Advertisement
E-Paper

রাজনীতি ও খেলার প্রতিভা

ঔপনিবেশিক ভারতে ক্রিকেট কোনও দিনই সে অর্থে জনতার খেলা ছিল না। সেটা ছিল ফুটবল। ফুটবল বা হকির তুলনায় ক্রিকেট ছিল সুখী ও অভিজাত সমাজের খেলা।

সূচনা: ১৯৮৩ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পর কপিল দেব ও মহিন্দর অমরনাথ।

সূচনা: ১৯৮৩ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পর কপিল দেব ও মহিন্দর অমরনাথ। ছবি: গেটি ইমেজেস।

সায়নদেব চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২৫ ০৭:২৮
Share
Save

আসলে ক্রিকেট একটি ভারতীয় খেলা, যা ঘটনাক্রমে ব্রিটিশরা আবিষ্কার করেছিল।” সমাজবিদ আশিস নন্দী কথাটি লিখেছিলেন তাঁর টাও অব ক্রিকেট: অন গেমস অব ডেস্টিনি অ্যান্ড দ্য ডেস্টিনি অব গেমস (২০০০) বইয়ে। এই বাক্যটির মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন কৌতুক আছে, আবার এক সূক্ষ্ম বিচক্ষণতাও আছে। এর কৌতুক অংশটি ২০০০ সালে, বইটির প্রকাশকালে, কিছুটা বোঝা গিয়েছিল। কিন্তু এই বাক্যের যে নিহিত আশঙ্কা, সেটা এখন হাড়েহাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে।

টাও অব ক্রিকেট প্রকাশের এক বছর বাদে মুক্তি পায় হিন্দি ছবি লগান। সাহেবদের খেলা তাদের থেকে লুকিয়ে শিখে কিছু দিনের ব্যবধানে ওই খেলায় হারিয়ে তাদের পাততাড়ি গুটানোর ব্যবস্থা করার এই ছবির যে ফ্যান্টাসি, তার মধ্যে লুক্কায়িত ছিল একটা দেশের উত্তর-ঔপনিবেশিক উচ্চাভিলাষ। সিনেমায় অতিনাটকীয় হলেও ওই অভিলাষ যে কাল্পনিক, তা ভাবার কোনও কারণ নেই। বরং, ১৯৮৩-র জুন মাসে যখন কপিল দেবের হাতে ওয়ার্ল্ড কাপ দেখল ভারত, তখন থেকেই এই অভিলাষের বীজ বপন হয়েছে। তার পর বেনসন অ্যান্ড হেজেস, রথম্যান্স কাপ, হিরো কাপ; আশি আর নব্বইয়ের দশকে বেশ কিছু ছোট-বড় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট ভারত জিততে থাকল। এর একটা তুঙ্গ মুহূর্ত লর্ডস-এ ২০০২ সালে, যখন ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির মতো আপাত-গুরুত্বহীন ট্রফি জিতেও ড্রেসিংরুমের বারান্দায় পরনের জার্সি খুলে উড়িয়ে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ভারতের ‘প্রতিরোধ’-এর একটা স্মরণীয় ‘দৃশ্য’ রচনা করলেন। কোথাও একটা এই এজাহার করা হল যে, ‘ক্রিকেট তোদের উদ্ভাবিত খেলা হতে পারে, কিন্তু তাতে এক বার নয়, একাধিক বার চাম্পিয়ন হওয়ার ক্ষমতা রাখি আমরা’। পুরো সত্তরের দশক ধরে এই কাজটাই করে এসেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ়— সাহেবদের আবিষ্কৃত খেলার টেম্পারামেন্ট ও ব্যাকরণকে আয়ত্ত করে সেই খেলার ‘অরিজিন’-টাকেই সঙ্কটে ফেলে দেওয়া। এই নিয়ে দুর্দান্ত তথ্যচিত্রও আছে— ফায়ার ইন ব্যাবিলন।

ঔপনিবেশিক ভারতে ক্রিকেট কোনও দিনই সে অর্থে জনতার খেলা ছিল না। সেটা ছিল ফুটবল। ফুটবল বা হকির তুলনায় ক্রিকেট ছিল সুখী ও অভিজাত সমাজের খেলা। সাহেবরাও ক্রিকেটকে সর্বার্থে ‘সফ্ট পাওয়ার’-এ পরিণত করার কথা ভাবেনি। সেই কাজ ফুটবলই করে দিয়েছিল— এই পৃথিবীর একমাত্র বৈশ্বিক ক্রীড়া। ফুটবল এর নিজস্ব ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব ও রাজনীতি আছে। কিন্তু যে ভাবেই দেখা হোক, গত শতকের ষাটের দশকের পর ওই জগৎসভায় ভারতের সামান্যতম অহঙ্কারও বেমানান। তাই ঔপনিবেশিক যুগে তৈরি হওয়া ‘ক্রীড়া সংস্কৃতি’ খুব ধীরে বদলাতে থাকল। কিন্তু সেটা মাত্রার তফাত, আমূল পরিবর্তন নয়। সেই পরিবর্তনই ঘটল গত শতকের শেষে। ক্রিকেটের হাত ধরে।

ক্রিকেট ফুটবলের ঠিক বিপরীত। প্রায় কোনও বড় দেশই এই খেলাটি খেলে না। যারা খেলে তার মধ্যে ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়া-নিউ জ়িল্যান্ড ক্রিকেট খেললেও এবং সেখানে ক্রয়ক্ষমতা অনেক বেশি হলেও ওখানে ক্রিকেটের বাজার নেই— এই তিন দেশের মূল খেলা যথাক্রমে ফুটবল ও রাগবি। দক্ষিণ আফ্রিকার একার সেই ভৌগোলিক অবস্থান নেই। এখানে একমাত্র কাঁটা হতে পারত ওয়েস্ট ইন্ডিজ়— সে দেশে ক্রিকেটের কী অবস্থা হল, সেটা তো আমরা দেখলাম।

নব্বইয়ের দশক থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যে, ভারতের বিপুল জনসংখ্যাকে মাতিয়ে রাখতে ক্রিকেট একই সঙ্গে দুটো উপকারে লাগবে— এক, আন্তর্জাতিক স্তরে ‘জাতীয় প্রত্যয়’-এর হার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার সমস্ত রসদ আছে ক্রিকেটে; এবং দুই, বাজার। ১৯৮৩-র পরে ভারতে ক্রিকেটের প্রতি সর্বজনীন আকর্ষণ বাড়লেও সেই সময়ের তিনটে বড় টুর্নামেন্ট— ১৯৮৭ আর ১৯৯৬-এর বিশ্বকাপ, আর ১৯৮৯-এর নেহরু কাপ— উপমহাদেশে হওয়া সত্ত্বেও ভারত কিন্তু জেতেনি। তবে একের পর এক টুর্নামেন্ট এখানে আয়োজন করে, খুব আস্তে আস্তে ১৯৯১-এর আর্থিক সংস্কারের ফলে তৈরি হওয়া খোলা বাজারের হাওয়ার সঙ্গে ক্রিকেটের প্রাপ্তিকে মিলিয়ে দেওয়ার সেই শুরু। অর্থাৎ ভারতের মতো দেশে ক্রিকেটের যে একটা জনমনোহরণের ক্ষমতা আছে, সেটা ঠিক তখনই সামনে এল, যখন পৃথিবীটাকে দেশ বা অঞ্চলে নয়, ‘বাজার’-এ ভাগ করতে শেখাল নব্য-উদার ভূরাজনীতি। তাই সত্তর দশকের ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের চেয়ে অনেকটাই আলাদা রূপ নিল ভারত বা বৃহত্তর উপমহাদেশে ক্রিকেটের নব-উদ্‌যাপন। সঙ্গে জুটল ঠান্ডা পানীয় প্রস্তুতকারী দুই যুযুধান বৈশ্বিক প্রধান সংস্থা ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গ, আর সস্তায় বাজিমাত করতে চাওয়া ধুরন্ধর কিছু ব্যবসায়ী।

এও বোঝা গেল যে, বাজার অটুট রাখতে হলে ক্রিকেটকে আর মরসুমি খেলা রাখা চলবে না, তাকে বছরভর চোখের সামনে রেখে নিরবচ্ছিন্ন ডোপামিনে পরিণত করতে হবে। সেই আয়োজন শুরু হল। টেলিভশন রাইটস বিক্রি করা শুরু হল ১৯৯৩ থেকে। আর তার সঙ্গে শুরু হল ক্রিকেটীয় কিংবদন্তি তৈরির সুস্থিত প্রকল্প— ক্রিকেটারদের সিনেমার মতো ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হিসাবে দেখানো। বিজ্ঞাপনে, ফ্যাশন শো-তে, ফিল্ম পুরস্কারে— জনজীবনে বিনোদনের অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে উঠলেন দেশের ক্রিকেটাররা। দেশ জুড়ে যার অবদান এই আয়োজনে একেবারে শিখরে ছিল, তিনি সচিন তেন্ডুলকর।

আর দুটো কাজ বাকি থেকে গিয়েছিল। এক, আইসিসির দখল নেওয়া। যেটা জগমোহন ডালমিয়া দিয়ে শুরু হয়। দুই, দু’-একটা উঠতি নতুন দেশকে হঠাৎ হঠাৎ একটু তোল্লাই দিলেও আদতে এটাও নিশ্চিত করা যেন ক্রিকেট কোনও ভাবেই আর না ছড়ায়— উপমহাদেশের যেন কোনও যথার্থ ভৌগোলিক বা খেলোয়াড়ি প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি না হয়। ‘ভুল করে’ বিলেতে আবিষ্কৃত ক্রিকেটকে এ বার তার প্রতিশ্রুত পিতৃভূমিতে ফিরিয়ে দেওয়া হল।দক্ষিণ এশিয়া।

কিন্তু, প্রতিশ্রুত পিতৃভূমি শুধু নির্মাণ করলেই চলে না, তাকে বজায় রাখতে হয়। তাই প্রয়োজন উগ্র দেশপ্রেম, প্রতিদ্বন্দ্বী ‘শত্রু’ দেশের প্রতি অকৃত্রিম বিদ্বেষ, আর ক্রমাগত ‘প্রাপ্তি’-র জোগান। এই ছকটা সবচেয়ে ভাল বোঝে দক্ষিণপন্থা। দিল্লির মসনদে আজকের বিজেপি যত দিনে জাঁকিয়ে বসল, তত দিনে আলাদা করে ক্রিকেটের দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার ধরার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আইপিএল দেশের রক্তে প্রবাহিত হতে শুরু করেছে। মূলধারার গণমাধ্যম ক্রমে হয়ে উঠছে শাসকের মুখপত্র, সমাজমাধ্যমে বিদ্বেষের আবাদ। তবুও, দক্ষিণপন্থী শাসনের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথে কিছু বাধা ছিল। যেমন, হিন্দি ভাষা চাপিয়ে, অথবা বলিউডের রাস্তা দিয়ে গো-বলয়ে অধিপত্য বিস্তার করা গেলেও সে চাবিতে দাক্ষিণাত্যের দরজা খোলে না।

এখানেই দক্ষিণপন্থার কাছে ক্রিকেট গুরুত্বপূর্ণ— গোটা ভারত এই মন্ত্রে সম্মোহিত হয়ে যায়। দেশের আসল অবস্থা চুলোয় যাক— শুধু নিশ্চিত করে যেতে হবে, ভারত যেন জিততে থাকে। প্রতি বছর কোনও না কোনও বিশ্বকাপের আয়োজন করো, সামরিক ভাষায় ভরিয়ে দিয়ে প্রচারতুঙ্গে তোলো, সংবাদমাধ্যমকে লেলিয়ে দাও, খেলা খেলা ভাব করো, মাতিয়ে রাখো, কলরব তৈরি করো। ‘সফ্ট পাওয়ার’-এর সুচারু ব্যবহারে মগজ ধোলাই, এ রকম সুললিত জলসা ব্রিটিশ শাসনও বসাতে পারেনি; যে ভাবে দেশের দক্ষিণপন্থাসেটাকে আয়ত্ত করেছে। কারণ দেশে আর কোনও শব্দ চাই না— শুধু ‘ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া’। দেশ জিতছে, দেশ জিতবে।

শুধু কনসেন্ট বা সম্মতি নির্মাণ করলেই আর দক্ষিণপন্থার প্রয়োজন মেটে না এখন। তার সঙ্গে নির্মাণ করতে হয় কনকোয়েস্ট বা বিজয়ও। গত দশ বছরে সেই নির্মাণপর্বটি সম্পন্ন হয়েছে।

ক্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, অন্ধ্রপ্রদেশ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Cricket Kapil Dev Sourav Ganguly Sachin Tendulkar ICC

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}