামতি থেকে গিয়েছে, তা হল, এখানে শিল্পোৎপাদন জিডিপি-র থেকে বেশি গতিতে বাড়েনি।

ভারতের তরফে এই ধরনের বৈষম্যের বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত ছিল। এ কথা সত্য যে, তিন দশক আগেও যেখানে এ দেশের অর্ধেক মানু্ষের দৈনিক আয় ২.১৫ আমেরিকান ডলার (‘অ্যাবসোলিউট পভার্টি’ বিষয়ে বিশ্বের মাপকাঠি)-এর বেশি ছিল, সেখানে এখন আট জনের মধ্যে সাতজনের আয়ই এই মাপকাঠির উপরে। উপার্জন-পিরামিডের চূড়ায় গিয়ে দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালে বিশ্বের সর্বোচ্চ উপার্জনকারীদের মধ্যে মাত্র ১.৫ শতাংশ মানুষ ভারতীয়। এক দশক আগে এই পরিসংখ্যানটি ছিল ১.৩ শতাংশ।

নীতি নির্ধারণের বিন্দু থেকে দেখলে ভারতের দারিদ্র এবং অসাম্যের একটি ভৌগোলিক প্রেক্ষিত রয়েছে। দেশের মধ্যভাগে অবস্থিত রাজ্যগুলির অর্থনীতির বৃদ্ধি উপকূলবর্তী মানুষের থেকে অনেকটাই কম। বিহার, ছত্তীসগঢ় প্রভৃতি রাজ্য অবশ্য অগ্রগতির শ্রেয়তর পথ খুঁজে নেবে। এর সঙ্গে শাসন পরিচালনার সম্পর্ক রয়েছে। সেই সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো পরিষেবার। এবং সেই রাজ্য বিনিয়োগকারীদের কী ভাবে আকৃষ্ট করতে পারে, তার সঙ্গেও। বরং বলা যায়, বিশ্বায়ন এবং তার আদর্শগত অনুষঙ্গের সঙ্গেই তার কোনও সম্পর্ক নেই।

এর পরে যা বাকি থাকে, তা হল বেকারত্বের সমস্যা। সরকারি পরিসংখ্যান জানায়, পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের চোখে একই পরিসংখ্যান অন্য ভাবে প্রতিবিম্বিত হয়। সরকারের ‘প্রোডাকশন-লিঙ্কড’ বা উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ইনসেন্টিভ (পিএলআই) স্থানীয় স্তরে নিয়োগ-নিবিড় ‘অ্যাসেম্বলিং’-এর ক্ষেত্রটিতে কর্মনিযুক্তি বাড়াতে পারে (আশা করা যায়, এই পথে এগিয়ে আরও গভীরে পৌঁছে শিল্পোৎপাদনেও নিয়োগ বৃদ্ধি সম্ভব হবে)। কিন্তুএটি আংশিক সমাধান। কঠিন সত্যটি এই যে, সুবেতন যুক্ত চাকরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কী পদ্ধতি অনুসৃত হবে, তার কোনও সহজ উত্তর নেই। ভারতের কাছে এই প্রশ্নটি কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক সাবধানবাণী। এটি বাদ দিলে ভারত নতুন শতাব্দীর শুরুর সময়ের তুলনায় এখন অনেকটাই ভাল অবস্থায় রয়েছে। এর জন্য খানিকটা অভিনন্দন তার প্রাপ্য তো বটেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Gini Coefficient Globalization
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy