ভোটের বোতাম টেপার বাইরে গণতন্ত্রে জনতার আর কোনও ভূমিকা নেই, এমনটা যখন ভেবে ফেলে শাসক বা বিরোধী, যে কোনও রাজনৈতিক দল, তখন একটা সফল গণআন্দোলনই পারে তাঁদের ধরে ঝাঁকিয়ে দিতে, ঔদ্ধত্যের রথ থামিয়ে দিতে। আশাতীত ভাবে সফল ‘নারী ও প্রান্তিক লিঙ্গের রাত দখল’ আসলে তেমনই একটা আন্দোলনের রূপ নিল।
গণআন্দোলনের চরিত্রই হল, তার ‘হোতা’ হয় না কোনও মহামানব। ব্যক্তি, সংগঠন বা পার্টি যদি তার কৃতিত্ব দাবি করে, তবে তাদের চিনে নিতে হয় সুযোগসন্ধানী হিসাবে। যাঁরা রাত জাগার ডাক দিয়েছেন, তাঁদেরও ব্যাটন তুলে দিতে হয় জনগণের হাতে। আহ্বায়কদের কাজ, গণআন্দোলনের এই চরিত্র বজায় রাখা ও মানুষের ক্ষোভকে সঠিক দিশায় চালিত করা মাত্র। বেশির ভাগ জায়গায় এই বোঝাপড়া বজায় রাখা গিয়েছিল বলেই স্বাধীনতার ভোর এক সঙ্গে দেখল সারা পশ্চিমবঙ্গ, সারা ভারত, তথা প্রবাসী ভারতীয় মেয়ে ও প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌন গোষ্ঠীর মানুষ। নিজেকে ধরেই বলছি, এ-হেন কাকিমা-মাসিমাদের পথে নামার রাত আহ্বায়করা নিজেরাও কখনও দেখেছেন কি? এ আমাদের জন্যও এক অনন্য অভিজ্ঞতা, শিক্ষা।
অভিজাত মেয়েদের আন্দোলন হিসাবে একে কখনও ভাবা হয়নি বলেই, সর্বপ্রথম ফোন গিয়েছিল গিগকর্মীদের কাছে। বাড়ির বিভিন্ন কাজে লোক পাঠায়, এমন এক পরিষেবা প্রদানকারী অনলাইন সংস্থার কর্মী-মেয়েরা আসতে চেয়েছিলেন ক্লায়েন্টের বাড়িতে যৌন-নির্যাতনের কথা বলতে। অশোকনগরে এসেছিলেন মিড-ডে মিল কর্মীরা। আকাদেমিতে আশাকর্মীরা শুধু আসেননি, তাঁদের মধ্যে এক জন প্রতিনিধি সভা-পরিচালনার দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছেন। এক সঙ্গে পথে নেমেছিলেন শান্ত গৃহবধূ ও বিদ্রোহী নারীবাদী। তাঁরা পথে, কর্মক্ষত্রে এমনকি গৃহেও নারীর সুরক্ষা নিয়ে শঙ্কিত। কী আশ্চর্য, যে মা-মাসিরা পিতৃতান্ত্রিক মস্তিষ্কপ্রক্ষালনের ফলে এত দিন হয়তো নিজেরাও ধর্ষণের জন্য দায়ী করতেন ধর্ষিতার পোশাক, বাইরে বেরোনোর সময় ও তারই নানা আচরণকে, তাঁদেরও সঙ্গে পেলাম! মনে হয়, এই প্রথম বার ভারতে একটি আন্দোলন শুধু ধর্ষণের ঘটনার নিরিখে বিচার ও শাস্তি দাবি করল না, বরং নির্যাতনের জন্য নির্যাতিতাকেই দায়ী করার বিরুদ্ধে স্পষ্ট রুখে দাঁড়াল নারী ও প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌন গোষ্ঠী। ‘রাতে মেয়ে কেন একলা?’— যে কথা নাকি অধ্যক্ষ বলেছিলেন, সে রকম কথা প্রায়শই কি শোনা যায় না পাড়ার রকে, খাবার টেবিলে? ভিক্টিম-ব্লেমিং আমাদেরই সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল। সেই সংস্কৃতির উত্তরাধিকার রাত দখলের আন্দোলন সজোরে ছুড়ে ফেলল আঁস্তাকুড়ে।
আমরা রাত্রিব্যাপী প্রতিবাদ সভা ভেবেছিলাম, যাতে মাঝরাতে মেয়েদের বাড়ি ফেরার পথে অসুবিধা না হয়। সে দিন সারা রাত খোলা ছিল মহিলা শৌচালয়, যা থেকে উঠে এসেছে নতুন দাবি: কেন রাত দশটায় শহর জুড়ে নারী শৌচালয় বন্ধ হয়ে যায়? কেন মোড়ে মোড়ে নেই ট্রান্স মানুষের শৌচালয়? ট্রান্স মানুষ তমোঘ্নর মৃত্যুপরবর্তী হেনস্থা (মৃতদেহকে আবৃত না রাখা ইত্যাদি) নিয়েও উঠল নানা অভিযোগ।
এ আন্দোলনে কোনও দলীয় ব্যানারের প্রয়োজন হল না। কোনও সামাজিক সংগঠনের ব্যানারও এখানে ব্যবহৃত হয়নি। কিন্তু দলীয় রাজনীতির সঙ্গে এই আন্দোলনের সম্পর্ক বা সমীকরণটি বলে রাখা বিশেষ ভাবে দরকার। আহ্বায়করা যখন অংশগ্রহণে ইচ্ছুকদের ফোন ধরেছেন, তখন দেখেছেন, প্রতিটা ফোন যে প্রথম প্রশ্নটি করে, তা হল, ‘আপনারা কোনও রাজনৈতিক দল নন তো?’ কেউ বলতে পারেন, এ সাধারণ মানুষের ভীরুতা যে, তাঁরা দলীয় হিসাবে চিহ্নিত হতে চান না। ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়, যে মানুষ রাজপথে ঢল নামাতে পারেন, আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে পাঁচশো জায়গায় রাতভর সমাবেশ সংগঠিত করতে পারেন পুলিশের ভয় জয় করে, তাঁদের ভীরু ভাবা মূঢ়তা। দলের মিছিলে যাওয়ার তাঁদের অনাগ্রহকে বিতৃষ্ণা হিসাবে দেখছি। একে অ-রাজনীতি বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
মনে হয়, এ বিতৃষ্ণাও রাজনৈতিক। দলীয় রাজনীতির স্বার্থানুসন্ধান ও দুর্নীতি সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল বলেই সাধারণ মানুষ দলীয় পতাকা বর্জন করলেন। এটাই তাঁদের রাজনৈতিক সচেতনতা। এই আন্দোলনের মাধ্যমে সাধারণ মেয়ে ও প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌন গোষ্ঠী সরাসরি কথোপকথন শুরু করেছে রাষ্ট্রের সঙ্গে। সুস্পষ্ট ভাবে দাবি পেশ করছে: কেন দেবে না সব লিঙ্গের জন্য রাস্তায় পর্যাপ্ত আলো, সুলভ শৌচালয়, কর্মক্ষেত্রে বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা? কেন যৌন হেনস্থার অভিযোগ জানানোর ‘অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি’ একটা প্রহসনে পরিণত হয়েছে?
এই এত প্রশ্নকে ‘অরাজনৈতিক’ বলা হলে, রাজনীতি কী? শুধু ক্ষমতার খেয়োখেয়ি? ‘রিক্লেইম দ্য নাইট’ দেখাল, প্রবল ভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনও অ-দলীয় হতে পারে। আহ্বায়করা যখন রাজনৈতিক নেতাদের মঞ্চে উঠতে দেন না, তখন তাঁরা স্রেফ সাধারণ মানুষের চাহিদার বাস্তবায়ন ঘটান। সাধারণ মানুষই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁদের কাঁধে চেপে কাউকে রাজনৈতিক আখের গোছাতে দেবেন না তাঁরা। বর্তমান শাসনহীনতার বিরুদ্ধে সংগঠিত মিছিল থেকেই হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে, মনুবাদী পিতৃতান্ত্রিক বিজেপিকে এই আন্দোলনের সুবিধা তুলতে দেওয়া হবে না। মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে সিপিএম যুগের বানতলা আর তৃণমূল যুগের কামদুনি, একই সঙ্গে। ঢালধারী র্যাফকে প্রতিহত করছে সাধারণ মেয়ে, ট্রান্স আর ক্যুয়ার মানুষের দল।
কোজাগরী আর শুধু প্রতীকী আছে কি? এ যদি চেতনার জাগরণ না হত, জাগরণ তবে কী?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy