ভুটান সীমান্তে পাহাড়ের পাদদেশে টোটো জনজাতির ছোট্ট গ্রাম টোটোপাড়া।
আলিপুরদুয়ার জেলার ভুটান সীমান্তে পাহাড়ের পাদদেশে টোটো জনজাতির ছোট্ট গ্রাম টোটোপাড়া। ভাষা টোটো, প্রকৃতির উপাসক, নিরাকার শক্তিতে বিশ্বাসী। জনজাতির লোকসংখ্যা মাত্র ১৬০০। গোষ্ঠীর জনসংখ্যার নিরিখে তেমন বিপন্ন না হলেও তাঁদের ভাষা বিশেষ ভাবে বিপন্ন। প্রায় দু’শো বছর এই অঞ্চলের বাসিন্দা, জাতিগত বিচারে মঙ্গোলয়েড এই গোষ্ঠী প্রাথমিক ভাবে ছিল যাযাবর। কথিত আছে যে, ভুটান থেকে এসে কোচ রাজার রাজত্বে বসতি স্থাপন করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু নানা কারণে কোচ রাজা তাঁদের বিতাড়িত করলে ভুটান সীমান্তে পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপন করেন। বাজার-শহর মাদারিহাটের সঙ্গে গ্রামটির নিত্য যাতায়াতের বাইশ কিলোমিটারের প্রায় ছয় কিলোমিটার রাস্তা আসলে রাস্তাহীন, কেবল পাথরে ভরা নদী। বর্ষার সময় হড়পা বান সেই রাস্তা দিয়ে এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনেককে। পথে যত ক্ষণ জল চলে, তত ক্ষণ যাতায়াত বন্ধ।
পাহাড়ের গায়ে সুপারি বনের সারি আর তার ফাঁকে টোটোদের বাড়ি। সুপারি বিক্রি, সামান্য চাষ আর পশুপালন— এই জীবিকা। পাহাড়ের গায়ে পায়ে পায়ে তৈরি হওয়া দুর্গম পথ বেয়ে নীচে তোর্সার তীরে টোটোপাড়ার ছোট্ট বাজারের কাছে স্কুলে পড়তে আসে বাচ্চারা। বর্ষায় পাহাড় বিপদসঙ্কুল, জোঁকের ভয়। সপ্তাহে এক দিনের বেশি স্কুলে যাওয়া যায় না। সত্তর জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল কেউ নার্স হতে চায়, কেউ সেনা, কেউ শিক্ষক। টোটোপাড়া টোটো, নেপালি, রাজবংশী, বাঙালি, বিহারিদের নিয়ে তৈরি। বেশির ভাগ ছেলেমেয়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা লেখাপড়া করার; তারা নিজেদের সংস্কৃতি ও ভাষা রক্ষার জন্য আকুল।
প্রধান শিক্ষককে নিয়ে মাত্র তিন জন স্থায়ী শিক্ষক। পার্শ্বশিক্ষক চার জন। সবাই আসেন পাথুরে রাস্তা পেরিয়ে মাদারিহাট থেকে। বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের কয়েকটি দোকান। সম্বল মঙ্গলবারের হাট। টোটো সমাজের অভিভাবক ও সাংস্কৃতিক পিতা, টোটো বর্ণমালার জনক সাহিত্যিক ধনীরাম টোটো বলছিলেন, বাংলাদেশ অত বড় সেতু বানাতে পারলে এই নদীর উপর আমরা কেন পারি না। পাথর আর বালি আমাদের আছে, সরকারকে লোহা আর সিমেন্ট কিনতে হবে।
টোটোদের মধ্যে প্রথম স্নাতকোত্তর পাশ, এক আদিম জনজাতির প্রথম স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ধনঞ্জয় টোটো চাকরির অপেক্ষায়। প্রতিটি বাড়িতে এক জন মাধ্যমিক পাশ বিদ্যার্থী মেলে। কিন্তু যুবসমাজ পড়া ছেড়ে ভিনরাজ্যে কাজের সন্ধানে যাচ্ছে। কারণ, যাঁরা পড়াশোনা করেছেন তাঁরা সবাই প্রায় কর্মহীন। টোটোপাড়ায় পৌঁছনোর কোনও পথ নেই। নেতা-মন্ত্রীরা পৌঁছতে পারলেও গণতন্ত্রের সুযোগ খুব বেশি এসে পৌঁছয়নি তাঁদের কাছে। আছে কেবল পঞ্চায়েত। আক্ষেপ করছিলেন, এই বহু জনজাতির দেশ ভারতে কি এ রকম নিয়ম করা যায় না যে, প্রতিটি জনজাতি সম্প্রদায়ের এক জন প্রতিনিধি বিশেষ ভাবে নির্বাচিত হয়ে বিধানসভা ও লোকসভায় গিয়ে বলবেন নিজেদের কথা। কারণ ভোটে জেতা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬০০ জনের মতো ভোটার।
ধনীরাম, ভক্ত টোটো, বকুল টোটোরা গড়েছেন টোটো উন্নয়ন সমিতি। অভিষেক টোটো, সোনে টোটোরা গড়েছেন টোটো ইয়ং গ্রুপ, নাচে গানে অভিনয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন নিজেদের সংস্কৃতি। কিন্তু না আছে সরকারি অনুদান, না আছে মঞ্চ। ধনীরাম টোটো প্রথম ঔপন্যাসিক, প্রকাশিত ধানুয়া টোটোর কথামালা, বাংলা ভাষায়। কিন্তু তিনি প্রথম উপন্যাস রচনা শুরু করেন ১৯৯৭-এ, ডয়ামারা নদীর ধারে। ২০১৮-য় পুনরায় সম্পাদনা করেন উপন্যাসটি, বছরের শেষের দিকে প্রকাশিতব্য। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাসও অপ্রকাশিত, উত্তাল তোর্সা। আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসটি টোটো ভাষায় অনুবাদ করছেন সত্যজিৎ টোটো। ভাষা বাঁচানোর প্রাণপণ লড়াই মাধ্যমিক পাশ ধনীরাম আর সপ্তম শ্রেণি উত্তীর্ণ সত্যজিৎদের। আমরাই কেন নাটকে সত্যজিৎ বলেন ১৯৬৪-তে সরকার কর্তৃক তোর্সার তীর থেকে টোটোদের উৎখাতের গল্প থেকে ২০১৮-য় জেলা হাসপাতালে তাঁর মৃত্যুমুখী স্ত্রীকে ডাক্তার কর্তৃক ‘জংলি’ বলে অপমানের যন্ত্রণার কথা।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের গবেষকদের উদ্যোগে চলছে টোটো গান ও কবিতা অনুবাদ। ‘ক্যালকাটা কম্পারেটিস্ট ১৯১৯’ ট্রাস্টটি উদ্যোগী সাহিত্য অনুবাদ ও প্রকাশনার ব্যবস্থাপনায়। পশ্চিমবঙ্গ দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি আগ্রহী টোটোদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিস্তারে। ধনীরাম প্রস্তুত করেছেন লিপি, তিনি ও ভক্ত টোটো প্রস্তুত করেছেন যথাক্রমে তিনশো ও বারোশো শব্দের টোটো-বাংলা শব্দসংগ্রহ।
তথাকথিত সাহিত্যিক বাংলা থেকে অনেক আলাদা টোটোদের মুখের ও স্কুলের বাংলা। বাংলায় পঠনপাঠন জটিল শিশুদের কাছে। তাদের বাংলা শেখার সুযোগ কেবল স্কুলে, ফলে মুখের বাংলা প্রভাব ফেলে লেখার বাংলায়। সেই বাংলা নেপালি, হিন্দি, রাজবংশী, টোটো মিশ্রিত। টোটো ভাষায় টোটোদের শিক্ষা দেওয়া সম্ভব। আখর প্রস্তুত, প্রয়োজন উদ্যোগ।
তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy