Advertisement
১৮ ডিসেম্বর ২০২৪
Economic Growth

চলতি অর্থবর্ষে কতটা কমেছে দেশের আর্থিক বৃদ্ধি? আদৌ কি দেখা যাচ্ছে আশার আলো?

দেশের আর্থিক বৃদ্ধির গতি কমছে কেন? যে সব জায়গায় উজ্জ্বলতা দেখা যাচ্ছে, সেগুলি কি আদৌ কোনও আশা জাগায়?

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২২ ০৯:২০
Share: Save:

ভারতে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গতি কমে আসার লক্ষণগুলি যে নজর এড়িয়ে যাচ্ছে, তেমন নয়। শিল্পোৎপাদন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, রফতানি অথবা পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) থেকে আগত আয়— সব ক্ষেত্রেই গতির অভাব ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে। কোনও কোনও লক্ষণ আবার কিছুটা ছদ্মবেশী, যা অনেক সময় পরিস্থিতিকে বুঝতে দেয় না। যেমন ব্যাঙ্ক ক্রেডিটের ক্ষেত্রে ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি। কিন্তু যখন পাইকারি বাজারে মুদ্রাস্ফীতি ১২.৪ শতাংশ, তখন সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি কতখানি প্রতিফলিত হয়?

যদি পণ্য রফতানির বিষয়টির দিকে তাকানো যায় তা হলে দেখা যাবে, গত বছরের বৃদ্ধির থেকে এই ক্ষেত্রে যে প্রাথমিক গতি নজরে এসেছিল, তা সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই হারিয়ে গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ওই মাসে তা সাড়ে তিন শতাংশ হ্রাসও পেয়েছে। বিশদ হিসাব নিতে গেলে দুর্ভাবনা আরও বেড়ে যাবে। ভারত থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের রফতানিও সেপ্টেম্বরে একই পরিমাণে কমেছে। বয়নশিল্পের ক্ষেত্রে (সুতো থেকে তৈরি পোশাক পর্যন্ত) তা ৩১.৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বৈদ্যুতিন পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে অবশ্য বড় অঙ্কের বৃদ্ধি (প্রায় ৬৪ শতাংশ) দেখা গিয়েছিল। কিন্তু তা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেত্রগুলির হাল ফেরানো যায়নি। এবং সেই সঙ্গে এ-ও স্বীকার্য যে, এই বিশেষ ক্ষেত্রটিতে রফতানি বৃদ্ধি দেশজ অর্থনীতিতে তেমন কোনও অবদান রাখতে পারেনি। সব মিলিয়ে যা দাঁড়িয়েছে তা হল এই যে, অর্থ-বছরের প্রথম ছ’মাসে পণ্য সংক্রান্ত বাণিজ্যে ঘাটতির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। পরিষেবা সংক্রান্ত বাণিজ্য-সহ ভারতের এক বছরের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ঘাটতি (রফতানির থেকে আমদানি বেশি হওয়া) থেকে মনে হচ্ছে যে, এক দশকের মধ্যে তা সর্বোচ্চ সীমায় গিয়ে পৌঁছবে।

যদি বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রের দিকে চোখ রাখা যায়, তা হলে দেখা যাবে তার অবস্থাও রফতানির মতোই। বছরের গোড়ার দিকে পরিসংখ্যান কিছুটা আশাব্যঞ্জক হলেও অগস্ট মাসের পর থেকে বৃদ্ধি কমতে শুরু করে এবং পরিসংখ্যান হঠাৎই নামতে শুরু করে। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে বিদ্যুৎ উৎপাদন ২০১৭-১৮-র তুলনায় মাত্র এক শতাংশ বেড়েছিল, এ কথা মাথায় রেখে বিষয়টিকে দেখা প্রয়োজন।

শিল্পোৎপাদনের দিকে নজর ফেরালে দেখা যাবে, চলতি বছরের জুলাই মাসে বৃদ্ধির হার ছিল ২.৪ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে ‘কোর সেক্টর’ বা উৎপাদনের মূল ক্ষেত্রগুলিতে (যেমন, ইস্পাত, সিমেন্ট, সার এবং অন্য শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রগুলি) বৃদ্ধির হার ছিল ৩.৩ শতাংশ যা ন’মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। এপ্রিল মাসে (মার্চের বাৎসরিক বৃদ্ধির হিসাবকে মাথায় রাখতে হবে) আদায়ীকৃত রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১.৬৮ লক্ষ কোটি টাকা। পরবর্তী মাসগুলিতে তা যথাক্রমে কমে দাঁড়ায় ১.৪১ লক্ষ কোটি, ১.৪৪ লক্ষ কোটি, ১.৪৯ লক্ষ কোটি এবং ১.৪৩ লক্ষ কোটি টাকায়। সেপ্টেম্বরে আদায় হয়েছে ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকা। এর বেশি বৃদ্ধি কিন্তু চোখে পড়ছে না।

যদি অর্থনীতির সার্বিক হাল এমন এক বিশেষ জায়গায় গিয়ে ঠেকে, তা হলে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের ক্ষেত্রে দ্রুত বৃদ্ধির বিষয়টিকে কেউ কী ভাবে ব্যাখ্যা করবেন? এই ঔজ্জ্বল্যের পিছনে অন্যতম কারণ হল কর্পোরেট ক্ষেত্রগুলিতে লাভ অব্যাহত থাকা। যদিও এ কথাও সত্য যে, গত ন’টি ত্রৈমাসিকে তাদের লাভের ব্যবধান যে অনেকটাই কমে একেবারে তলানিতে নেমে এসেছে তা পণ্যমূল্যের বৃদ্ধির গতি দেখলেই বোঝা যায়। এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে নথিভুক্ত প্রায় তিন হাজারটি সংস্থার মোট লাভের বৃদ্ধি ছিল ২২.৪ শতাংশ। কিন্তু লগ্নি-ক্ষেত্রের স্বাস্থ্যোন্নতি ঘটলে দেখা যায় সেই পরিমাণ বাড়তে শুরু করেছে। সেই ক্ষেত্রকে বাদ দিলে দেখা যাবে পরিসংখ্যান নেমে এসেছে ১৬.৩ শতাংশে। লাভের বৃদ্ধি জমা হয়েছে মাত্র আধ ডজন সংস্থাকে ঘিরে। আর তা থেকেই এই ‘সার্বিক’ উন্নতির ছবিটি ফুটে উঠছে। এ কথা মনে রাখতে হবে যে, শেয়ার বাজারের প্রধান সূচকগুলি গত বছরের তুলনায় এই মুহূর্তে বেশ নীচেই অবস্থান করছে। পাশাপাশি, ডলারের তুলনায় টাকার দাম কমেই চলেছে।

বেশির ভাগ (সব নয়) দুঃসংবাদের পিছনে কাজ করছে বহিরাগত কারণগুলি। যেমন— জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, সরবরাহে ছেদ, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং সর্বোপরি বিশ্ব অর্থনীতিতে বৃদ্ধির গতি হ্রাস। এ-ও মনে রাখা দরকার যে আমরা এক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি। যেখানে বৃদ্ধি সংক্রান্ত প্রত্যাশাকে খানিক দমিয়ে রাখাই দস্তুর। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পুর্বাভাসের (সারা বছরে সাত শতাংশ বৃদ্ধি) সঙ্গে তাল রেখে বিভিন্ন পরিসংখ্যান দিয়ে পরিস্থিতিকে উজ্জ্বল হিসেবে দেখানো সত্যিই কঠিন ব্যাপার। বিশ্ব ব্যাঙ্ক বরং তার সংশোধিত পূর্বাভাস সাড়ে ছ’শতাংশকে বাস্তবানুগ রাখতে সমর্থ হয়েছে বলে ধরা যায়।

ইতিমধ্যে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক চড়া মুদ্রাস্ফীতি আর অতিরিক্ত কম বৃদ্ধির মাঝখানে পড়ে হাঁসফাঁস করছে। ১০ বছরের ট্রেজারি বন্ডের মূল্য গত বছরের তুলনায় ৬.২৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭.৪৫ শতাংশে পৌঁছেছে। বিগত দশকের মূল্যমানের ঠিক মধ্যবর্তী জায়গায় তা অবস্থান করছে বলা যায়। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যদি মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যায় তা হলে বন্ডের মূল্য কিছুটা বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে বৃদ্ধির গতি খানিক দ্রুত হবে আশা করা যায়। এর বিপরীতে আদায়ীকৃত করের সৌজন্যে সরকার বাজার থেকে কম ঋণ নেবে এবং সুদের হারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হবে। কিন্তু চলতি অর্থবর্ষের দ্বিতীয়ার্ধে যদি বৃদ্ধি নেমে ৪ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়, তা হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অতিমারির আগের বছর এই পরিসংখ্যানেই কিন্তু তা আটকে ছিল।

অন্য বিষয়গুলি:

Economic Growth Indian Economy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy