বঙ্গ রাজনীতিকে সর্বাধিক প্রভাবিত করেছেন, এমন ব্যক্তির তালিকায় তাঁর নামটি অপরিহার্য হয়ে থাকবে, রাজনীতির সঙ্গে দূরতম সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও। ৮৮৭৫২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের রাজ্যের ইতিহাসের খাত ভিন্ন ধারায় বইয়ে দিয়েছিল যে চার বর্গ কিলোমিটার বা ৯৯৭ একরের ভূখণ্ডটি, রতন টাটা তাকে বেছে নিয়েছিলেন স্বপ্ন লিখবেন বলে। তাঁর স্বপ্ন— কোনও মধ্যবিত্ত দম্পতিকে যেন দুই সন্তানকে নিয়ে স্কুটারে করে যেতে না-হয়; প্রত্যেক ভারতীয়র জন্য তৈরি হবে ‘লাখ টাকার গাড়ি ন্যানো’। স্বপ্ন পশ্চিমবঙ্গ নামক শিল্প-শ্মশানটিরও— ঘুরে দাঁড়ানোর, শিল্পের ভবিষ্যৎ রচনার। স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছিল ২০০৮ সালের অক্টোবরে। সিঙ্গুরের পালা সাঙ্গ করে টাটা মোটরস-এর কারখানা চলে গেল গুজরাতের সানন্দে। পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতির পট পাল্টাল আড়াই বছরের মাথায়, আর্থিক ভবিষ্যৎ পাল্টাল না। তৎকালীন বিরোধী নেত্রীর নাম উল্লেখ করেই টাটা বলেছিলেন, উনি শুধু মাথায় বন্দুক ঠেকাননি, ট্রিগার টিপে দিলেন। সেই গুলি কাকে বিদ্ধ করেছিল, ইতিহাস তার হিসাব রাখবে নিশ্চয়ই।
জামশেটজি টাটার পুত্র রতনজি টাটার দত্তক-পুত্র নভল ও সুনু টাটার পুত্র রতনের জন্ম ১৯৩৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর, তৎকালীন বোম্বাইয়ে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনার্সিটি থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক হয়ে ১৯৬১ সালে যোগ দেন টাটা গোষ্ঠীর ব্যবসায়। পরিচালকের ভূমিকায় নয়, হাতেকলমে কাজ শেখা শুরু করেন। সংস্থার চেয়ারম্যান তখন জে আর ডি টাটা। তাঁর সঙ্গে রতনের রক্তের সম্পর্কটি খুব নিকট নয়। অবশ্য হৃদয়ের সম্পর্ক কবেই বা আর রক্তের তোয়াক্কা করেছে! রতন টাটা তাঁর অভিভাবক, গুরু, বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন জে আর ডি-কে; তিনিও রতনকে গ্রহণ করেছিলেন সন্তান হিসাবেই। ১৯৭০-এর দশকের গোড়ায় জে আর ডি-র হাত ধরেই টাটা গোষ্ঠীর পরিচালনায় প্রবেশ করেন রতন টাটা। ১৯৯১ সালে জে আর ডি-র মৃত্যুর পর তাঁর মনোনীত উত্তরসূরি হিসাবে টাটা গোষ্ঠী ও টাটা সন্স-এর চেয়ারম্যান পদে অভিষেক রতন টাটার।
সে প্রক্রিয়া অবশ্য নিষ্কণ্টক ছিল না। গোষ্ঠীর বিভিন্ন শাখার প্রধানদের রীতিমতো আপত্তি ছিল রতনের শীর্ষপদে অধিষ্ঠানে। ব্যবসা পরিচালনার কাজে এই প্রধানদের বেশ খানিক স্বাধীনতা ছিল সে সময়। সংস্থার চেয়ারম্যান হয়ে রতন টাটা সংস্কারের পথে হাঁটলেন— সংস্থায় অবসরের বয়স নির্ধারিত হল; স্থির হল, অতঃপর শাখা সংস্থাগুলিকে রিপোর্ট করতে হবে টাটা গোষ্ঠীর কাছে; গোষ্ঠীর ব্র্যান্ড নির্মাণের জন্য শাখা সংস্থাগুলিকে তাদের মুনাফার একটি অংশ দিতে হবে। সংস্থার উপরে রতন টাটার আধিপত্য বিস্তারের মোক্ষমতম চালটি ছিল টাটা স্টিলের শীর্ষ পদ থেকে রুসি মোদীকে ছাঁটাই করা। আর্থিক সংস্কার-পূর্ব ভারতের কর্পোরেট দুনিয়ার অন্যতম খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব রুসির বহিষ্কার প্রতিষ্ঠা করেছিল, এর পর থেকে গোষ্ঠীর ব্যবসা চলবে রতন টাটার নির্দেশানুসারে।
টাটা গোষ্ঠীর ইতিহাসে রতন টাটার সবচেয়ে বড় অবদান কী, এই প্রশ্নের অনেক রকম উত্তর সম্ভব। কেউ বলবেন, তাঁর ২১ বছরের চেয়ারম্যান-জীবনে টাটা গোষ্ঠীর মুনাফা বেড়েছে বহু গুণ। কেউ বলবেন, দেশের গণ্ডি টপকে টাটা গোষ্ঠীকে একটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড করে তোলাই রতন টাটার শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার। তাঁর আমলে টাটা টি অধিগ্রহণ করেছে টেটলি-কে; টাটা মোটরস অধিগ্রহণ করেছে জাগুয়ার ল্যান্ডরোভারকে; টাটা স্টিল কিনে নিয়েছে কোরাস-কে। টাটা গোষ্ঠীর মোট মুনাফার একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ এখন আসে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে।
কেউ আবার বলবেন, রতন টাটার শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব তাঁর স্বপ্নকে ধাওয়া করা। ন্যানোর স্বপ্নটি শেষ অবধি তার অভীষ্ট পরিণতিতে পৌঁছয়নি— গুজরাতের কারখানায় গাড়ি তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু ভারতীয় বাজারে প্রত্যাশিত সাড়া ফেলতে পারেনি। রতন টাটা পৌঁছেছেন তাঁর পরবর্তী স্বপ্ন— ভারতীয় গাড়ি শিল্পর দুনিয়ায় বৈদ্যুতিন গাড়ি নির্মাণের স্বপ্নকে ‘ফাস্ট ফরওয়ার্ড’ করে বাজারে এনেছেন দেশি ‘ইভি’। পাশাপাশি পালন করেছেন সামাজিক দায়িত্বও। শিক্ষা অথবা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে টাটা গোষ্ঠীর যে অবদান, তার ধারা অব্যাহত থেকেছে রতন টাটার আমলেও। আইআইটি বম্বে, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের মতো প্রতিষ্ঠানে মোটা টাকা দান করেছেন তিনি। তবে, এটাও সত্যি যে, শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর খয়রাতির বড় অংশ পেয়েছে আমেরিকা। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়া সান ডিয়াগো, কার্নেগি মেলান ইউনিভার্সিটি, কর্নেল ইউনিভার্সিটির মতো প্রতিষ্ঠান বিপুল তহবিল পেয়েছে তাঁর আমলে। পেয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ইউনির্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস-এর মতো বিশ্ববিদ্যালয়ও। সে টাকায় টাটা গোষ্ঠীর নাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে উন্নত দুনিয়ায়— এ-ও এক অর্জন। তবে, সেই টাকা ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পেলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার খানিক উন্নতি হত কি না, সে প্রশ্নও থাকছে।
তবে, ভারতীয় মানসে রতন টাটা সম্ভবত থেকে যাবেন ‘আদর্শ পুঁজিপতি’ হিসাবে, যাঁর সম্বন্ধে খানিক জেনে অথবা একেবারে কিছু না-জেনেই দেশের বহু মানুষ শ্রদ্ধাবনত ছিলেন দীর্ঘ দিন। বর্তমান শাসক-ঘনিষ্ঠ দুই গুজরাতি ধনকুবেরের সঙ্গে তুলনায় রতন টাটাকে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করেছে ভারতবাসী। বিশ্বাস করেছে যে, ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের তাড়নায় নয়, বরং ভারত নির্মাণের প্রকল্প নিয়ে, দেশকে প্রযুক্তিগত উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বিনিয়োগ করে গিয়েছেন তিনি। কথাটির মধ্যে কত আনা সত্য আছে, সে তর্ক অবান্তর— মানুষের মনে এই আসনটি তৈরি করার কৃতিত্বও খুব বেশি উদ্যোগপতির নেই; শুধু ভারতে নয়, গোটা বিশ্বেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy